ফেব্রুয়ারি ২১, ২০২২ ১৮:২০ Asia/Dhaka

পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠানের 'কুরআনের আলো'র সূরা হুজুরাতের ১ম পর্ব নিয়ে আলোচনা। আজ আমরা সূরা হুজুরাতের সংক্ষিপ্ত তাফসির সম্পর্কে জানব। মদীনায় অবতীর্ণ এই সূরায় মূলত গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক আচার-আচরণ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। এই সূরায় বর্ণিত মূলনীতিগুলো অনুসরণ করলে সমাজের মানুষের মধ্যে ভালোবাসা, বন্ধুত্ব ও ভ্রাতৃত্ব শক্তিশালী হয় এবং না করলে পরস্পরে শত্রুতা, বিদ্বেষ, অমূলক সন্দেহ ও বিভেদ সৃষ্টি হয়। এই সূরার ১ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:

يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ لَا تُقَدِّمُواْ بَيۡنَ يَدَيِ ٱللَّهِ وَرَسُولِهِۦۖ وَٱتَّقُواْ ٱللَّهَۚ إِنَّ ٱللَّهَ سَمِيعٌ عَلِيمٞ (1)

“হে ঈমানদারগণ! [কোন বিষয়েই] আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সমক্ষে তোমরা অগ্রণী হয়ো না, আর তোমরা আল্লাহ্‌র [নাফরমানি] থেকে বেঁচে থাকো; নিশ্চয় আল্লাহ্‌ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।”  (৪৯:০১)

এই সূরায় ঈমানদার ব্যক্তিদের উদ্দেশ করে বলা হচ্ছে: ঈমানের দাবি হচ্ছে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশের সামনে পরিপূর্ণ আত্মসমর্পন করা এবং তাদের থেকে অগ্রণী হয়ে না যাওয়া। বিশেষ করে সামাজিক বিষয়াদিতে যেখানে সাধারণ মানুষকে মুসলিম সমাজের নেতৃত্বের অনুগত হয়ে থাকতে হয় সেখানে একথা বিশেষভাবে প্রযোজ্য। এসব বিষয়ে নেতৃত্বের চেয়ে অগ্রগামী হয়ে গেলে সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে। কোনো কোনো উগ্র মুসলমান আশা করে, তাদের মতো করে সমাজপতিরা সব কাজকর্ম করবে।  অথচ যিনি নেতা তিনি সমাজের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে গণস্বার্থের ভিত্তিতে যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

১- আল্লাহ যেসব বিষয়কে হারাম ঘোষণা করেছেন তাকে হালাল মনে করা বা তিনি যা কিছুকে হারাম ঘোষণা করেছেন তাকে হালাল মনে করা আল্লাহর ও তাঁর রাসূলের থেকে অগ্রসর হয়ে যাওয়া শামল।

২- সমাজের আইন প্রণিত হতে হবে পবিত্র কুরআন ও রাসূলের সুন্নাহ অনুযায়ী। আর কুরআন ও সুন্নাহ বিরোধী যেকোনো আইন প্রণয়নের অর্থ হবে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের চেয়ে অগ্রগামী হয়ে যাওয়া।

৩- কেউ নিজের অভিরুচি অনুযায়ী ব্যক্তিগত বা সামাজিক জীবনে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের চেয়ে অগ্রগামী হয়ে গেলে বুঝতে হবে, এই ব্যক্তি ঈমানের স্বাদ পায়নি।

সূরা হুজুরাতের ২ ও ৩ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:

يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ لَا تَرۡفَعُوٓاْ أَصۡوَٰتَكُمۡ فَوۡقَ صَوۡتِ ٱلنَّبِيِّ وَلَا تَجۡهَرُواْ لَهُۥ بِٱلۡقَوۡلِ كَجَهۡرِ بَعۡضِكُمۡ لِبَعۡضٍ أَن تَحۡبَطَ أَعۡمَٰلُكُمۡ وَأَنتُمۡ لَا تَشۡعُرُونَ (2) إِنَّ ٱلَّذِينَ يَغُضُّونَ أَصۡوَٰتَهُمۡ عِندَ رَسُولِ ٱللَّهِ أُوْلَٰٓئِكَ ٱلَّذِينَ ٱمۡتَحَنَ ٱللَّهُ قُلُوبَهُمۡ لِلتَّقۡوَىٰۚ لَهُم مَّغۡفِرَةٞ وَأَجۡرٌ عَظِيمٌ (3)

"হে ঈমানদারগণ! তোমরা [রাসূলের সঙ্গে কথাবার্তার সময়] নবীর কণ্ঠস্বরের উপর নিজেদের কণ্ঠস্বর উঁচু করো না এবং নিজেদের মধ্যে যেভাবে উচ্চস্বরে কথা বলো রাসূলের সাথে সেরূপ উচ্চস্বরে কথা বলো না; এ আশঙ্কায় যে, [এই বেয়াদবির কারণে] তোমাদের সকল কাজ বিনষ্ট হয়ে যাবে অথচ তোমরা উপলব্ধিও করতে পারবে না।” (৪৯:০২)

“নিশ্চয় যারা আল্লাহর রাসূলের সামনে নিজেদের কণ্ঠস্বর নীচু করে, আল্লাহ্ তাদের অন্তরকে তাকওয়া [অবলম্বনের] জন্য পরীক্ষা করে নিয়েছেন [এবং প্রস্তুত করেছেন]। তাদের জন্য রয়েছে ক্ষমা ও মহাপুরস্কার।”(৪৯:০৩)

আগের আয়াতের বিষয়বস্তু ছিল এই যে, কোনো কাজে রাসূলের চেয়ে অগ্রগামী হওয়া যাবে না এবং তিনি যতক্ষণ পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত না দিচ্ছেন ততক্ষণ পর্যন্ত কোনো কিছু করা যাবে না। এরপর এই দুই আয়াতে বলা হচ্ছে, কথা বলার সময়ও রাসূলের চেয়ে উচ্চঃস্বরে কথা বলা যাবে না। চিৎকার করার তো প্রশ্নই আসে না।

এই আয়াতের বক্তব্যে বোঝা যাচ্ছে রাসূলের যুগের কোনো কোনো মুসলমান এই সামাজিক আদবটি রক্ষা করতেন না। তারা সাধারণ মানুষের সঙ্গে যেভাবে উচ্চস্বরে কথা বলতেন সেভাবে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে উচ্চকণ্ঠে কথা বলতেন এবং বেয়াদবি করতেন। বিষয়টি এতদূর গড়িয়েছে যে, আল্লাহ নিজে তাদেরকে হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলছেন, তোমরা যদি তোমাদের এই অসভ্য ও অবমাননাকর আচরণ সংশোধন না করো তাহলে তোমাদের আমলনামা ধ্বংস হয়ে যাবে কিন্তু তোমরা ঘুনাক্ষরেও কিছু টের পাবে না।

পরের আয়াতে এই বিষয়টির প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা হচ্ছে যে, তাকওয়া অবলম্বনের অন্যতম শর্ত হচ্ছে আল্লাহর রাসূলের সামনে কণ্ঠস্বর নীচু রাখা। আর এটি করতে পারলে দুনিয়া ও আখিরাতে আল্লাহ তায়ালার ক্ষমা ও মহাপুরস্কার লাভ করা সম্ভব হবে।

এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো:

১- আমাদেরকে কথা ও কাজে সতর্ক থাকতে হবে। কারণ, আমাদের প্রতিটি কথা ও কাজের ভালো ও মন্দ প্রভাব আমাদের দিকেই ফিরে আসে।

২- অনেক মানুষ বাইরে বিনয়ী হওয়া সত্ত্বেও ভেতরে অনেক বেশি অহংকারী। আমাদের বিনয়ী আচরণ তখনই মূল্যবান হয়ে উঠবে যখন সে আচরণ সততা ও তাকওয়া-ভিত্তিক হবে। তা না হলে সে আচরণ হবে প্রতারণার শামিল।

৩- ঈমান ও তাকওয়ার দাবি হচ্ছে গোনাহমুক্ত পবিত্র জীবন। বহু ঈমানদার মানুষ অনেক সময় গোনাহ করে ফেলেন। কিন্তু পরবর্তীতে ভুল বুঝতে পেরে তওবা করে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চান এবং আবার পবিত্র জীবনে ফিরে আসেন।

সূরা হুজুরাতের ৪ ও ৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:

إِنَّ ٱلَّذِينَ يُنَادُونَكَ مِن وَرَآءِ ٱلۡحُجُرَٰتِ أَكۡثَرُهُمۡ لَا يَعۡقِلُونَ (4) وَلَوۡ أَنَّهُمۡ صَبَرُواْ حَتَّىٰ تَخۡرُجَ إِلَيۡهِمۡ لَكَانَ خَيۡرٗا لَّهُمۡۚ وَٱللَّهُ غَفُورٞ رَّحِيمٞ (5)

“যারা [আপনার ঘরের] কক্ষগুলোর পিছন হতে আপনাকে উচ্চঃস্বরে ডাকে তাদের অধিকাংশই নির্বোধ।” (৪৯:০৪)

“আর আপনি বের হয়ে তাদের কাছে আসা পর্যন্ত যদি তারা ধৈর্য ধারণ করত, তবে তা নিঃসন্দেহে তাদের জন্য উত্তম হত। আর আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।”(৪৯:০৫)

আগের আয়াতগুলোর উদাহরণ তুলে ধরে এই আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলছেন, রাসূলে খোদা (সা.) যখন নিজ ঘরে স্ত্রীর সঙ্গে পারিবারিক বিষয়াদি নিয়ে ব্যস্ত কিংবা বিশ্রাম নিতেন তখন কিছু মানুষ তাঁর ঘরের বাইরে বের হওয়ার জন্য অপেক্ষা না করে বাইরে থেকেই তাঁকে ডাকাডাকি শুরু করে দিত। তারা উচ্চকণ্ঠে রাসূলের নাম ধরে ডাকাডাকি করে তাদের দাবিদাওয়া তুলে ধরত। পবিত্র কুরআনে এ ধরনের মানুষদের উদ্দেশ করে বলা হচ্ছে: তাদের এই আচরণ নির্বুদ্ধিতার শামিল। আর ভদ্রতা, সৌজন্য ও সম্মানজনক ব্যবহার হচ্ছে বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক। সমাজের সম্মানিত ব্যক্তিদের সঙ্গে আলাপচারিতার ক্ষেত্রে ভদ্রতা ও সৌজন্য বজায় রাখা উচিত।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো:

১- সামাজিক আচার-আচরণে সৌজন্য রক্ষা করার ওপর ইসলাম বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। বিষয়টির গুরুত্ব এতটা বেশি যে, অসৌজন্যমূলক ব্যবহারকে নির্বুদ্ধিতার শামিল বলা হয়েছে।

২- ইসলামে ঘর ও পরিবারকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। পারিবারিক জীবনে ঝামেলা তৈরি করার অধিকার কারো নেই। এমনকি ঘরের বাইরে থেকে কাউকে চেচামেচি করে ডাকতেও ইসলাম নিষেধ করেছে।

৩- কারো কাঁধে সামাজিক দায়িত্বের বোঝা থাকার অর্থ এই নয় যে, তিনি পরিবারকে সময় দেবেন না।

৪- অপরের বিশ্রামের সময় তাকে বিরক্ত করা যাবে না।#

পার্সটুডে/এমএমআই/আবুসাঈদ/ ২১

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ