হযরত ঈসা মাসিহ (আ.)-এর শানে পবিত্র কুরআনে কি কি বলা হয়েছে?
পার্সটুডে- পবিত্র কুরআনে হযরত ঈসা (আ.)কে বিভিন্ন বিশেষণে ভূষিত করা হয়েছে। এসব বিশেষণের কিছু ছিল আল্লাহ প্রদত্ত এবং কিছু তিনি নিজের প্রচেষ্টায় অর্জন করেছিলেন।
মহান আল্লাহ যে চারজন নবীর প্রতি পূর্ণাঙ্গ কিতাব ও শরিয়ত নাজিল করেছেন তাদের একজন হলেন হযরত ঈসা ইবনে মারিয়াম (আ.) যিনি মাসিহ নামেও সমধিক পরিচিত। তাঁর প্রতি নাজিলকৃত কিতাবের নাম ইঞ্জিল। তিনি ছিলেন মারিয়াম সালামুল্লাহি আলাইহার সন্তান। পিতা ছাড়াই তাঁর জন্ম ছিল মানব ইতিহাসের একটি বিরল ও বিস্ময়কর ঘটনা যার বর্ণনা পবিত্র কুরআনে বিস্তারিতভাবে এসেছে।
হযরত ঈসার অনুসারী দাবিদার খ্রিস্টানরা বিশ্বাস করে, আল্লাহর এই মহান নবীকে ক্রুশবিদ্ধ করে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, হযরত ঈসাকে ক্রুশবিদ্ধ করা সম্ভব হয়নি বরং তাঁর আকৃতিধারী অন্য এক ব্যক্তিকে ক্রুশে বিদ্ধ করে হত্যা করা হয়েছে এবং মহান আল্লাহ হযরত ঈসাকে ঊর্ধ্বকাশে নিজের কাছে তুলে নিয়ে গেছেন। পার্সটুডের এই নিবন্ধে পবিত্র কুরআনে এই আল্লাহ তায়ালার এই রাসূল সম্পর্কে যেসব বর্ণনা এসেছে সে সম্পর্কে খানিকটা আলোকপাতের চেষ্টা করা হয়েছে:
হযরত মাসিহ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের আয়াতসমূহ:
১- “...আমি মারইয়াম তনয় ঈসাকে নিদর্শনসমূহ প্রদান করেছি এবং রুহুল কুদুস দ্বারা (পবিত্র আত্মাযোগে) তার শক্তি বৃদ্ধি করেছি।” (বাকারা: আয়াত ৭)
২- “স্মরণ করুন, যখন ফেরেশতাগণ বললেন, হে মারইয়াম! নিশ্চয়ই আল্লাহ আপনাকে তার পক্ষ থেকে একটি কালেমার সুসংবাদ দিচ্ছেন। তার নাম মসীহ, মারইয়াম তনয় ঈসা, তিনি দুনিয়া ও আখেরাতে সম্মানিত এবং সান্নিধ্যপ্রাপ্তগণের অন্যতম হবেন।” (আলে ইমরান: আয়াত ৪৫)
৩- “...আর আমি তাকে এজন্য সৃষ্টি করব যেন সে হয় মানুষের জন্য এক নিদর্শন ও আমাদের কাছ থেকে এক অনুগ্রহ; এটা তো এক স্থিরীকৃত ব্যাপার।” (সূরা মারিয়াম: আয়াত ২১)
৪- “আর তিনি দোলনায় ও বয়োঃপ্রাপ্ত অবস্থায় মানুষের সাথে কথা বলবেন এবং তিনি হবেন পূণ্যবানদের একজন।” (সূরা আলে ইমরান: আয়াত ৪৬)
৫- “আর তিনি তাকে শিক্ষা দেবেন কিতাব, হিকমত, তাওরাত ও ইঞ্জিল।” (সূরা আলে ইমরান: আয়াত ৪৮)
৬- “আর তিনি বানী ইসরাঈলের নিকট আমার পক্ষ থেকে প্রেরিত রাসূল। ...” (সূরা আলে ইমরান: আয়াত ৪৯)
৭- “আর (আমি এসেছি) আমার পূর্বে (অবতীর্ণ) তওরাতের সত্যায়নকারীরূপে...।”
৮- “...মারইয়াম-তনয় ঈসা মসীহ কেবল আল্লাহ্র রাসূল এবং তার বাণী, যা তিনি মারইয়ামের কাছে পাঠিয়েছিলেন ও তার পক্ষ থেকে রুহ।...” (সূরা নিসা: আয়াত ১৭১)
৯- “আর যাকারিয়্যা (আলাইহিস সালাম), ইয়াহয়া (আলাইহিস সালাম) ও ঈসা (আলাইহিস সালাম) এবং ইলইয়াস (আলাইহিস সালাম)কেও (হিদায়াত দিয়েছিলাম)। এরা প্রত্যেকেই সৎকর্মপরায়ণ ছিলেন।” (সূরা আনআম: আয়াত ৮৫)
১০- “...আর এই নবীদেরকে (যাদের মধ্যে ঈসাও অন্তর্ভুক্ত) আমি বাছাই করেছি এবং তাদেরকে সরল পথের দিকে পরিচালিত করেছি।” (সূরা আনআম: আয়াত ৮৭)
১১- “সে (জিব্রাইল) বলল, আমি তো তোমার রব-এর দূত, তোমাকে এক পবিত্র পুত্র দান করার জন্য।” (সূরা মারিয়াম: আয়াত ১৯)
১২- “ঈসা (নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে) বললেন, আমি তো আল্লাহর বান্দা। তিনি আমাকে কিতাব দিয়েছেন, আমাকে নবী করেছেন।” (সূরা মারিয়াম: আয়াত ৩০)
১৩- হযরত ঈসা (আ.) এর বর্ণনায় পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে: “আর যেখানেই আমি থাকি না কেন তিনি আমাকে বরকতময় করেছেন এবং যতদিন আমি জীবিত থাকি তিনি আমাকে সালাত ও যাকাত আদায় করতে আদেশ করেছেন।” (সূরা মারিয়াম: আয়াত ৩১)
১৪- হযরত ঈসা (আ.) এর বর্ণনায় পবিত্র কুরআনে আরো বলা হয়েছে: “আর আল্লাহ আমাকে আমার মায়ের প্রতি অনুগত করেছেন এবং তিনি আমাকে করেননি উদ্ধত, হতভাগ্য।” (সূরা মারিয়াম: আয়াত ৩২)
১৫- “তিনি তোমাদের জন্য নির্ধারিত করেছেন ধর্ম; যার নির্দেশ দিয়েছিলেন নূহকে এবং যা আমি প্রত্যাদেশ করেছি তোমাকে এবং যার নির্দেশ দিয়েছিলাম ইব্রাহীম, মূসা ও ঈসাকে এই বলে যে, তোমরা ধর্মকে প্রতিষ্ঠিত কর এবং ওতে মতভেদ করো না।...”
এসব আয়াত বিশ্লেষণ করলে মহান আল্লাহর দরবারে হযরত মাসিহ (আ.) এর উন্নত মর্যাদার বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এবার পবিত্র কুরআনে বর্ণিত এই মহামানবের কিছু বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করা যাক।
আল্লাহর কালাম
পবিত্র কুরআনের দু’টি স্থানে হযরত মাসিহকে কালামাতুল্লাহ বা আল্লাহর কালাম বলে অভিহিত করা হয়েছে। এখানে কালামের শাব্দিক অর্থ প্রযোজ্য নয় অর্থাৎ মুখ থেকে নিঃসৃত বাণীর কথা বলা হয়নি বরং হযরত মাসিহ (আ.) এর শারীরিক অস্তিত্ব বোঝানো হয়েছে। যদিও সৃষ্টিজগতের সবকিছুই আল্লাহর কালাম কিন্তু তাঁকে যেহেতু অলৌকিকভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে তাই তার ক্ষেত্রে বিশেষভাবে কালাম শব্দটি প্রয়োগ করা হয়েছে।
মাসিহ ও ঈসা ইবনে মারিয়া
পবিত্র কুরআনের আয়াতে আল্লাহর এই রাসূলের ক্ষেত্রে দু’টি নামই ব্যবহৃত হয়েছে। হযরত ঈসা (আ.) কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের শরীরে মাসেহ করলে বা হাত বুলিয়ে দিলে এই রোগে আক্রান্ত রোগীরা সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যেত বলে তাঁকে মাসিহ নামে অভিহিত করা হয়। হযরত ঈসা (আ.) এর যুগে বড় বড় চিকিৎসকরা অন্য সব রোগের চিকিৎসা করতে সক্ষম হলেও কুষ্ঠরোগীদের চিকিৎসা করতেই সক্ষম ছিলেন না। আর সেই দুরারোগ্য ব্যাধি হযরত ঈসা মাসিহর হাতের স্পর্শে নিরাময় হয়ে যেত।
আল্লাহর নিদর্শন
হযরত মাসিহ (আ.) এর সৃষ্টি ছিল হযরত ইয়াহিয়া (আ.) এর মতোই অলৌকিক। হযরত ইয়াহিয়া (আ.) এর জন্ম হয়েছিল আল্লাহর আরেক নবী হযরত জাকারিয়া (আ.) এর ঔরষে। তবে হযরত জাকারিয়ার স্ত্রী ছিলেন বন্ধ্যা এবং বৃদ্ধ। সেই অবস্থায় আল্লাহর নির্দেশে হযরত ইয়াহিয়ার জন্ম হয়েছিল। পক্ষান্তরে হযরত ঈসার জন্ম ছিল আরো বেশি অলৌকিক। তাঁকে আল্লাহ তায়ালা পিতা ছাড়াই সৃষ্টি করেন। এ কারণে হযরত ঈসাকে আয়াতুল্লাহ বা আল্লাহর নিদর্শন বলে অভিহিত করা হয়।
দোলনায় বসে কথা বলা
আল্লাহর নিদর্শন হওয়ার অন্যতম কারণ ছিল দোলনায় বসে কথা বলা। হযরত ঈসা (আ.) দোলনায় বসে মায়ের সতীত্বের সাক্ষ্য দিয়েছিলেন। পবিত্র কুরআনে যেমনটি বলা হয়েছে: “আর তিনি দোলনায় ও বয়োঃপ্রাপ্ত অবস্থায় মানুষের সাথে কথা বলবেন।”
কিতাব ও শরিয়তের অধিকারী
হযরত ঈসা (আ.) মহান আল্লাহর কাছে এতটা মর্যাদার অধিকারী হয়েছিলেন যে, তিনি কিতাব ও শরিয়ত প্রাপ্ত হয়েছিলেন। এমনকি তাঁকে আল্লাহ তায়ালা তাওরাত এবং হিকমতও (প্রজ্ঞা) শিক্ষা দিয়েছিলেন।
বনি ইসরাইলের কাছে প্রেরিত রাসূল
হযরত ঈসা (আ.) এর রিসালাত শুধু বনি ইসরাইলের মধ্যে সীমিত ছিল নাকি এর বাইরেও বিস্তৃত ছিল সেটি একটি স্বতন্ত্র আলোচনার বিষয়। সেটি আজকের নিবন্ধের বিষয় নয়। তবে কুরআনের আয়াতে বোঝা যায়, তাকে বনি ইসরাইলের কাছে পাঠানো হয়েছিল। আয়াতে বলা হয়েছে: “তিনি ছিলেন বনি ইসরাইলের একজন রাসূল।”
এছাড়া নিজ জাতির কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে তিনি যে আল্লাহর দরবারে সাক্ষী দেবেন সেকথাও পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে। মহান আল্লাহ তাঁর কালামে পাকে বলেছেন: “আর কেয়ামতের দিন সে তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষী হবে।”#
পার্সটুডে/এমএমআই/২৬
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।