মার্চ ০৩, ২০২২ ১৮:১৬ Asia/Dhaka

পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠানের 'কুরআনের আলো'র সূরা ক্বাফ'এর সংক্ষিপ্ত তাফসির সম্পর্কে জানব। মক্কায় অবতীর্ণ এই সূরার মূল বিষয়বস্তু পরকাল সংঘটনের প্রমাণসমূহ, ভালো ও মন্দ মানুষের পরিণাম এবং অতীত জাতিগুলোর কাহিনী থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা। এই সূরার ৩১ থেকে ৩২ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:

وَأُزۡلِفَتِ ٱلۡجَنَّةُ لِلۡمُتَّقِينَ غَيۡرَ بَعِيدٍ (31) هَٰذَا مَا تُوعَدُونَ لِكُلِّ أَوَّابٍ حَفِيظٖ (32)

“আর জান্নাতকে নিকটস্থ করা হবে মুত্তাকীদের এবং তাদের মধ্যে কোন দুরত্ব থাকবে না।”(৫০:৩১)

“[তাদেরকে বলা হবে] এরই প্ৰতিশ্রুতি তোমাদেরকে দেয়া হয়েছিল। [এই পুরস্কার পার্থিব জীবনে] প্রত্যেক আল্লাহ্‌ অভিমুখী [ও আল্লাহর সীমারেখা] হিফাযতকারীর জন্য।” (৫০:৩২)

গত আসরে সেইসব কাফেরের বর্ণনা দেওয়া হয়েছিল যারা গোয়ার্তুমি ও হঠকারিতার কারণে আল্লাহর প্রতি ঈমান আনেনি। এরপর এই দুই আয়াতে মুমিন ব্যক্তিদের পরিণতির প্রতি ইঙ্গিত করে বলা হচ্ছে: শুধুমাত্র মুত্তাকি ও পবিত্র জীবন যাপনকারীদের জন্যই পরকালে জান্নাত প্রস্তুত রয়েছে। তাদেরকে অতি সহজে এই জান্নাতে পৌঁছে দেওয়া হবে যাতে তারা আল্লাহ তায়ালার অসীম নেয়ামত উপভোগ করতে পারে। এটি  পার্থিব জীবনে আল্লাহ তায়ালার আদেশ-নিষেধ যথাযথভাবে পালন করার পুরস্কার। মুত্তাকিরা পার্থিব জীবনে আল্লাহর নিষিদ্ধ বিষয়গুলো থেকে নিজেদের বিরত রাখতেন এবং কখনও উদাসীনতা বা অজ্ঞতার কারণে কোনো ভুল বা পাপ হয়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে তওবা করে সঠিক পথে ফিরতেন।

এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় কয়েকটি বিষয় হলো:

১- কাফিরের মতো মুমিন ব্যক্তিও গোনাহ থেকে সম্পূর্ণ পবিত্র নয়। তবে মুমিন কাফিরের মতো গোনাহের ওপর অটল থাকে না বরং কখনও ভুলে গোনাহ হয়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে অনুতপ্ত হয় এবং তওবা করে আল্লাহর পথে ফিরে আসে।

২- আমাদের যদি আল্লাহ তায়ালার প্রতিশ্রুতির প্রতি বিশ্বাস থাকে তাহলে মনে রাখতে হবে, তাকওয়া ও পবিত্রতা আমাদেরকে জান্নাতের অধিবাসী হিসেবে আল্লাহর কাছে ফিরিয়ে নেবে।

সূরা ক্বাফ 'এর  ৩৩ থেকে ৩৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:

مَّنۡ خَشِيَ ٱلرَّحۡمَٰنَ بِٱلۡغَيۡبِ وَجَآءَ بِقَلۡبٖ مُّنِيبٍ (33) ٱدۡخُلُوهَا بِسَلَٰمٖۖ ذَٰلِكَ يَوۡمُ ٱلۡخُلُودِ (34) لَهُم مَّا يَشَآءُونَ فِيهَا وَلَدَيۡنَا مَزِيدٞ (35)

“যে গোপনে পরম দয়াময় [আল্লাহকে] ভয় করে এবং আল্লাহর নির্দেশ পালনের জন্য বিনয়ে অবনত অন্তর নিয়ে [আল্লাহ অভিমুখে] উপস্থিত হয়।”(৫০:৩৩)

“[তাদের বলা হবে] শান্তির সাথে তোমরা জান্নাতে প্রবেশ কর! এটা অনন্ত জীবনের দিন।” (৫০:৩৪)

“সেখানে জান্নাতবাসীর জন্য তা-ই আছে যা তারা ইচ্ছে করবে, আর আমার কাছে আরো বেশি [নেয়ামতসমূহ] আছে।” (৫০:৩৫)

আগের আয়াতগুলোর ধারাবাহিকতায় এই তিন আয়াতে বলা হচ্ছে: আল্লাহর প্রতি প্রকৃত ঈমানের নিদর্শন হচ্ছে, গোপনে এবং যেখানে  আল্লাহ ছাড়া আর কেউ উপস্থিত নেই সেখানে মানুষ আল্লাহকে ভয় পায় এবং গোনাহর কাজ থেকে বিরত থাকে; আর যদি ভুলে গোনাহ হয়েও যায় সঙ্গে সঙ্গে তওবা করে ফেলে। এ ধরনের বিশুদ্ধ অন্তর মানুষকে জাহান্নামের আজাব থেকে রক্ষা করে এবং তাকে এমন জান্নাতে প্রবেশ করিয়ে দেয় যা চিরস্থায়ী ও অনন্ত।

যারা পার্থিব জীবনে শুধুমাত্র আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে তাদের অন্তরের খেয়াল-খুশির অনুসরণ করা থেকে বিরত রয়েছে তাদের এ সাময়িক ক্ষতি আল্লাহ পরকালে পুষিয়ে দেবেন। জান্নাতে বলা হবে: তোমাদের চিত্তসুখের জন্য যা কিছু চাও এখানে তাই তোমাদের জন্য প্রস্তু রয়েছে। এমনকি এর বাইরেও এমন অনেক নেয়ামত আছে যেসব সম্পর্কে তোমাদের কোনো ধারনা না থাকার কারণে তোমরা সেসব চাইতেই পারবে না, এমন সময় নেয়ামতও আল্লাহ তায়ালা দয়াপরবশ হয়ে জান্নাতে তোমাদের দান করবেন।

এই তিন আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো:

১- মুমিনদের অন্তর তওবাকারী ও আল্লাহ অভিমুখী বিনয়ে অবনত। তাদের এই বিনয়াবনত অন্তরই কিয়ামতের দিন তাদের মুক্তির মাধ্যম হবে। কিন্তু কাফির ও মুনাফিকদের অন্তরে রয়েছে ব্যাধি। এসব অন্তর তাদের গোনাহের পক্ষে ব্যাখ্যা দাঁড় করায়। কাজেই তারা মুক্তি পাবে না।

২- মানুষের সামনে প্রকাশ্য দিবালোকে গোনাহ পরিত্যাগ করা ঈমানের লক্ষণ নয়। কারণ, মানুষ হয়তো আইন, সমালোচনা ও সম্মানহানীর ভয়ে এসব স্থানে গোনাহ করে না। কিন্তু আমরা যদি গোপন স্থানে একাকী থাকা অবস্থায় আল্লাহকে ভয় করতে পারি এবং তাঁর নির্ধারিত সীমারেখা মেনে চলি তাহলে সেটাই হবে প্রকৃত ঈমানদারির পরিচয়।

৩- জান্নাতবাসীদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করার সময় বিশেষভাবে অভ্যর্থনা জানানো হবে এবং বিশেষ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাদেরকে বরণ করে নেওয়া হবে।

৪- জান্নাতে আল্লাহর দেওয়া নেয়ামত উপভোগ করার জন্য কোনো ধরনের কষ্ট বা মেহনত করতে হবে না। আর সেখানকার সবচেয়ে বড় নেয়ামত হবে চিরস্থায়ী অমর জীবন।

৫- মানুষ এমন এক সৃষ্টি যার চাওয়ার কোনো শেষ নেই। তাই আল্লাহ তায়ালা জান্নাতে তার জন্য অসংখ্য-অগণিত নেয়ামতরাজি প্রস্তুত রেখেছেন।

সূরা ক্বাফ 'এর  ৩৬ থেকে ৩৭ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:

وَكَمۡ أَهۡلَكۡنَا قَبۡلَهُم مِّن قَرۡنٍ هُمۡ أَشَدُّ مِنۡهُم بَطۡشٗا فَنَقَّبُواْ فِي ٱلۡبِلَٰدِ هَلۡ مِن مَّحِيصٍ (36) إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَذِكۡرَىٰ لِمَن كَانَ لَهُۥ قَلۡبٌ أَوۡ أَلۡقَى ٱلسَّمۡعَ وَهُوَ شَهِيدٞ (37)

“আমি তাদের পূর্বে আরো কত মানবগোষ্ঠীকে ধ্বংস করেছি, যারা ছিল তাদের চেয়ে শক্তিতে প্রবল, তারা [রাষ্ট্র দখলের মাধ্যমে] দেশে-বিদেশ চষে বেড়াত, [তাদের জন্য] নিষ্কৃতির কোনো পথ ছিল কি?” (৫০:৩৬)

“নিশ্চয় এতে [অর্থাৎ উদ্ধত-অহংকারীদের ধ্বংসে] উপদেশ রয়েছে তার জন্য, যার আছে [জীবিত] অন্তঃকরণ অথবা যে [সত্য] শ্রবণ করে মনোযোগের সাথে।” (৫০:৩৭)

এই দুই আয়াতে সকল উদ্ধত-অহংকারীর জন্য রয়েছে কঠোর হুঁশিয়ারি ও শিক্ষা। তারা যেন এটা না ভাবে যে, তাদের শক্তি ও ক্ষমতা আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছার চেয়ে বেশি শক্তিশালী এবং তারা আল্লাহর হাত থেকে বাঁচতে পারবে। ইতিহাসের দীর্ঘ পরিক্রমায় এমন সব শক্তিশালী রাজা-বাদশাহ দম্ভভরে ক্ষমতার চর্চা করে গেছে যারা একের পর এক দেশ দখল করে বিশ্বের বিশাল অংশে রাজত্ব কায়েম করেছে। কিন্তু পরবর্তীতে তারা আল্লাহ তায়ালার শক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছে এবং পৃথিবীর বুকে আজ তাদের কোনো অস্তিত্ব নেই।

স্বাভাবিকভাবেই অতীত জাতিগুলোর পরিণতি থেকে কিছু মানুষ শিক্ষা গ্রহণ করে। তারা ইতিহাস অধ্যয়ন  করে অতীত জাতিগুলোর কর্ম ও পরিণতি বিশ্লেষণ করে এবং সেখান থেকে নিজের সঠিক করণীয় ঠিক করে নেয়। আর নিজেরা যদি বিশ্লেষণ করতে নাও পারে তবে অন্তত যারা এসব ঘটনা বিশ্লেষণ করে বর্ণনা করে তাদের কথা মনযোগ সহকারে শ্রবণ করে। তারা এখান থেকে শিক্ষা নিয়ে কুফর, জুলম ও সীমালঙ্ঘন থেকে বিরত থাকে।

এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:                         

১- অতীতের বৃহৎ সভ্যতাগুলোর পতনের কারণ সঠিকভাবে জানতে পারলে তা বর্তমান ও ভবিষ্যত জাতিগুলোকে আলোর পথ দেখাবে।

২- আল্লাহ তায়ালার একটি অবধারিত বিধান হচ্ছে অত্যাচারী ও সীমালঙ্ঘনকারী জাতি ও শাসকদের ধ্বংস করা।

৩- ক্ষমতা হচ্ছে জুলুম ও দুর্নীতির উৎসভূমি। ক্ষমতা মানুষকে অন্যের অধিকার লঙ্ঘন ও অত্যাচার-নিপীড়নের সুযোগ করে দেয়। তবে যারা আল্লাহকে ভয় করে তারা অপরের অধিকার লঙ্ঘন থেকে বিরত থাকে।

৪- অতীত জাতিগুলোর ইতিহাস অধ্যয়নই যথেষ্ট নয়। বরং আল্লাহর বিধানের আওতায় এসব ঘটনার কার্যকারণ বিশ্লেষণ করে সঠিক জ্ঞান অর্জন জরুরি।#

পার্সটুডে/এমএমআই/আবুসাঈদ/ ০৩

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ