নভেম্বর ১৬, ২০২৩ ১৫:১৪ Asia/Dhaka

তুরস্কের কর্মকর্তারা ইসরাইলি অপরাধযজ্ঞের বিরুদ্ধে কঠোর বক্তব্য দিলেও এখন প্রতিদিনই ইসরাইলের সাথে তুরস্কের বাণিজ্য সম্পর্কের নতুন নতুন তথ্য বেরিয়ে আসছে।

তুর্কি নেতারা দীর্ঘদিন ধরে নিজেদেরকে নিপীড়িত ফিলিস্তিনি জাতির সমর্থক ও রক্ষক হিসাবে দেখানোর চেষ্টা করে আসছেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ইসরাইলের সাথে অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি এবং ইসরাইলে মৌলিক পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে তুরস্ক সরকার যতটা সম্ভব এই দখলদার সরকারের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছে। এ প্রসঙ্গে, তুরস্কের বিখ্যাত অর্থনৈতিক ভাষ্যকার ইব্রাহিম কাহভে চি স্পষ্ট পরিসংখ্যান তুলে ধরে, তুরস্ক থেকে ইসরাইলে পণ্য রপ্তানির বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ফাঁস  করে দিয়েছেন। তিনি তার পরিসংখ্যানে বলেছেন, 'ইসরাইলে তুরস্কের পণ্য রপ্তানি থেকে বোঝা যায়, আঙ্কারার কর্মকর্তারা কেবল দেশের অভ্যন্তরে জনগণের সমর্থন লাভের জন্য ইসরাইলের বিরুদ্ধে জ্বালাময়ী বক্তব্য দিচ্ছেন কিন্তু পর্দার আড়ালে আসল বাস্তবতা হচ্ছে, ইসরাইলের সাথে তুরস্কের বাণিজ্য তো থামেনি বরং আগের চেয়ে আরো বেড়েছে।

তুরস্কের এই খ্যাতনামা অর্থনৈতিক ভাষ্যকার ইব্রাহিম কাহভে চি রেস্তোরাঁর খাদ্য তালিকা থেকে কোকাকোলা ও নেসক্যাফের মতো অতি নিম্ন-মূল্যের ইসরাইলি পণ্যগুলো অপসারণের একইসাথে ইসরাইলের কাছে ৬০০ কোটি ডলার মূল্যের 'স্টিল'-এর মতো কৌশলগত পণ্য রপ্তানিকে তুরস্ক সরকারের ভণ্ডামি হিসাবে অভিহিত করেছেন।

এদিকে, তুর্কি পণ্য রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান টিআইএম-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে,  তুর্কি সরকার জার্মানির সমপরিমাণে পণ্য ইসরাইলে রপ্তানি করে থাকে এবং চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরেই তুরস্কের অবস্থান। অন্য কথায়, ইসরাইলের মৌলিক চাহিদা প্রদানে তুরস্ক ও জার্মানি যৌথভাবে বিশ্বের মধ্যে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে।

টিআইএম-এর প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, 'তুরস্ক ২০২২ সালে ইসরাইলে ১১৯ কোটি ২০ লাখ  ডলারের লোহা ও ইস্পাত রপ্তানি করেছে। এ ছাড়া, ৫৬  কেটি ৩০ লাখ ডলার মূল্যের তুর্কি গাড়ি ইসরাইলে রপ্তানি করা হয়েছে। ৫১ কোটি ২০ লাখ ডলার মূল্যের প্লাস্টিকজাত সামগ্রী রপ্তানি করে তুরস্ক তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে।'

বিশ্লেষকরা বলছেন, ইসরাইলে তুরস্কের ইস্পাত রপ্তানি দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং তুরস্ক প্রতি বছর ইসরাইলে কমপক্ষে ৬০০ কোটি ডলার মূল্যের ইস্পাত রপ্তানি করে। ইস্পাত ছাড়াও, তেল এবং গ্যাস প্রকৌশল শিল্পে তুরস্ক ইসরাইলকে সবচেয়ে বেশি সহায়তা করে থাকে। এমতাবস্থায় বর্তমান গাজা পরিস্থিতিতে ইসরায়েলের ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা অত্যন্ত জরুরি। এ কারণে তুর্কি বিশেষজ্ঞ ও বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের একটি বড় অংশ জোর দিয়ে বলেছে যে, 'যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তুরস্ক থেকে ইসরায়েলে কৌশলগত পণ্য রপ্তানি বন্ধ করা প্রয়োজন।'

তুরস্কের রাজনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গাজা যুদ্ধে বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে ইসরাইলের হত্যাযজ্ঞ এবং হাসপাতালে হামলার ঘটনায় তুরস্ক সরকারের উচিত ছিল ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করা। ‌এমন পরিস্থিতিতে, এরদোগান সরকারের কর্মকর্তারা জনসমাবেশে এবং আন্তর্জাতিক ফোরামে কেন ইসরাইলের নিন্দা করছেন আবার একই সাথে ইসরাইলের সাথে সবরকম অর্থনৈতিক সম্পর্ক বজায় রেখেছেন তা স্পষ্ট নয়। এখন দেখার বিষয় ইসরাইলের ব্যাপারে তুরস্ক সরকারের এই নীতি বহির্ভূত আচরণ ও দ্বিমুখী নীতির উৎস কি?

এতে কোন সন্দেহ নেই যে, তুরস্ক সরকার যদি এখনই ইসরাইলের কাছে শিল্পপণ্য এবং ইস্পাত ও জ্বালানি রপ্তানি বন্ধে পদক্ষেপ না নেয় তাহলে বেসামরিক ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরাইলি হত্যাযজ্ঞ বন্ধের সুযোগ হারাবে। তুর্কি কর্মকর্তারা ইসরাইলের সাথে সম্পর্কের ব্যাপারে তুর্কি ও গাজার জনগণকে এক ধরনের মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে চলেছেন। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, তারা ফিলিস্তিনি জনগণের সাহায্যে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ তো নেয়নি বরং ইসরাইলের স্বার্থে কাজ করছে। প্রেসিডেন্ট এরদোগান ক্ষমতায় আসার পর তার প্রথম দিকের শাসনামলে ডাভোসে ইসরাইলের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট শিমন পেরেসের সঙ্গে এক বিতর্ক অনুষ্ঠানে গাজায় ইসরাইলি নৃশংসতার বিষয়ে কঠোর নিন্দাসূচক বক্তব্য রেখে মুসলিম বিশ্বে প্রশংসা অর্জনে সক্ষম হয়েছিলেন। এ সময় গাজার ওপর ইসরাইলি অবরোধ ভঙ্গের চেষ্টাকারী একটি নৌ-ত্রাণ বহরের একটি বোটের ওপর ইসরাইলি হামলার প্রেক্ষাপটে কয়েকজন তুর্কি মানবাধিকার কর্মী নিহত হওয়ায় তুরস্ক কিছুকাল ইসরাইলের সঙ্গে প্রকাশ্য কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থগিত রেখেছিল, যদিও তুরস্ক তখনও ইসরাইলের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক বজায় রেখেছিল বলে খবর এসেছে । 

পর্যবেক্ষকরা বলছেন, অর্থনৈতিক সংকটের কবলে পড়ে তুরস্কের জনগণ যখন হিমশিম খাচ্ছে তখন কেবল ইসরাইলের স্বার্থে আর্মেনিয়ার সাথে যুদ্ধে আজারবাইজানকে সমর্থন দেয়ায় আঙ্কারা সরকার দেশের ভেতরে তীব্র সমালোচনার সম্মুখীন। তাই ধারণা করা হচ্ছে, এরদোগান সরকার মার্কিন সরকারকে খুশী করতে ব্যস্ত।

বর্তমান পরিস্থিতিতে তুরস্ক সরকারের কর্মকর্তারা শুধু যে বৃহৎ শক্তিগুলোর মোকাবেলায় নিজেদের স্বাধীন নীতিকে বিসর্জন দিয়েছেন তাই নয় একই সাথে শিল্প, জ্বালানিসহ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ইসরাইলের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখে পাশ্চাত্যকে খুশী করে নিজের জন্য এমন একটা অবস্থান গড়ার চেষ্টা করছেন যাতে ইরাক ও সিরিয়ায় তুর্কি সামরিক উপস্থিতির পক্ষে জোরালো সমর্থন পাওয়া যায়। #

পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন/১৬ 

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ