আমাদেরকে খ্রিস্টান ও ইহুদিদের 'ভাই' সম্বোধন করতে শেখানো হয়েছে
-
ইরানের রাজধানী তেহরানে একটি গির্জা, একটি মসজিদ ও ইহুদিদের উপাসনালয়ের একটি চিত্র
ব্রাজিলে সাও পাওলো শহরে 'ইসলাম, ধর্ম, সংলাপ ও জীবন' বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই সম্মেলনে ইরানের বিশ্ব আহলে বাইত (আ.) পরিষদের প্রধান হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলেমিন রেজা রামেজানি উপস্থিত ছিলেন।
এই সম্মেলনে ব্রাজিলের বিচার মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি, এ দেশের কার্ডিনাল কনফেডারেশনের প্রতিনিধি, সাও পাওলোর কিছু পুরোহিত ও খ্রিস্টান ব্যক্তিত্ব, এই শহর ও সাও পাওলো রাজ্যের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং দক্ষিণ আমেরিকার একদল পণ্ডিত, বিশেষজ্ঞ, ধর্মপ্রচারক ও ধর্মীয় ব্যক্তিত্বরা উপস্থিত ছিলেন। বক্তারা ধর্ম ও সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে সংলাপের প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেন। একই সাথে তারা এই সম্মেলনে ইরানের প্রতিনিধি রেজা রামেজানির উপস্থিতিতে সন্তোষ প্রশংসা করেন।
ব্রাজিলের এই আন্তর্জাতিক সম্মেলনে আমরা ইসলাম ও শিয়া মাজহাবের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে ইরানের প্রতিনিধি রেজা রামেজানির দেয়া বক্তৃতার নির্বাচিত অংশ তুলে ধরব।
নিজেকে চিনুন
ইরানের বিশ্ব আহলে বাইত (আ.) পরিষদের প্রধান হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলেমিন রেজা রামেজানি তার বক্তৃতায় শিয়া মাজহাবের দৃষ্টিতে জ্ঞানের গুরুত্ব তুলে ধরতে গিয়ে বলেছেন, জ্ঞান হল সমস্ত ভালো ও কল্যাণমূলক কাজের ভিত্তি, এর বিপরীতে, মূর্খতা বা অজ্ঞতা হল সমস্ত মন্দ কর্মের ভিত্তি। মানুষ যদি নিজেকে সঠিকভাবে চিনতে পারে তবে সে তার সৃষ্টিকর্তাকেও চিনতে পারবে। জ্ঞান সম্পর্কে আহলে বাইতের প্রথম ইমাম হযরত আলী (আ.) বলেছেন, যদি একজন ব্যক্তি নিজেকে সঠিকভাবে চিনতে পারে তবে সে অন্যদেরকেও সঠিকভাবে চিনতে পারবে এবং এ ক্ষেত্রে তার জ্ঞান অন্যদের থেকে উত্তম হবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় অজ্ঞতার প্রথম ধাপ হল নিজের প্রতি অজ্ঞতা ও নিজেকে না চেনা। তাই যে নিজের সম্পর্কে অজ্ঞ থাকবে সে বিপথগামী ও পথভ্রষ্ট হবে। সুতরাং একজন ব্যক্তি নিজে পথভ্রষ্ট হলে সে অন্যকেও পথভ্রষ্ট করবে এবং অন্যদের চেয়ে আরো বেশি অজ্ঞ হবে। তাই আমাদের সবারই দায়িত্ব নিজেকে চেনা। অ্যারিস্টটলও বলেছেন, নিজেকে জানুন, আত্ম-জ্ঞান মানুষের বিকাশের চাবিকাঠি যা কিনা একজন ব্যক্তিকে সমস্ত মানুষের জন্য অনুভব করার চেতনা জাগ্রত করে।
ন্যায়বিচারের কণ্ঠস্বর হযরত আলী (আ.)
ইরানের বিশ্ব আহলে বাইত (আ.) পরিষদের প্রধান হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলেমিন রেজা রামেজানি তার বক্তৃতায় আরো বলেছেন, হজরত আমীরুল মুমিনীন (আ.) সকল মুসলমানের কাছে গ্রহণযোগ্য। শিয়া আলেমরা তাকে ইমাম বলে মনে করেন এবং সুন্নি আলেমরা হযরত আমীরুল মুমিনীন (আ.)-কে চতুর্থ খলিফা হিসেবে মেনে নিয়েছেন। হযরত আলী (আ.)এর অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য ছিল 'ন্যায়বিচার'। বিখ্যাত লেবানিজ খ্রিস্টান লেখক জর্জ জার্দাক যিনি আমিরুল মুমিনিন (আ.) সম্পর্কে একটি খুব ভাল বই লিখেছেন। পাঁচ খণ্ডের এ বইটির নাম হচ্ছে, 'সুত আল-আদালেহ' এবং এই বইটির সারসংক্ষেপও আবার আলাদা এক খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। আমি এই বইটিকে স্প্যানিশ এবং পর্তুগিজ ভাষায় অনুবাদ করার পরামর্শ দিচ্ছি। জর্জ জার্দাক হজরত আমীরুল মুমিনীন (আ.)-এর প্রেমে একধরনের আত্মহারা।

সংলাপের মানসিকতা থাকা উচিত
হযরত আলী (আ.) বলেছেন, মানুষের মধ্যে দুটি শ্রেণী রয়েছে। একদল ধার্মিক ভাই হতে পারেন এবং আরেক দল জন্মগতভাবে আপনার মতই। আলী (আ.) আমাদেরকে এটা শিখিয়েছেন যে, খ্রিস্টান বা ইহুদিদেরকে আমরা খ্রিস্টান বা ইহুদি ভাই বলতে পারি। হযরত আলী যারা মুসা নবী কিংবা ঈসা নবীর অনুসারী তাদের সাথে সংলাপে বসতেন এবং নিজের তথা ইসলামের অকাট্ট যুক্তি তাদের সামনে তুলে ধরতেন।
আরেক জায়গায় আল্লাহ তাআলা রাসুল (সা.) কে বললেন, আপনার যুক্তি দিয়ে তাদের সথে কথা বলুন। এমনকি যে কিছুই বিশ্বাস করে না তার সাথেও কথা বলুন। যদি তারা আপনার যুক্তি না বোঝে এবং আপনার যুক্তিকে গ্রহণ না করে এবং আপনাকে একেবারেই গ্রহণ না করে, তাহলে তারা আপনাকে যা বলে সে সম্পর্কে আপনি ধৈর্য ধরুন। আপনি যদি তাদের ছেড়ে যেতে চান তবে উত্তম হচ্ছে তাদের থেকে ভালোভাবে দূরত্ব বজায়রাখা।
নবীর আহলে বাইতগণ ছিলেন সংলাপের শিরোমণি
ইরানের বিশ্ব আহলে বাইত (আ.) পরিষদের প্রধান হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলেমিন রেজা রামেজানি তার বক্তৃতায় আরো বলেছেন,
আমাদের ইমামগণ এবং ধর্মীয় নেতারা যেমন ইমাম সাদিক (আ.) এবং ইমাম রেজা (আ.) উনারা খ্রিস্টান ও জরথুস্ট্রিয়ানসহ সকলের সাথে কথা বলতেন। তাই আমাদেরও উচিত একে অপরের সাথে কথা বলা, একে অপরকে বোঝা এবং পরস্পরকে সম্মান করা। ইসলাম একটি শান্তির ধর্ম যাকে আরবিতে বলা হয় আল-'তাআলেশ আল-সালামি'। মানব সমাজকে অবশ্যই একে অপরের পাশে থাকতে হবে। ইসলাম পরস্পরের সাথে যোগাযোগ ও সংযোগ বাড়ানো পরামর্শ দেয়। হোক তা নিজের সাথে যোগাযোগ, অন্যদের সাথে যোগাযোগ, সৃষ্টিকর্তার সাথে যোগাযোগ কিংবা প্রকৃতির সাথে যোগাযোগ। ইসলাম প্রকৃতিকে ধ্বংস না করার এবং দূষিত না করার জোর দেয়। ইসলাম যেখানে প্রকৃতির ব্যাপারে এতসব উপদেশ দিচ্ছে সেখানে মানুষ কিংবা পশু অধিকারের বিষয়ে ইসলামের বক্তব্য তো বলারই অপেক্ষা রাখে না।
শত্রু অঞ্চলের গাছগাছালি কাটবনে না
ইরানের বিশ্ব আহলে বাইত (আ.) পরিষদের প্রধান হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলেমিন রেজা রামেজানি তার বক্তৃতায় আরো বলেছেন, আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ দলিল রয়েছে যা ১২৫০ বছর আগে, ইমাম সাজ্জাদের তার আইন সম্পর্কিত গ্রন্থে ৫০ টিরও বেশি অধিকার নিয়ে লিখেছিল। প্রকৃতি সম্বন্ধে আহলে বাইতের ইমামদের একটি খুব সুন্দর বর্ণনা রয়েছে, যার প্রতিপাদ্য হচ্ছে, শত্রুর সাথে কখনো যুদ্ধ হলে শত্রুর জমির গাছ কাটবেন না বা পুড়িয়ে দেবেন না। কেননা এগুলোই পরিবেশ, পানযোগ্য পানিকে দূষিত করবেন না। কুরআন ও হাদিস উভয় ক্ষেত্রেই পরিবেশ সংরক্ষণ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।#
পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন/১৪
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।