রমজান : রহমতের বসন্ত (পর্ব-২৬)
আশা করছি এ আলোচনা আমাদের হৃদয়ে যোগাবে উন্নত চরিত্র গঠনের প্রবল উদ্যম ও প্রাণশক্তি। হে সর্বোচ্চ দয়াময়! মহানবী (সা) ও তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের প্রতি দরুদ পাঠানোর উসিলায় এই রমযান যেন আমাদের জন্য হয়ে ওঠে অতি উন্নত ও মহৎ স্বভাব-চরিত্র গঠনের এবং আল্লাহর প্রিয়পাত্র হওয়ার মোক্ষম মাধ্যম।
পবিত্র রমজান আত্মগঠন ও আত্ম-সংশোধনের বসন্ত। উন্নত নৈতিক চরিত্রগুলোর চর্চা বেশি দেখা যায় রমজান মাসে। এই মাসে মুমিন মুসলমানরা পরস্পরের প্রতি বেশি আন্তরিক, দয়াদ্র ও ক্ষমাশীল হয়। রমজান মাসে অফিসের ধার্মিক বড় কর্তা বা কারখানার মালিক শ্রমিকদের বেশি কাজ দেননা, অন্যদিকে ভাতা ও বোনাস বাড়িয়ে দেন। এ মাসে মুসলমানরা দরিদ্রদের বেশি সহায়তা করে, মৃতদের কথা স্মরণ করে গরীব ও হত-দরিদ্রদের খাবার বা অর্থ দেন। নারীদের অনেকেই পর্দার ব্যাপারে সচেতন হন এই মাসে। কিন্তু রমজানের শিক্ষা হল সারা বছর ও সারা জীবনের জন্যই এ ধরনের মহতী গুণগুলো ধরে রাখতে হবে। আসলে আমাদের নামাজ, রোজা ও অন্য ইবাদতগুলোর উদ্দেশ্যই হল ভালো মানুষ হওয়া তথা প্রকৃত মানুষ হওয়া। জীবনের সবক্ষেত্রে মানুষের মত মানুষ হওয়ারই প্রশিক্ষণ দেয় ইবাদত।
উন্নত ইসলামী চরিত্রের মূল কথা হল নিজেকে ভুলে যাওয়া ও নিজের সুযোগ, সুবিধা, ও ভোগ বিলাসকে ত্যাগ করা। ঠিক যেভাবে শারীরিক সুস্থতার জন্য বেশি-খাওয়া ও ভোগ বিলাস ছাড়তে হয়, ঠিক একইভাবে স্বার্থপরতা, আত্মকেন্দ্রীকতা ও আমিত্ব- ছাড়া উচিত। সামাজিক ও অন্য সব ক্ষেত্রে ন্যায়বিচারকামী হতে অন্যের অধিকার মেনে চলুন। এসব কথা বলা সহজ হলেও বাস্তবে তা অনেক কঠিন ও বড় পরীক্ষা হয়ে দেখা দেয়। কারণ মানুষ নৈতিকতা, সত্য ও ন্যায়ের অনুসরণ করতে গিয়ে দেখে যে, এগুলো বাদ দিলেই অনেক অর্থ ও সুযোগ সুবিধা পাব! একদিকে সত্যবাদিতা অন্যদিকে তার সুযোগ-সুবিধা। অর্থাৎ মিথ্যা বললে নিজ স্বার্থ রক্ষা হয় আর সত্য বললে ক্ষতি হয় ওই স্বার্থের। কিন্তু প্রকৃত মানুষ ও আল্লাহর প্রিয় হতে হলে সত্য কথাই বলতে হবে। আমানতের খিয়ানতে কোটি কোটি ডলার আয়ের পথ থাকলেও খিয়ানত করা যাবে না। এ ধরনের উন্নত চরিত্র অর্জন করতে হলে ঈমানকে মজবুত করতে হবে। ঈমান মানুষকে ন্যায়পরায়ণ ও সচ্চরিত্রবান হতে সাহায্য করে। যার ঈমান যত দৃঢ় সে ততই ন্যায়বিচারকামী, ততই ত্যাগী, সাহসী-বীর ও ততই পরোপকারী।
ঈমানকে দৃঢ় করতে জ্ঞানই যথেষ্ট নয়। মানুষের জ্ঞান যদি ঈমান-শূন্য হয় তাহলে তা ন্যায়বিচার ও সচ্চরিত্র অর্জনে সহায়ক হয় না বরং তা হয় এসবের জন্য ধ্বংসাত্মক । কবি সানায়ী বলেছেন: যখন চোর আলো নিয়ে চুরি করতে আসে তখন ভাল ও দামী জিনিসগুলোই নিয়ে যায়।

কিন্তু যদি জ্ঞানীর মাঝে ঈমানী শক্তি থাকে তাহলে সমাজে ন্যায়বিচার ও নৈতিকতা দৃঢ় হয়। ঈমানকে বাদ দিয়ে পরোপকার করতে গিয়ে অনেকেই ধনীর সম্পদ চুরি করে বা ডাকাতি করে গরিবকে তা দান করেন! কিংবা জাল টাকা বানিয়ে তা গরীবকে দেন! ইসলাম ইবাদতের নির্দেশ দিয়েছে যাতে এর মাধ্যমে ন্যায়বিচার ও সততাকে প্রতিষ্ঠা করা যায়। অন্যদিকে ন্যায়বিচার ও সৎগুণাবলী জোরদার করে ইবাদতকে। এ দুটি বিষয় অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। এ দুয়ের একটি অপরটি ছাড়া অর্থহীন।
যদি মানুষ তার সন্তান-সন্ততি বা নিজেকে সংশোধন করতে চায় তবে অবশ্যই তাকে ইবাদত-বন্দেগি, দোয়া ও মুনাজাতের প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। স্বভাব-চরিত্র উন্নত ও শুদ্ধ করতে নফল ইবাদতেরও ব্যাপক গুরুত্ব রয়েছে। বস্তুবাদী ও লোভী মানুষ ইবাদতের গুরুত্ব বোঝে না বা কম বোঝে। পাশ্চাত্যে কেউ কেউ গর্ব করে বলে: আজ আমি স্রস্টার ইবাদতের পেছনে ১ মিনিট সময় ব্যয় করেছি! এই শ্রেণীর মানুষ নিজের ও অন্যদের পেছনে সারা দিনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় দিতে চাইলেও আল্লাহর জন্য এক ঘণ্টা সময় দেয়া তাদের জন্য অকল্পনীয়! কেবল একটি ঘণ্টার জন্য রাতে বা দিনে নির্জনে আল্লাহর কাছে মনের কথাগুলো খুলে বলুন! দোয়া, দরূদ, আত্ম-সমালোচনা ও ক্ষমা প্রার্থনায় রত থাকুন। তওবার প্রাক্কালে নিজের বিচার করুন। দিনের ভাল কাজগুলোর জন্য আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করুন। একটি কাজ উত্তম হওয়া সত্ত্বেও যদি না করে থাকেন তাহলে তা করার দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিন। আর মন্দ কিছু করে থাকলে তওবা করে বলুন, ভবিষ্যতে এমন ভুল করব না।
মহানবীর (সা) ন্যায়পরায়ণ সাহাবীদের সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে: তাঁরা রাতের সন্ন্যাসী ও দিনের বেলায় সিংহ। আর কুরআন বলেছে: তারা ধৈর্যশীল, সত্যবাদী, একনিষ্ঠ আনুগত্যকারী বা ইবাদতকারী, দানশীল ও ভোররাতের তওবাকারী। (আলে ইমরান, ১৭) অর্থাৎ ভালো মুসলমান হতে হলে দিনে জিহাদি বা সংগ্রামী ও রাতে সাধক বা সন্ন্যাসী হতে হবে। এ ছাড়াও দানের পর তওবার কথা এসেছে। মহান আল্লাহ আমাদের দান করুন এসব উন্নত গুণ। এবারে শোনা যাক অর্থসহ ২৬ তম রোজার দোয়া:
الیوم السّادس والعشرون : اَللّـهُمَّ اجْعَلْ سَعْیی فیهِ مَشْکُوراً، وَذَنْبی فیهِ مَغْفُوراً وَعَمَلی فیهِ مَقْبُولاً، وَعَیْبی فیهِ مَسْتُوراً، یا اَسْمَعَ السّامِعینَ .
হে আল্লাহ ! এ দিনে আমার প্রচেষ্টাকে গ্রহণ করে নাও। আমার সব গুনাহ মাফ করে দাও। আমার সব আমল কাজ কবুল করো এবং সব দোষ-ত্রু টি ঢেকে রাখ। হে সর্বশ্রেষ্ঠ শ্রোতা। #
পার্সটুডে/এমএইচ/৩১