জুলাই ০৮, ২০২১ ১৯:২৬ Asia/Dhaka
  • আফগানিস্তান থেকে পাচার করা মাদক ইরানে আটক
    আফগানিস্তান থেকে পাচার করা মাদক ইরানে আটক

মাদক পাচার ও এর ব্যবহার সারা বিশ্বের জন্য বিরাট হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে যুব-শ্রেণী সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে বিশ্বের সব সরকারের জন্যই এটি বিরাট মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য আন্তর্জাতিক মাদক দিবস পালন করা হয়।

বিশ্বে বিশেষ করে মধ্যএশিয়া ও ইউরোপে মাদকদ্রব্য পাচারের জন্য ইরান একটি গুরুত্বপূর্ণ রুট হিসেবে পরিচিত। কিন্তু ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামি বিপ্লব হওয়ার পর দেশটির সরকার মাদক পাচার ও ব্যবহারের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয়। মাদক পাচার রোধ করতে গিয়ে সীমান্ত এলাকায় এ পর্যন্ত ইরানের নিরাপত্তা বাহিনীর বহু সদস্য সংঘর্ষে প্রাণ হারিয়েছে। বলা যায় মধ্যএশিয়া ও ইউরোপের দেশগুলো মাদক বিরোধী অভিযানে ইরানের আত্মত্যাগ ও প্রচেষ্টার কাছে ঋণী।

মাদক উৎপাদক, পাচারকারী, ব্যবসায়ী শ্রেণী এবং আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক মাফিয়া চক্র যতটা না লাভবান হচ্ছে তার চেয়ে বেশি ফায়দা লুটছে উন্নয়নশীল দেশগুলোর ওপর আধিপত্য বিস্তারকারী বৃহৎ শক্তিগুলো। বৃহৎ শক্তিগুলো মাদককে তাদের লক্ষ অর্জনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়ক বিশ্লেষকরা মনে করেন, সামরিক ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের পাশাপাশি মাদকের বিস্তার ঘটিয়েও বৃহৎ শক্তিগুলো অন্য দেশ বা জাতিগুলোর নৈতিক চরিত্র ধ্বংস ও আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা চালায়। এতে করে শুধু যে কয়েকটি দেশ বা নির্দিষ্ট অঞ্চলের সামাজিক শৃঙ্খলা ও পরিবেশ বিনষ্ট হচ্ছে তাই নয় একইসঙ্গে বিশ্বব্যাপী এর ধ্বংসাত্মক প্রভাব পড়ছে।

মাদক পাচারকারী চক্র ও তাদের পেছনের মদদদাতা বৃহৎ শক্তিগুলোর প্রধান টার্গেট যুব সমাজকে ধ্বংস করা যারা কিনা একটি দেশের উন্নয়নে বিরাট ভূমিকা রাখে। মাদকের ছোবলে অর্থনৈতিকভাবেও পিছিয়ে পড়ে দেশগুলো। ফলে শিক্ষা, ক্রিড়া, সাংস্কৃতিক, সামাজিক প্রভৃতি ক্ষেত্রে যেমন পিছিয়ে পড়ে তেমনি স্বাধীনতা ও নিরাপত্তাও চরমভাবে বিঘ্নিত হয়।

বিভিন্ন কারণে পশ্চিম এশিয়া এবং এর বাইরের দেশগুলোতে মাদকের ছড়াছড়ি। এ কারণে এ অঞ্চলের দেশগুলোর উচিত মাদক  উৎপাদন, পাচার ও বিস্তার রোধে জোর প্রচেষ্টা চালানো। কারণ এ ক্ষেত্রে যেকোনো উদাসীনতা বা অবহেলা সমগ্র এ অঞ্চলে ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। সবচেয়ে বেশি মাদক উৎপাদন হয় আফগানিস্তানে। ফলে প্রতিবেশী হিসেবে দুদিক থেকে ইরান সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। প্রথমত, আফগানিস্তানে উৎপাদিত মাদক ইউরোপে পাচারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ট্রানজিট হিসেবে ইরানের রুট ব্যবহৃত হয়। ফলে এসব মোকাবেলা করতে গিয়ে ইরানকে কঠিন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয় এবং এর পেছনে ইরানের বিপুল অর্থ ব্যয় হয়। আর প্রায়ই সংঘর্ষে প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। ইরানের দ্বিতীয় ক্ষতি হচ্ছে প্রতিবেশী হওয়ার কারণে এসব মাদকের একটি অংশ ইরানিদের বিশেষ করে যুব-শ্রেণির হাতে পৌঁছে যাচ্ছে যার ফলে যুব-সমাজের একটি অংশ বিপথে যাচ্ছে।

এ অঞ্চলের দুটি প্রধান মাদক উৎপাদনকারী দেশের প্রতিবেশী হচ্ছে ইরান। ওই দুটি দেশ হচ্ছে আফগানিস্তান ও পাকিস্তান। 

তবে আফগানিস্তানে সবচেয়ে বেশি মাদক উৎপাদন হয়। এসব মাদক ইরান হয়ে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পৌঁছে যাচ্ছে। ভারতে উৎপাদিত মাদকও এদিক দিয়ে পাচার হয়। মাদক পাচার রোধ করতে গিয়ে গত ৪০ বছরে ইরানের চার হাজারের বেশি নিরাপত্তা কর্মী শহীদ হয়েছে। এ ছাড়া ১২ হাজার ব্যক্তি আহত এবং বিপুল অর্থ এর পেছনে ব্যয় হয়েছে। গত বছর ইরানের নিরাপত্তা বাহিনী ৯৫০টন বিভিন্ন ধরনের মাদক জব্দ করেছে যা কিনা সারা বিশ্বে নজিরবিহীন। এভাবে মাদক পাচার রোধে ইরান নজিরবিহীন ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। নিজস্ব উদ্যোগে প্রচেষ্টা চালানো ছাড়াও ইরান প্রতিবেশী অন্য দেশেরও সহযোগিতায় একটি গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন করেছে যাতে মাদক পাচার রোধে তথ্য বিনিময় করা যায়।

মাদকের ব্যবহার শুধু যে একটি পরিবার বা সমাজকে ধ্বংস করে দেয় তাই নয় গোটা মানব সমাজকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়। বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ মাদকের ছোবলে ভয়াবহ সামাজিক সংকটে জর্জরিত। সরকারগুলো মাদক বিরোধী অভিযানে বিপুল অর্থ ব্যয় করলেও মাদক চোরাচালানিদের তৎপরতা আগের চেয়ে বেড়েছে। বিশ্বের প্রায় সাড়ে তিন কোটি মানুষ বর্তমানে মাদকাসক্ত এবং তাদের চিকিৎসার প্রয়োজন। গত তিন দশকের তুলনায় বর্তমানে মাদক বিরোধী অভিযানের গুরুত্ব বহুগুণে বেড়েছে। অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় ১৯৮৭ সালের  ২৬ জুন এ বিষয়ে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ওই সম্মেলনে একটি প্রস্তাব পাশ হয় যাতে মাদক পাচার ও নিয়ন্ত্রণ রোধে করণীয় বিষয়ে কিছু সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। প্রস্তাবে চারটি অনুচ্ছেদ রাখা হয়। এতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মাদকের বিস্তার রোধ, যেসব জমিতে মাদকের চাষ হয় সেগুলো উচ্ছেদ করা, চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত চক্রকে ধ্বংস করে দেয়া এবং এ বিষয়ে সব দেশের মধ্যে সহযোগিতা বাড়ানোর কথা বলা হয়।

এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০০১ সালে আফগানিস্তান জবর দখল হওয়ার পর ওই দেশটি মাদক চাষ ও উৎপাদনের প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।

জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে আফগানিস্তানে মাদক চাষের জন্য ব্যবহৃত জমির পরিমাণ দশগুণ বেড়েছে। কোনো কোনো খবরে বলা হয়েছে, ২০০১ সালে আফগানিস্তানে আফিম উৎপাদিত হয়েছিল প্রায় ১৮০টন। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এটির উৎপাদনের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে নয় হাজার টন। বাস্তবতা হচ্ছে, গত তিন দশক ধরে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও যুদ্ধ সংঘাতের কারণে আফগানিস্তান মাদক উৎপাদনের স্বর্গ রাজ্যে পরিণত হয়েছে। এ ছাড়া ওই দেশটিতে মার্কিন উপস্থিতিও মাদক চাষে ভূমিকা রেখেছে। কেননা খোদ মার্কিন সেনারাও মাদক ব্যবসা থেকে মুনাফা লুটেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে মার্কিন উপস্থিতির ফলে আফগানিস্তানে যে যুদ্ধ ও সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে তার ফলে অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে দেশটি পিছিয়ে পড়ায় অনেক মানুষ মাদকের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। আফগানিস্তানসহ পশ্চিম এশিয়ায় সন্ত্রাসীদের প্রধান আয়ের উৎস মাদক ব্যবসা।

যাইহোক, আফগানিস্তানে মাদক উৎপাদন ও তা চোরাচালানের কারণে ইরানসহ অন্য দেশের সীমান্ত এলাকার নিরাপত্তা মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে। ইতালির সাংবাদিক আলেক্সান্ডার স্কাতি বলেছেন, 'মাদক চোরাচালান রোধ সারা বিশ্বের জন্য কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি এ ক্ষেত্রে ইরানের ভূমিকার ভূয়সী প্রশংসা করে ইরানের পাশে দাঁড়ানোর জন্য আন্তর্জাতিক সমাজের প্রতি আহ্বান জানান। কেননা ইরান যদি মাদক পাচারের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান না নিত তাহলে ইউরোপসহ বিশ্বের বহু দেশ মাদকে সয়লাব হয়ে যেত।#

পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন/

ট্যাগ