ফেব্রুয়ারি ২১, ২০২২ ১৭:৪৪ Asia/Dhaka

পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠানের 'কুরআনের আলো'র সূরা হুজুরাতের ৩য় পর্ব নিয়ে আলোচনা। সূরা হুজুরাতের সংক্ষিপ্ত তাফসির। মদীনায় অবতীর্ণ এই সূরায় মূলত গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক আচার-আচরণ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। এই সূরায় বর্ণিত মূলনীতিগুলো অনুসরণ করলে সমাজের মানুষের মধ্যে ভালোবাসা, বন্ধুত্ব ও ভ্রাতৃত্ব শক্তিশালী হয় এবং না করলে পরস্পরে শত্রুতা, বিদ্বেষ, অমূলক সন্দেহ ও বিভেদ সৃষ্টি হয়। এই সূরার ১০ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:

إِنَّمَا ٱلۡمُؤۡمِنُونَ إِخۡوَةٞ فَأَصۡلِحُواْ بَيۡنَ أَخَوَيۡكُمۡۚ وَٱتَّقُواْ ٱللَّهَ لَعَلَّكُمۡ تُرۡحَمُونَ (10)

“মুমিনগণ তো পরস্পর ভাই ভাই; কাজেই তোমরা তোমাদের ভাইদের মধ্যে আপোষ মীমাংসা করে দাও। আর আল্লাহকে ভয় করো, যাতে তোমরা অনুগ্রহপ্রাপ্ত হও।”  (৪৯:১০)

ইসলামের একটি বড় নেয়ামত হলো সকল মুমিনের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক স্থাপন করা। সাধারণত, একটি পরিবারের দুই ভাই পরস্পরকে সমকক্ষ ও সম অধিকারভুক্ত বলে মনে করে। একজন আরেকজনের চেয়ে নিজেকে বড় মনে করে না ও অহংকার দেখায় না। ইসলাম ঠিক এই বৈশিষ্ট্যের প্রতি ইঙ্গিত করে বলছে- জাতি, বর্ণ, বংশ ও ভাষাগত ভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও মুমিন ব্যক্তিরা পরস্পরকে ভাইসম মনে করবে এবং একজন আরেকজনের চেয়ে নিজেকে বড় মনে করবে না।  রাসূলুল্লাহ (সা.) তাঁর সাহাবীদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন প্রতিষ্ঠা করেছেন যাতে কিয়ামত পর্যন্ত মুসলমানদের মধ্যে এ ধরনের ভ্রাতৃপ্রতীম বন্ধন অটুট থাকে। তিনি সুস্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেছেন, অনারবের ওপর আরবের কিংবা কালোর ওপর সাদার কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। সবাই সবার ভাই এবং এক আল্লাহর বান্দা।      

যদি কখনও দুই মুমিন ব্যক্তি বা মুমিনদের দু’টি দলের মধ্যে মতপার্থক্য বা সংঘর্ষ বাধে তাহলে অপর মুমিন ব্যক্তিদের দায়িত্ব হবে ভ্রাতৃত্বের এই মূলনীতি অনুসরণ করে তাদের মধ্যে শান্তি স্থাপন করা ও তাদেরকে মিলিয়ে দেওয়া।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো:

১- ইসলামে নিজেকে অপরের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ভাবা জায়েয নয়। কারণ, সকল মুমিন সমান ও পরস্পরের ভাই। পিতামাতার সঙ্গে সন্তানের সম্পর্ক বড় থেকে ছোটর সম্পর্ক হলেও ভাইয়ে ভাইয়ে সম্পর্ক সমান।

২- দুই ভাইয়ের মধ্যে মতপার্থক্য সৃষ্টি হলে পরিবারের অন্য সদস্যরা যেমন তাদেরকে মিলিয়ে দেয় তেমনি মুসলিম সমাজে বসবাসরত মুমিনদের মধ্যে মতপার্থক্য হলেও সমাজ অধিপতিদের উচিত তাদের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা করে দেওয়া।

৩- আল্লাহর রহমত বা অনুগ্রহ পাওয়ার জন্য মুমিন ব্যক্তিদের মধ্যে শান্তি, সম্প্রীতি ও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিরাজমান থাকতে হবে।

সূরা হুজুরাতের  ১১ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:

يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ لَا يَسۡخَرۡ قَوۡمٞ مِّن قَوۡمٍ عَسَىٰٓ أَن يَكُونُواْ خَيۡرٗا مِّنۡهُمۡ وَلَا نِسَآءٞ مِّن نِّسَآءٍ عَسَىٰٓ أَن يَكُنَّ خَيۡرٗا مِّنۡهُنَّۖ وَلَا تَلۡمِزُوٓاْ أَنفُسَكُمۡ وَلَا تَنَابَزُواْ بِٱلۡأَلۡقَٰبِۖ بِئۡسَ ٱلِٱسۡمُ ٱلۡفُسُوقُ بَعۡدَ ٱلۡإِيمَٰنِۚ وَمَن لَّمۡ يَتُبۡ فَأُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلظَّٰلِمُونَ (11)

“হে ঈমানদারগণ! [তোমাদের মধ্যে] কোন মুমিন সম্প্রদায় যেন অপর কোন মুমিন সম্প্রদায়কে উপহাস না করে; কেননা যাদেরকে উপহাস করা হচ্ছে তারা উপহাসকারীদের চেয়ে উত্তম হতে পারে এবং নারীরা যেন অন্য নারীদেরকে উপহাস না করে; কেননা যাদেরকে উপহাস করা হচ্ছে তারা উপহাসকারিণীদের চেয়ে উত্তম পারে। আর তোমরা একে অন্যের প্ৰতি দোষারোপ করো না এবং তোমরা একে অন্যকে মন্দ নামে ডেকো না; ঈমানের পর মন্দ নাম অতি নিকৃষ্ট। আর যারা [এসব কাজ করার পর] তওবা করে না তারাই তো যালিম৷”  (৪৯:১১)

আগের আয়াতে মুমিনদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক নিয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। এরপর এই আয়াতে ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করে এমন তিনটি কাজের প্রতি ইঙ্গিত করে আল্লাহ তায়ালা বলছেন: কোনো নারী বা পুরুষের কিংবা কোনো জাতি বা গোষ্ঠীর অপর নারী বা পুরুষ কিংবা অপর জাতি বা গোষ্ঠীকে উপহাস করার অধিকার নেই। কারণ কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী এতটা পরিশুদ্ধ নয় যে সে বা তারা অপরকে ঠাট্টার পাত্র বানাবে। সেইসঙ্গে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে মন্দ নামে ডাকার অধিকারও ইসলাম দেয়নি। কারণ, মন্দ বা অপমানজনক নামে ডাকলে ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে তিক্ততা ও রেষারেষী তৈরি হয়। এজন্য আল্লাহ তায়ালা এই কাজকে অপরের প্রতি জুলুম ও কবিরা গোনাহ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন যা তওবা ছাড়া মাফ হবে না।

এই আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে:

১- আল্লাহর প্রতি ঈমানদার ব্যক্তিরা তাঁর বান্দাদের উপহাস করতে পারে না।

২- অপরকে উপহাস করার অর্থ নিজেকে শ্রেষ্ঠ ভাবা। পবিত্র কুরআন নিজেকে শ্রেষ্ঠ ভাবতে নিষেধ করে বলেছে: অপরকে উপহাস করো না; কারণ যাকে উপহাস করছো সে তোমার চেয়ে উত্তম হতে পারে।

৩- অপরের দোষ-ত্রুটি খুঁজে বের করলে এবং তাদেরকে মন্দ নামে ডাকলে তারাও আমাদের বিরুদ্ধে একই কাজ করতে উৎসাহিত হবে। অন্য কথায় উপহাস করা একমুখী কোনো রাস্তা নয়। আজ হোক কিংবা কাল উপহাসকারীকেও উপহাসের পাত্র হতে হবে।

৪-সমাজকে সব ধরনের মন্দ ও খারাপ কাজ এবং সব রকম উত্তেজনা ও সংঘাত থেকে মুক্ত রাখা হচ্ছে ইসলামের অন্যতম উদ্দেশ্য।

সূরা হুজুরাতের ১২ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:

يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ ٱجۡتَنِبُواْ كَثِيرٗا مِّنَ ٱلظَّنِّ إِنَّ بَعۡضَ ٱلظَّنِّ إِثۡمٞۖ وَ لَا تَجَسَّسُواْ وَلَا يَغۡتَب بَّعۡضُكُم بَعۡضًاۚ أَيُحِبُّ أَحَدُكُمۡ أَن يَأۡكُلَ لَحۡمَ أَخِيهِ مَيۡتٗا فَكَرِهۡتُمُوهُۚ وَٱتَّقُواْ ٱللَّهَۚ إِنَّ ٱللَّهَ تَوَّابٞ رَّحِيمٞ (12)

“হে ঈমানদারগণ! তোমরা অধিক অনুমান হতে দূরে থাক; কারণ কোন কোন অনুমান পাপ এবং তোমরা একে অন্যের গোপনীয় বিষয় অনুসন্ধান করো না এবং একে অন্যের গীবত করো না।  তোমাদের মধ্যে কি কেউ তার মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে চাইবে? [কখনওই নয়] বস্তুত তোমরা তো একে ঘৃণ্যই মনে কর। আর তোমরা আল্লাহর [নাফরমানিকে] ভয় কর; নিশ্চয় আল্লাহ্ তওবা গ্রহণকারী, পরম দয়ালু।”  (৪৯:১২)

আগের আয়াতের ধারাবাহিকতায় এই আয়াতে একই সমাজভুক্ত মানুষের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক দুর্বল করে দিতে পারে- এমন তিনটি গোনাহের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। পবিত্র কুরআন মুমিন ব্যক্তিদেরকে পরস্পরের প্রতি সুধারণা পোষণ করার নির্দেশ দিলেও দুঃখজনকভাবে কিছু মানুষ অপরের প্রতি কুধারণা পোষণ করে। তারা যুক্তি কিংবা দলিল উপস্থাপন ছাড়াই শুধুমাত্র সন্দেহ ও অনুমানের ভিত্তিতে অপরের গোপন বিষয় অনুসন্ধান করে এবং তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ উত্থাপন করে।

আর গীবত হচ্ছে কোনো ব্যক্তির এমন কোনো দোষ বলে বেড়ানো যা অন্যরা জানত না। দোষটি আসলেই তার মধ্যে আছে এবং সে একথা শুনলে মনে কষ্ট পাবে। এই আয়াতে গীবত করাকে মৃত মানুষের গোশত ভক্ষণের সমতুল্য বলে উপমা দেওয়া হয়েছে। গীবতকারী যখন অন্যের কাছে কোনো ব্যক্তির ত্রুটি বলে বেড়ায় তখন ওই ব্যক্তি সেখানে উপস্থিত থাকে না এবং আত্মপক্ষ সমর্থন করে কথা বলারও কোনো সুযোগ পায় না। এ কারণে তাকে মৃত ব্যক্তি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে এবং তার ত্রুটি বলে বেড়ানোকে তার গোশত খাওয়ার সমতুল্য বলা হয়েছে।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

১- সবাইকে নির্দোষ ভাবা এবং পরস্পরের প্রতি সুধারণা পোষণ করা মুসলিম সমাজের বৈশিষ্ট্য।

২- কুধারণা পোষণ মানুষকে অপরের দোষত্রুটি খুঁজে বের করতে উৎসাহিত করে এবং এর পরিণতি হয় গীবত। এর প্রত্যেকটি করতে আল্লাহ তায়ালা কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন।

৩- ইসলামে প্রতিটি সমস্যারই সমাধান রয়েছে। মানুষের গোনাহ যত বড়ই হোক প্রকৃত অনুশোচনার মাধ্যমে খাঁটি অন্তরে তওবা করলে আল্লাহ তায়ালা ক্ষমা করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আল্লাহ্ তওবা কবুলকারী, পরম দয়ালু।#

পার্সটুডে/এমএমআই/আবুসাঈদ/ ২১

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ