এপ্রিল ২৯, ২০২৪ ২১:১৪ Asia/Dhaka
  • যুক্তি, আধ্যাত্মিকতা ও ন্যায়বিচার শিয়া মুসলিম চিন্তাধারার তিনটি স্তম্ভ

আহলুল-বাইত বিশ্ব সংস্থার মহাসচিব হুজ্জাতুল-ইসলাম রেজা রামেজানি ল্যাটিন আমেরিকা সফরের সময় ভেনেজুয়েলার রাষ্ট্রপতি নিকোলাস মাদুরোর সাথে সাক্ষাৎ ও আলোচনা করেছেন।

মেহের বার্তা সংস্থা জানিয়েছে, এই বৈঠকের শুরুতে নিকোলাস মাদুরো হুজ্জাতুল-ইসলাম রেজা রামেজানির ভেনিজুয়েলা সফরে আনন্দিত বলে জানান  এবং ইরান ও ভেনিজুয়েলার মধ্যকার সম্পর্ককে ভ্রাতৃত্বপূর্ণ, গভীর ও প্রাচীন বলে উল্লেখ করেন। এই বৈঠকে মাদুরো জোর দিয়ে বলেন:

দুই দেশের এই সম্পর্ক অবশ্যই মূল্যবোধ এবং নীতিমালা-ভিত্তিক হওয়া উচিত। আমরা একটি বলদর্পিতাপূর্ণ বিশ্বে বাস করি। চ্যাভেজ বিশ্বাস করতেন যে  একুশ শতক জাতিগুলোর শতাব্দী, এবং আমরা এটির অংশ, একুশ শতক আমাদের শতাব্দী। কেউই আমাদের মুক্তি, স্বাধীনতা ও শান্তিতে বসবাসের অধিকার এবং আধ্যাত্মিকতা, সংস্কৃতি ও ধর্মের সাথে আমাদের বন্ধন বা সংযোগের অধিকার আমাদের থেকে কেড়ে নিতে পারে না।”

ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট বলেছেন, ইরান ও ভেনিজুয়েলার মধ্যে বন্ধুত্ব রাজনৈতিক ও অস্থায়ী নয়, বরং বাস্তব ও কৌশলগত। তিনি ইরান ও ভেনিজুয়েলার জনগণের মধ্যে সম্পর্ক জোরদারের ওপর জোর দেন।

মাদুরো, ইসলামী বিপ্লবের নেতা আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ীর  সাথে তাঁর বৈঠকের কথা উল্লেখ করে, তাঁকে একজন বিচক্ষণ ব্যক্তি বলে উল্লেখ করেছেন।  বিশ্ব এবং এর ঘটনাবলী সম্পর্কে তাঁর খুব সঠিক ও গভীর বিশ্লেষণ রয়েছে বলেও মাদুরো উল্লেখ করেন।

তিনি জোর দিয়ে বলেছেন: "আমরা সব সময় ইসলামী বিপ্লবের নেতার দিক-নির্দেশনা কাজে লাগাই এবং আমি আহলুল বাইত বিশ্ব সংস্থার মহাসচিবকে অনুরোধ করছি তিনি যেন মহামান্য আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ীকে আমার বিশেষ সালাম বা শুভেচ্ছা জানান।"

জনাব রামেজানি ও মাদুরো 

ইহুদিবাদীরাই বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে শাসন করছে

ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট, বিশ্বের বর্তমান অবস্থা বিশ্লেষণ করে বলেছেন:

“বিশ্ব পরিবর্তনের একটি নতুন যুগে প্রবেশ করেছে। নাৎসিবাদ এবং ফ্যাসিবাদের প্রায় ১০০ বছর কেটে গেছে, কিন্তু আজ আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা দেশগুলিতে নাৎসি ও ফ্যাসিবাদী ধারার উপস্থিতি প্রত্যক্ষ করছি। আজকের বিশ্বের সমস্ত সমস্যা এই ফ্যাসিবাদী ও নাৎসি দৃষ্টিভঙ্গি থেকে উদ্ভূত যা পশ্চিমা দেশগুলির সমস্ত স্তম্ভে অনুপ্রবেশ করেছে।"

আহলে বাইত বিশ্বসংস্থার মহাসচিব জনাব রামেজানির সঙ্গে ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেনট নিকোলাস মাদুরোর বৈঠক 

মাদুরো আরও বলেছেন, আজ ইহুদিবাদীরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে পরিচালনা করছে। দেশটির সামরিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তি তাদেরই হাতে। ইহুদিবাদীরা দুই প্রধান দল রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেট পার্টিকে নিয়ন্ত্রণ করছে। দুই প্রধান শক্তি তথা সামরিক শক্তি ও সামাজিক নেটওয়ার্কগুলো তাদেরই নিয়ন্ত্রণে। ইহুদিবাদীরা সামরিক শক্তির মাধ্যমে শান্তিকে বিপদাপন্ন করেছে এবং ফেসবুক ও এক্স-এর মত সামাজিক মাধ্যমগুলোর মাধ্যমে বিশ্বজনমতকে বিভ্রান্ত করছে।

প্রেসিডেন্ট মাদুরো বলেন, “অবশ্যই, আমরা আজ একটি বহুমেরুকেন্দ্রীক বিশ্বে প্রবেশ করেছি, যেখানে চীন, রাশিয়া এবং ইরানের মতো বিভিন্ন শক্তির মেরু তৈরি হয়েছে। ইরান সামরিক ক্ষেত্রে ভাল অগ্রগতি করেছে এবং ইরানের উচিত সামাজিক নেটওয়ার্কের ক্ষেত্রেও জোরালোভাবে প্রবেশ করা। ভেনিজুয়েলায় আমরা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নে আমাদের প্রথম পদক্ষেপ নিয়েছি এবং আমরা ভেনিজুয়েলা ও ইরানের মধ্যে বৈজ্ঞানিক আদান-প্রদান শুরু করেছি, যা প্রসারিত হবে বলে আমি আশা করছি।"

ইরান এবং ভেনিজুয়েলার মধ্যে সম্পর্কের গভীরতা ও এর কৌশলগত প্রকৃতি

এছাড়াও এই বৈঠকে আহলুল-বাইত ওয়ার্ল্ড অ্যাসেম্বলির সেক্রেটারি-জেনারেল হুজ্জাতুল-ইসলাম রামেজানিও ইরান ও ভেনিজুয়েলার সম্পর্ককে গভীর ও কৌশলগত বলে বর্ণনা করে জোর দিয়ে বলেছেন যে:

"আমাদের ধর্মের নীতির ভিত্তিতে  জুলুম বা নিপীড়ন করা ও নিপীড়ন মেনে নেয়াকে নিন্দা করা হয় এবং অন্যদিকে, মর্যাদা এবং ন্যায়বিচারের উপর জোর দেওয়া হয়।"

তিনি আরও বলেছেন, ইমাম খোমেইনি (র) ইরানের ও বিশ্বের জাতিগুলোর সামনে এক মহান শিক্ষা তুলে ধরেছেন। আর ওই শিক্ষাটি হল: আমরা জুলুমের মোকাবেলায় রুখে দাঁড়াতে পারি এবং এভাবে নতুন সভ্যতা গড়ার পথ সুগম করতে পারব। ইমাম খোমেইনি (র) চারটি মূলনীতিতে বিশ্বাস করতেন। এই চার মূলনীতি হল: আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস, লক্ষ্যের প্রতি বিশ্বাস, কর্মপন্থার প্রতি বিশ্বাস ও জনগণের প্রতি বিশ্বাস। তিনি এই চার নীতির প্রতি বিশ্বাসের ভিত্তিতে বিপ্লব করেছেন এবং ইরানে ও বিশ্বে পরিবর্তন এনেছেন। ফলে বদলে গেছে বর্তমান বিশ্বের প্রচলিত সমীকরণগুলো।  

জনাব রামেজানি আরও বলেছেন, “বিশ্বে পরিবর্তন ঘটতে হবে যাতে বিশ্বের সম্পদ সকল মানুষের মধ্যে ন্যায্যভাবে বণ্টন করা হয়, বিশ্বের জনসংখ্যার মাত্র ১০ শতাংশ বিশ্বের ৯০ শতাংশ সম্পদ থেকে ভোগ করছে, অন্যদিকে বিশ্বের জনসংখ্যার নব্বুই শতাংশ  বিশ্বের কেবল ১০ শতাংশ সম্পদ থেকে ভোগ করছে।"

হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমিন জনাব রামেজানি কোনো কোনো সরকারের মাধ্যমে আধুনিক দাসপ্রথার কথা তুলে ধরে বলেছেন, অতীতে ১০০ জন ব্যক্তি এক হাজার ব্যক্তিকে দাস করত, কিন্তু বর্তমান যুগে জাতিগুলোকে দাস করা হচ্ছে, তাই মানুষের অধিকারগুলোর প্রতি প্রকৃত অর্থেই সম্মান করতে হবে এবং দাসপ্রথার বেসাতি নির্মূল করতে হবে। 

তিনি আরও বলেছেন, শিয়া মুসলিম চিন্তাধারায় ন্যায়বিচার হচ্ছে কেন্দ্রীয় বা প্রধান বিষয় এবং ইমাম আলী (আ) হচ্ছেন ন্যায়বিচারের প্রতীক। জর্জ জোরদাকের মত চিন্তাবিদ এ বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। যুক্তি, আধ্যাত্মিকতা ও ন্যায়বিচার শিয়া মুসলিম চিন্তাধারার তিনটি প্রধান স্তম্ভ যা উৎসারিত হয়েছে মহানবীর (সা) আহলে বাইতের (আ) শিক্ষা থেকে।  

আহলুল বাইত ওয়ার্ল্ড অ্যাসেম্বলির মহাসচিব আরও বলেছেন: “হযরত মাসিহ তথা যীশু খ্রিস্ট (আ) জাতিগুলোকে শক্তিশালী করতে আসবেন। আমরা শিয়া মুসলমানরাও বিশ্বাস করি যে ইমাম মাহদী (আল্লাহ তাঁর পুনরাবির্ভাব ত্বরান্বিত করুন) জাতিদের ক্ষমতায়নের জন্য আসবেন, এবং সরকার ধার্মিকদের হাতে চলে যাবে, এবং অত্যাচারের অধীনে থাকা নির্যাতিতরা বিশ্ব শাসন করবে এবং অত্যাচারী, অহংকারীরা। এবং অত্যাচারীদের নির্মূল করা হবে।"

হুজ্জাতুল-ইসলাম রামেজানি আরও উল্লেখ করেছেন: “ইরান একটি আঞ্চলিক শক্তি থেকে বৈশ্বিক শক্তিতে রূপ নিয়েছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইরানের সক্ষমতা তার বৈজ্ঞানিক উন্নতি ও শক্তির ফসল। কোনো কোনো বৈজ্ঞানিক ক্ষেত্রে ইরান শীর্ষ দশটি দেশের মধ্যে স্থান করে নিয়েছে এবং বৈশ্বিক বৈজ্ঞানিক র‌্যাঙ্কিংয়ে ১৬ তম স্থান অধিকার করেছে। তাই ইরান তার বৈজ্ঞানিক অভিজ্ঞতা ও অর্জন অন্যান্য দেশের সাথে শেয়ার করতে প্রস্তুত। নিষেধাজ্ঞার মধ্যে ইরানে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে আমরা ভেনিজুয়েলার সাথে তা শেয়ার করতে প্রস্তুত।”

আহলুল-বাইত মাযহাবের অনুসারীদের প্রতি মনোযোগের দিতে মাদুরোর গুরুত্ব আরোপ

এই বৈঠকের শেষে, হুজ্জাতুল-ইসলাম রামাজানি ভেনিজুয়েলার রাষ্ট্রপতিকে অনুরোধ করেন ভেনিজুয়েলায় আহলে বাইতের মাযহাবের অনুসারী ও আহলে বাইতের অনুরাগীদের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিতে এবং সংশ্লিষ্ট অনুষ্ঠানগুলোতে যেন তাদের প্রতিনিধিদের আমন্ত্রণ জানানো হয়।

এই অনুরোধটি ভেনিজুয়েলার রাষ্ট্রপতি জোরালোভাবে বিবেচনা করেছেন, তিনি জোর দিয়ে বলেন যে আহলুল-বাইত মাযহাবের অনুসারীদের প্রতিনিধি দল সর্বদা আমন্ত্রিত।

এই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন ইসলামী রিপাবলিক অব ইরানের বিজ্ঞান, গবেষণা ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সাংস্কৃতিক ও সামাজিক উপ উপদেষ্টা ড. আব্দুল হোসেইন কালান্তারি ও ভেনিজুয়েলায় নিযুক্ত ইরানি রাষ্ট্রদূত হুজ্জাতুল্লাহ সোলতানি। অপরপক্ষে ভেনিজুয়েলার পরিবহনমন্ত্রী  র‍্যামন ভেলাস্কেজ, ভেনিজুয়েলার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও ইরানের সাথে সহযোগিতা বিষয়ক ভেনিজুয়েলা কমিশনের প্রধান ইভান গিল পিন্টো এবং ভেনিজুয়েলার সাংস্কৃতিক ও পর্যটন বিষয়ক ভাইস প্রেসিডেন্ট ও দেশটির যোগাযোগমন্ত্রী ফ্রেডি আলফ্রেড নাজারেথও এ বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। #

পার্সটুডে/এমএএইচ/৩০

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

 

ট্যাগ