ইসলামের ইতিহাসের অনন্য-বিস্ময়কর রাজনৈতিক-সামাজিক চিঠি
(last modified Tue, 02 Apr 2024 14:46:57 GMT )
এপ্রিল ০২, ২০২৪ ২০:৪৬ Asia/Dhaka
  • ইসলামের ইতিহাসের অনন্য-বিস্ময়কর রাজনৈতিক-সামাজিক চিঠি

আমিরুল মু'মিনিন হযরত আলী (আ) মালিক আশতারকে মিশরের গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেয়ার পর তাঁর কাছে নেতৃস্থানীয় রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তার অঙ্গীকার ও দায়িত্ব বিষয়ক একটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন।

এই চিঠিতে তিনি ইসলামী রাষ্ট্রীয় শাসন ও ইসলামী শাসকের নানা বৈশিষ্ট্য, নাগরিকদের অধিকার এবং নাগরিকদের সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক বিষয়ে আলোচনা করেছেন।

 হযরত আলীর সংক্ষিপ্ত জীবনী

আমিরুল মু'মিনিন হযরত আলী ইবনে আবি তালিব (আ) ছিলেন মহানবীর (সা) পবিত্র আহলে বাইতের সদস্য এবং বিশিষ্ট সাহাবি ও মহানবীর হাদিসের বর্ণনাকারী। এ ছাড়াও তিনি ছিলেন মহানবীর (সা) চাচাতো ভাই ও মেয়ের জামাই। সুন্নি মুসলমানদের দৃষ্টিতে তিনি ছিলেন খোলাফায়ে রাশিদিনের চতুর্থ খলিফা। শিয়া ও সুন্নি ঐতিহাসিক এবং অনেক সুন্নি আলেমের বর্ণনা অনুযায়ী হযরত আলীর জন্ম হয়েছিল পবিত্র কাবা ঘরে। তিনি মহানবীর (সা) প্রতি সর্বপ্রথম ইমান এনেছিলেন। মহানবী (সা) বলেছিলেন, আমি জ্ঞানের নগর আর আলী তার দরজা।

শিয়া মুসলমানদের দৃষ্টিতে তিনি তাদের প্রথম ইমাম তথা মহানবীর (সা) প্রথম উত্তরসূরি ও স্থলাভিষিক্ত। পবিত্র কুরআনের আয়াতে তাঁর নিষ্পাপ হওয়া ও সব ধরনের অপবিত্রতা থেকে মুক্ত হওয়ার প্রমাণ রয়েছে।শিয়া ও সুন্নি মাজহাবের নানা তথ্য-সূত্রের আলোকে পবিত্র কুরআনের প্রায় ৩০০ আয়াত এই মহামানবের গুণ বা প্রশংসা হিসেবে নাজিল হয়েছে। তিনি ছিলেন মহানবীর কন্যা খাতুনে জান্নাত তথা বেহেশতি নারীদের নেত্রী হযরত ফাতিমা সালামুল্লাহ আলাইহিমার স্বামী, বেহেশতি যুবকদের সর্দার ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইন (আ)'র পিতা।  হযরত আলী (আ) শিয়া মুসলমানদের ১১ জন পবিত্র ইমামের পূর্বপুরুষ।

তিনি ৪০ হিজরির ১৯ রমজানের ভোর বেলায় কুফার মসজিদে উগ্র বিপথগামী গোষ্ঠী খারিজি সম্প্রদায়ের একজন সদস্যের তরবারির আঘাতের শিকার হন। মাথায় ওই আঘাতের পর সেই রমজানেরই ২১ তারিখে তিনি শাহাদাত বরণ করেন।

নাহজুল বালাগ্বা নামক বই

আমিরুল মু'মিনিন হযরত আলীর নির্বাচিত নানা ভাষণ, চিঠি-পত্র ও বক্তব্যের সংকলন হল নাহজুল বালাগ্বা। হিজরি চতুর্থ শতকের শেষের দিকে এসব সংগ্রহ করে বইটি সংকলন করেছিলেন সাইয়্যেদ রাজি (র)। এ বইটি উচ্চমানের বিষয়বস্তু, ভাব ও অলংকারিক ভাষা ও বাগ্মিতাশৈলির কারণে অন্যতম সেরা ইসলামী বই হিসেবে খ্যাত।

মালিক আশতারের কাছে হযরত আলীর (আ.) চিঠি তাঁর লেখা বিখ্যাত পত্রগুলোর অন্যতম। মালিক আশতার নাখ্‌য়ি গভর্নরের দায়িত্ব পালন শুরুর প্রাক্কালেই মুয়াবিয়ার এক ইহুদি অনুচরের ষড়যন্ত্রে বিষ-প্রয়োগের মাধ্যমে শাহাদাত বরণ করেছিলেন।  এই চিঠিতে যেসব নীতি বা অঙ্গীকারের কথা এসেছে সেসবের প্রতিটি শব্দ পাঠকের জন্য, বিশেষ করে ন্যায়নিষ্ঠ রাজনীতিবিদ ও যে কোনো ক্ষেত্রের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের জন্য  জ্ঞান-বিজ্ঞানের মূল্যবান খনি বা চাবি হিসেবে বিবেচিত হয়।ওই পত্রের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ অংশের সারাংশ বা ভাবার্থ এখানে তুলে ধরা হল।

প্রথম অংশ: শাসকদের প্রতি হযরত আলীর কয়েকটি নৈতিক উপদেশ

১. একজন ইসলামী প্রশাসক বা শাসন-কর্মকর্তাকে হতে হবে জনগণের প্রতি দয়ালু, স্নেহশীল ও সহৃদয় এবং তিনি যেন রক্ত-পিয়াসু পশুদের মত না হন যারা জনগণের রক্তপান করাকে যুদ্ধ-লব্ধ সম্পদ বলে মনে করেন। অন্য কথায় তাদেরকে অবশ্যই পছন্দ এবং অপছন্দের ব্যাপারে অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হবে। তাদের মনে জনগণের প্রতি ভালোবাসা, দয়া ও সহৃদয়তা লালন করতে হবে। হিংস্র পশুর মতো জনগণকে নির্যাতন ও নিষ্পেষণ করার নেশা যেন তাদেরকে পেয়ে না বসে। 

২. জনগণের মধ্যে দু’ধরনের লোক রয়েছে, এক হচ্ছে যারা মুসলমান হিসেবে  ইসলামী শাসকদের ঈমানী ভাই এবং অন্যরা হচ্ছে অন্য ধর্মে বিশ্বাসী, কিন্তু তারাও শাসকদের মতোই মানুষ। আর সব মানুষই সাধারণ মানবীয় অক্ষমতা ও দুর্বলতার শিকার। জেনে কিংবা না জেনে তারা অপরাধ করে থাকে এবং তাদের কাজের পরিণতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ অচেতন হয়ে তারা পাপ কাজে লিপ্ত হয়।

অন্য কথায় এটি অত্যন্ত স্বাভাবিক যে, মানুষের মধ্যে দোষ-ত্রুটি ও দুর্বলতা থাকবে। মানুষ ভুলের ঊর্ধ্বে নয়। এসবকে ক্ষমা করে দেয়ার অধিকার একজন শাসকের চেয়ে আর কার বেশি থাকতে পারে?সবাই যে রকম আল্লাহর দয়া ও সহানুভূতি আশা কর তেমনি মানুষের প্রতিও শাসকদের দয়ার্দ্র ও সহানুভূতিশীল হওয়া উচিত। অপরের দুর্বলতা জনসমক্ষে ফাঁস না করে দেবার চেষ্টা করে যেসব ত্রুটি ও ব্যর্থতা শাসকের নজরে আসে সেগুলোর ব্যাপারে তার দায়িত্ব হচ্ছে কী করে সেগুলো সংশোধন করতে হয় সে ব্যাপারে মানুষকে শিক্ষা দেয়া।

৩. ইসলামী শাসককে অবশ্যই প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের মনোভাব জনগণের মনের গভীর থেকে বের করে আনতে হবে। তাকে অবশ্যই জনগণ সম্পর্কে সুধারণা পোষণ করতে হবে। কারণ জনগণের প্রতি সুধারণা দীর্ঘদিনের দুর্ভোগ দূর করে। তিনি যেন মানুষের মধ্যে হিংসা ও শত্রুতার কারণ না হন। তিনি গুরুত্বহীন বিষয়কে উপেক্ষা করবেন। তার অনুগ্রহ বণ্টন ও আস্থা স্থাপন যেন মানুষের মধ্যে বিরূপ মনোভাবের সৃষ্টি না করে। প্রত্যেকের ব্যাপারেই সৎ ও নিরপেক্ষ হতে হবে তাঁকে। তাঁর ব্যক্তিত্ব, মর্যাদা ও অনুগ্রহ যেন হিংসা ও বিদ্বেষ উদ্রেককারী উৎস না হয়ে ওঠে। যে ব্যক্তি শাসকের নৈকট্য ও আনুকূল্য পাবার যোগ্য নয় সে যেন তাঁর কাছে আসতে না পারে। তাতে কখনও তাঁর সম্মান ও মর্যাদা নিচু হবে না।

৪. মুসলিম শাসক বা প্রশাসকদেরকে ছিদ্রান্বেষী হওয়া তথা মানুষের দোষ-ত্রুটি খুঁজে বেড়ানোর অভ্যাস থেকে দূরে তো থাকতে হবেই, একইসঙ্গে তাদের উচিত মানুষের দোষ-ত্রুটি ঢেকে রাখা।

৫.  যারা একজনের স্পর্শকাতর কথা আরেক জনের কাছে ফাঁস করে বা এখানের কথা ওখানে লাগিয়ে মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে তাদেরকে কখনও সত্যায়ন করা উচিত নয় কোনো শাসক বা প্রশাসকের তা তারা যত শুভাকাঙ্ক্ষী হওয়ারই ভান করুক না কেন।

একজন নিন্দুক অত্যন্ত হীন প্রকৃতির ও বিকৃত মানসিকতাসম্পন্ন লোক, যদিও সে শুভাকাঙ্ক্ষী ও একনিষ্ঠ উপদেষ্টা হিসেবে নিজেকে দেখাতে চায়, আসলে সে কিন্তু অত্যন্ত নীচ ও শঠ। তাদের উপদেশ গ্রহণ করার আগে ধীরে সুস্থে ভেবে নিতে হবে।

৬. ইসলামী শাসক আল্লাহর কাছে যে অঙ্গীকারে আবদ্ধ সে ক্ষেত্রে সফল হবে না যদি না আল্লাহর সাহায্য চান ও ন্যায় বা সত্যের প্রতি নিজের মনকে শ্রদ্ধাশীল না করে।

৭. ইসলামী শাসকের কখনও কাউকে ক্ষমা করার কারণে অনুশোচনা করা উচিত নয় এবং কাউকে শাস্তি দিয়ে খুশি হওয়াও উচিত নয়।

৮. ইসলামী শাসকের উচিত তার দিন ও রাতের কিছু সেরা সময় আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে ব্যয় করা এবং উচ্চতর একনিষ্ঠতা অর্জনের জন্য ফরজ ইবাদতের পাশাপাশি অন্যান্য আমলগুলোও ক্ষুদ্রতম ত্রুটি ছাড়াই সম্পন্ন করা।

৯. ইসলামী শাসকের উচিত ওয়াদা পালনে বিশ্বস্ত থাকা ও ওয়াদার খেলাপ না করা।

১০. ইসলামী শাসকের উচিত প্রতাপের মন্দ ধারণা ও কঠোরতা এবং হাত ও মুখের কঠোরতাকে দমিয়ে রাখা এবং ইচ্ছাকৃত হত্যাকাণ্ড এড়িয়ে চলা।

দ্বিতীয় অংশ: শাসকদের প্রতি হযরত আলীর কয়েকটি সামাজিক উপদেশ

 ১. একজন ইসলামী শাসকের কাছে সবচেয়ে প্রিয় বিষয় হওয়া উচিত সর্বাধিক সত্যনিষ্ঠতা, ন্যায়বিচারে সর্বাত্মককামিতা ও সকল ক্ষেত্রে জনগণের সন্তুষ্টি অর্জন।

২. ইসলামী শাসকের কাছে সবচেয়ে অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্য সেইসব মানুষ যারা সবচেয়ে তিক্ত অবস্থায়ও সত্য ও ন্যায়কে অন্যদের তুলনায় বেশি স্পষ্টভাবে তুলে ধরে।

৩. সমাজের যেসব ব্যক্তির পাপাচার ও নোংরা বিষয় গোপন রয়েছে শাসকের কাছে এবং সেসব প্রকাশ পায়নি তার কাছে সেসব ব্যাপারে তাঁর উদাসীন থাকা উচিত।

৪. জনগণের যেসব অভাব-অভিযোগের তথ্য যেদিন ইসলামী শাসকের কানে পৌঁছে সেই দিনই সেসবের সমাধান করা তাঁর কর্তব্য এবং প্রতিদিনের কাজ সেই দিনই শেষ করা উচিত। কারণ প্রতিটি দিনের বা সময়ের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে।

৫. ইসলামী শাসকের উচিত নয় জনগণ থেকে দূরে থাকা। কারণ জনগণের মধ্যে তার অনুপস্থিতির ফলে নানা বিষয়ে তিনি কম জানতে পারবেন।

৬. ইসলামী শাসকের কর্তব্য হল নিজের আত্মীয়-স্বজন ও নিকটজন (নিজের পরিবারসহ) বা নিজ গোষ্ঠীর লোকদেরকে অগ্রাধিকার না দেয়া।

৭. সমাজের জনগণের কল্যাণে কাজ করার কারণে ইসলামী শাসকের উচিত নয় সে বিষয়ে খোঁটা দেয়া ও সেসবের উল্লেখ করা বা জাহির করা।

তৃতীয় অংশ: শাসকদের প্রতি হযরত আলীর কয়েকটি রাজনৈতিক উপদেশ

১. ইসলামী শাসকের কখনও উচিত নয় কৃপণ, ভীরু ও লোভী ব্যক্তির কাছ থেকে উপদেশ নেয়া। কারণ কৃপণতা, ভীরুতা ও লোভ হচ্ছে এমন সব প্রবৃত্তি যেসব আল্লাহর প্রতি মন্দ ধারণা থেকে উৎসারিত।

২. ইসলামী শাসকের কাছে কখনও সৎকর্মশীল ব্যক্তি ও অসৎ কাজে অভ্যস্ত ব্যক্তি সমান হওয়া উচিত নয়। কারণ এতে সৎকর্মশীল ব্যক্তিরা ভালো কাজ করা সত্ত্বেও এইসব ভালো কাজের জন্য হেয় বিবেচিত হবেন ও মন্দ কাজে অভ্যস্তরা তাদের মন্দ কাজের ব্যাপারে উৎসাহ বোধ করবে।

 ৩. কোনো ইসলামী শাসকের উচিত নয় সেইসব প্রথা ভেঙ্গে ফেলা চিন্তাবিদরা সমাজের কল্যাণের জন্য যেগুলো কার্যকর করেছিলেন এবং সেইসব প্রথা বা রীতির কারণে সমাজের জনগণের মধ্যে যৌক্তিক সমন্বয় বা সংহতি সৃষ্টি হয়েছিল। এমন কোনো প্রথা চালু করা উচিত নয় যা জনগণের মধ্যে প্রচলিত ভালো প্রথা বা রীতিগুলোকে ধ্বংস করে দেয়।  

৪. শাসকের বিরুদ্ধে জনগণের পক্ষ থেকে যেকোনো জুলুম ও রহস্যজনক পাঁয়তারা চালানোর অভিযোগ তোলা হলে তাঁর উচিত তাঁদের সন্দেহ দূর করা; জুলুম ও বলদর্পিতার সন্দেহ সম্পর্কে জনগণের কাছে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করা ও ব্যাখ্যা তুলে ধরা উচিত যাতে অন্যায্য সন্দেহগুলো দূর হয়ে যায়।

৫. উপযুক্ত সময় হওয়ার আগেই শাসকের উচিত নয় কোনো বিষয়ে তাড়াহুড়া করা।

৬. কোনো বিষয়ে অস্পষ্টতা দেখা দিলে সে বিষয়ে সত্য তুলে ধরা উচিত শাসকের এবং ওই বাস্তবতা মেনে নেয়ার ব্যাপারে তাঁর গোঁয়ার্তুমি করা উচিত নয়।

৭. শাসকের উচিত নয় যেসব বিষয়ে জনগণের সবারই সমান অধিকার রয়েছে সেখানে নিজেকে অগ্রগণ্য করা। অর্থাৎ জীবন বা প্রাণ রক্ষা, সম্মান, স্বাধীনতা ও এ জাতীয় অন্যান্য বিষয়ে নিজেকে অন্যদের তুলনায় বিশেষ গুরুত্বের অধিকারী ভাবতে পারবেন না শাসক। তিনি যেন জনগণের রুটি-রুজি বা জীবন-উপকরণ, মানবীয় সম্মান ও মর্যাদার অধিকার লঙ্ঘন না করেন।

৮. যেসব বিষয়ে শাসক দায়িত্বশীল ও মানুষের চোখ যেসব দেখতে পায় সেসব বিষয়ে তিনি যেন উদাসীন না হন ও না বোঝার ভান না করেন।#

পার্সটুডে/এমএএইচ/০২

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।