মার্চ ০৩, ২০২২ ১৬:৪০ Asia/Dhaka

পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠানের 'কুরআনের আলো'র সূরা হুজুরাতের শেষ পর্ব নিয়ে আলোচনা করেছি। আজ আমরা সূরা ক্বাফ 'এর সংক্ষিপ্ত তাফসির সম্পর্কে জানব। মক্কায় অবতীর্ণ এই সূরার মূল বিষয়বস্তু পরকাল সংঘটনের প্রমাণসমূহ, ভালো ও মন্দ মানুষের পরিণাম এবং অতীত জাতিগুলোর কাহিনী থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা। এই সূরার ১ ও ২ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:

بسم الله الرحمن الرحیم

قٓۚ وَٱلۡقُرۡءَانِ ٱلۡمَجِيدِ (1) بَلۡ عَجِبُوٓاْ أَن جَآءَهُم مُّنذِرٞ مِّنۡهُمۡ فَقَالَ ٱلۡكَٰفِرُونَ هَٰذَا شَيۡءٌ عَجِيبٌ (2)

“ক্বাফ, শপথ মহিমান্বিত কুরআনের [আপনার নবুওয়াত ও কিয়ামত অবশ্যই সত্য]।”  (৫০:১)

“[তারা ঈমান আনেনি] বরং তারা বিস্ময় বোধ করে যে, তাদের মধ্য থেকে একজন সতর্ককারী তাদের কাছে এসেছেন। সুতরাং কাফিররা বলে, এ তো [অর্থাৎ কিয়ামত সম্পর্কিত কথাবার্তা তো] এক আশ্চর্য জিনিস!” (৫০:২)

পবিত্র কুরআনের আরো ২৮টি সূরার মতো এই সূরাটিও হুরুফে মুকাত্তায়াত দিয়ে শুরু হয়েছে এবং এর পরপরই পবিত্র কুরআনের মর্যাদা ও মহিমার শপথ করা হয়েছে। কারণ, পবিত্র কুরআন এই আলিফ-বা হরফ দিয়ে লেখা হলেও কারো পক্ষে এই মহাগ্রন্থের কোনো আয়াতের মতো একটি আয়াত রচনা করা সম্ভব নয়। পবিত্র কুরআনের মুজিযা বা অলৌকিকত্ব এখানেই। আয়াতের পরবর্তী অংশে কিয়ামত অস্বীকারকারীদের বক্তব্য তুলে ধরে বলা হচ্ছে: তাদের মধ্য থেকেই নবুওয়াতের দাবিদার এক ব্যক্তি মৃত্যু পরবর্তী জীবন বা কিয়ামতের ব্যাপারে হুঁশিয়ার করে দেয়ায় তারা বিস্মিত হয়েছে। তারা কিয়ামতকে একটি অসম্ভব ও অবাস্তব বিষয় বলে সাব্যস্ত করেছে। অথচ তিনি প্রথম কোনো মানুষ নন যাকে নবুওয়াতের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে এবং তিনিই প্রথম কিয়ামতের কথা বলেননি। এর আগের নবী-রাসূলগণও কিয়ামতের ব্যাপারে মানুষকে হুঁশিয়ার করেছেন। কাজেই তাদের বিস্ময় অজ্ঞতাপ্রসূত নয় বরং তারা গোঁয়ার্তুমি করছে এবং আল্লাহর রাসূলের বাণী গ্রহণ না করার একটি অজুহাত দাঁড় করিয়েছে মাত্র।

এই দুই আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হলো:

১- পবিত্র কুরআন হচ্ছে আল্লাহর কালাম যা সুউচ্চ মর্যাদা ও সম্মানের অধিকারী। কেউ সম্মান ও মর্যাদা পেতে চাইলে তাকে কুরআনের দিকনির্দেশনা অনুযায়ী জীবন সাজাতে হবে।

২- মানুষের মধ্য থেকে নবুওয়াতপ্রাপ্তি একটি যুক্তি ও প্রজ্ঞাপূর্ণ ঘটনা এবং প্রকৃতপক্ষে এটি নবীদের শক্তিশালী দিক। কিন্তু মূর্খ ও কাফিররা নবীদেরকে অবমাননা করার কাজে এ বিষয়টিকে ব্যবহার করে।

৩- নবুওয়াত ও কিয়ামত অস্বীকার করার জন্য কাফিরদের কাছে কোনো যুক্তি না থাকায় তারা মানুষকে দেখায় যে, এ বিষয়গুলো শুনে তারা বিস্মিত হয়েছে।

সূরা ক্বাফ 'এর  ৩ থেকে ৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:

أَءِذَا مِتۡنَا وَكُنَّا تُرَابٗاۖ ذَٰلِكَ رَجۡعُۢ بَعِيدٞ (3) قَدۡ عَلِمۡنَا مَا تَنقُصُ ٱلۡأَرۡضُ مِنۡهُمۡۖ وَعِندَنَا كِتَٰبٌ حَفِيظُۢ (4) بَلۡ كَذَّبُواْ بِٱلۡحَقِّ لَمَّا جَآءَهُمۡ فَهُمۡ فِيٓ أَمۡرٖ مَّرِيجٍ (5)

“আমাদের মৃত্যু হলে এবং আমরা মাটিতে পরিণত হলে (আমরা কি পুনরুজ্জীবিত হব?) সে প্রত্যাবর্তন তো সুদূর পরাহত!” (৫০:৩)

“মাটি তাদের [দেহের] কতটুকু ক্ষয় করে, আমি অবশ্যই তা জানি এবং আমার নিকট আছে সংরক্ষিত কিতাব [যাতে সংরক্ষিত রয়েছে সবকিছু]।”(৫০:৪)

“বস্তুতঃ তাদের নিকট সত্য আসার পর তারা তা মিথ্যা সাব্যস্ত করেছে। ফলে তারা সংশয়ে দোদুল্যমান।”(৫০:৫)

আগের আয়াতের ব্যাখ্যায় আমরা বলেছিলাম, পরকালকে অস্বীকার করার পেছনে কাফিরদের কোনো যুক্তি নেই। এই আয়াতে তাদের চিরকালীন একটি বিস্ময়বোধক প্রশ্ন আল্লাহ তায়ালাই তুলে ধরেছেন যেখানে তারা বলত: মৃত্যুর পর আমাদের দেহ মাটির সঙ্গে মিশে গেলে তা থেকে কিভাবে আবার জীবিত মানুষ বের করা সম্ভব? যুগে যুগে সব কাফিরদের প্রশ্নের সারসংক্ষেপ ছিল মোটামুটি একইরকম। এই প্রশ্নের উত্তরে কুরআনে পাকে বলা হচ্ছে: মানুষের মৃত্যুর পর তার শরীরে কি ধরনের পরিবর্তন আসে তার সবই আল্লাহ তায়ালার জানা আছে। তিনি সবকিছু জেনেশুনেই বলছেন যে, এই দেহকে কিয়ামতের দিন আবার জীবিত রূপ প্রদান করা হবে। আর এই সব কিছু আল্লাহর কাছে লিপিবদ্ধ অবস্থায় রয়েছে। এরপর বলা হচ্ছে: এসব কাফির জেনেশুনে সত্যকে অস্বীকার করছে। অজ্ঞতার কারণে তারা এমন কথা বলেনি।

এই তিন আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

১- পবিত্র কুরআনের একটি আকর্ষণীয় দিক হলো এখানে প্রথমে কাফিরদের কিছু বক্তব্য উদ্ধৃত করা হয় এবং এরপর যুক্তিসহ ওই দাবির জবাব দেওয়া হয়।

২- গোটা বিশ্বজগত ঐশী প্রজ্ঞা অনুযায়ী চলে এবং এখানে সবকিছুরই একটি নিয়ম-কানুন রয়েছে।

৩- সকল অস্থিরতা ও দুশ্চিন্তার মূলে রয়েছে আল্লাহকে অস্বীকার ও কুফরি করা।  আর ঈমানের মধ্যে রয়েছে শান্তি ও নিরাপত্তা। অন্য কথায় ঈমানদারের অন্তর শান্ত ও স্থির এবং কাফিরের অন্তর অশান্ত ও অস্থির।

সূরা ক্বাফ 'এর ৬ থেকে ৮ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:

أَفَلَمۡ يَنظُرُوٓاْ إِلَى ٱلسَّمَآءِ فَوۡقَهُمۡ كَيۡفَ بَنَيۡنَٰهَا وَزَيَّنَّٰهَا وَمَا لَهَا مِن فُرُوجٖ (6) وَٱلۡأَرۡضَ مَدَدۡنَٰهَا وَأَلۡقَيۡنَا فِيهَا رَوَٰسِيَ وَأَنۢبَتۡنَا فِيهَا مِن كُلِّ زَوۡجِۢ بَهِيجٖ (7) تَبۡصِرَةٗ وَذِكۡرَىٰ لِكُلِّ عَبۡدٖ مُّنِيبٖ (8)

“তারা কি তাদের উপরে অবস্থিত আসমানের দিকে তাকিয়ে দেখে না, আমি কিভাবে তা নির্মাণ করেছি ও তাকে [তারকারাজি দিয়ে] সুশোভিত করেছি এবং তাতে কোন ফাটলও নেই?” (৫০:৬)

“আর আমি পৃথিবীকে বিস্তৃত করেছি এবং তাতে সুদৃঢ় পর্বতমালা স্থাপন করেছি এবং ওতে উদগত করেছি নয়নাভিরাম নানা প্রকার উদ্ভিদ।”(৫০:৭)

“যাতে [আল্লাহর] অনুরাগী প্রত্যেক বান্দা জ্ঞান, [দূরদৃষ্টি] ও উপদেশ গ্রহণ করতে পারে।”(৫০:৮)

আল্লাহর অসীম জ্ঞান ও ক্ষমতার ব্যাপারে সংশয় থাকলেই কেবল কারো পক্ষে পরকালকে অস্বীকার করা সম্ভব। আগের আয়াতগুলোতে আল্লাহর অসীম জ্ঞানের বর্ণনা দেওয়ার পর এই তিন আয়াতে মহান আল্লাহর সীমাহীন ক্ষমতার কথা উল্লেখ করে বলা হচ্ছে, তোমরা যদি আকাশের দিকে তাকাও তাহলে চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র ও অসংখ্য গ্যালাক্সি দেখতে পাবে। এসব কিছুর দিকে দৃষ্টি দিলে তোমরা আল্লাহর ক্ষমতা সম্পর্কে কিছুটা হলেও উপলব্ধি করতে পারবে। তখন আর তোমাদের মনে এ প্রশ্ন জাগবে না যে, আল্লাহ কীভাবে মৃত মানুষকে আবার জীবিত করবেন।

আর যদি তোমরা জমিনের দিকে তাকাও তাহলে তোমরা পাহাড়, সমতলভূমি এবং জঙ্গল ও গাছপালা দেখতে পাবে। এসব কিছু সৃষ্টিতে তোমাদের কোনো ভূমিকা ছিল না বরং মহান আল্লাহই এগুলোর অস্তিত্ব দান করেছেন। এসব কিছুই সৃষ্টিকর্তার প্রতি মানুষের আকর্ষণ সৃষ্টি হওয়ার মাধ্যম; অবশ্য এসবের মাধ্যমে তারাই আল্লাহর প্রতি আকৃষ্ট হয় যারা আল্লাহকে চিনতে চায় এবং তার নৈকট্য লাভের প্রত্যাশী।

এই তিন আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হলো:

১- আসমান ও জমিনসহ গোটা সৃষ্টিজগতকে আল্লাহকে চেনার স্কুল বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বলা যেতে পারে। অবশ্য এই স্কুল থেকে তারাই কিছু শিখতে পারে যারা তাদের সৃষ্টির শুরু ও শেষ এবং সৃষ্টির উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে আগ্রহী।

২- আসমান ও জমিনে আল্লাহ তায়ালা যা কিছু সৃষ্টি করেছেন তার সবই একটি সুনির্দিষ্ট নিয়মের মধ্যে চলে।

৩- আসমান ও জমিনে আল্লাহর সকল সৃষ্টির মৌলিক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে দৃঢ়তা, সৌন্দর্য ও শৃঙ্খলা। এসব সৃষ্টির মধ্যে কোনো খুঁত বের করা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। আর এখান থেকেই আল্লাহর অসীম জ্ঞান ও ক্ষমতার প্রমাণ পাওয়া যায়।

৪- মৃত মাটি থেকে জীবিত চারাগাছের জন্ম আল্লাহ তায়ালার মহাশক্তির নিদর্শন এবং এই মাটি থেকে আবার মানুষের পুনরুজ্জীবনের দৃষ্টান্তস্বরূপ।#

পার্সটুডে/এমএমআই/আবুসাঈদ/ ০৩

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ