মার্চ ০৩, ২০২২ ১৯:৫৭ Asia/Dhaka

পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠানের 'কুরআনের আলো'র সূরা ক্বাফ'এর সংক্ষিপ্ত তাফসিরের শেষ পর্ব। মক্কায় অবতীর্ণ এই সূরার মূল বিষয়বস্তু পরকাল সংঘটনের প্রমাণসমূহ, ভালো ও মন্দ মানুষের পরিণাম এবং অতীত জাতিগুলোর কাহিনী থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা। এই সূরার ৩৮ থেকে ৪০ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:

وَلَقَدۡ خَلَقۡنَا ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضَ وَمَا بَيۡنَهُمَا فِي سِتَّةِ أَيَّامٖ وَمَا مَسَّنَا مِن لُّغُوبٖ (38) فَٱصۡبِرۡ عَلَىٰ مَا يَقُولُونَ وَسَبِّحۡ بِحَمۡدِ رَبِّكَ قَبۡلَ طُلُوعِ ٱلشَّمۡسِ وَقَبۡلَ ٱلۡغُرُوبِ (39) وَمِنَ ٱلَّيۡلِ فَسَبِّحۡهُ وَأَدۡبَٰرَ ٱلسُّجُودِ (40)

“আর অবশ্যই আমি আসমানসমূহ, যমীন ও তাদের অন্তর্বতী সমস্ত কিছু সৃষ্টি করেছি ছয় দিনে; আর আমাকে কোন ক্লান্তি স্পর্শ করেনি।” (৫০:৩৮)

“অতএব [শত্রুরা] যা বলে তাতে আপনি ধৈর্য ধারণ করুন এবং সূর্যোদয়ের আগে ও সূর্যাস্তের আগে আপনার রবের সপ্রশংস পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করুন।” (৫০:৩৯)

“আর রাতের একাংশে এবং সিজদার পরেও তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করুন।” (৫০:৪০)

আগের আয়াতগুলোতে কিয়ামত সংঘটন ও সেদিন কাফিরদের অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে। এরপর এই তিন আয়াতে আবারো আল্লাহ তায়ালার ক্ষমতার প্রতি ইঙ্গিত করে বলা হচ্ছে: তোমরা কীভাবে কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার বিষয়টিকে অস্বীকার করো যখন গোটা বিশ্বজগত আল্লাহর ইচ্ছায় মাত্র ছয় দিনে সৃষ্টি হয়েছে? আর এই বিশাল জগত সৃষ্টি করতে তিনি বিন্দুমাত্র ক্লান্ত হননি। এরপর মহান আল্লাহ তাঁর রাসূলকে উদ্দেশ করে বলেন, আপনি কিয়ামত অস্বীকারকারীদের অবমাননাকর বক্তব্যে কষ্ট পাবেন না; বরং দিন ও রাতের বিভিন্ন সময়ে আপনি আল্লাহকে স্মরণ করে নিজের ধৈর্যশক্তি বাড়ান এবং তাদের বক্তব্য সহ্য করার ক্ষমতা অর্জন করুন।

এই তিন আয়াতের শিক্ষণীয় কয়েকটি বিষয় হচ্ছে:

১- আল্লাহ তায়ালা এক মুহূর্তে গোটা বিশ্বজগত সৃষ্টি করার ক্ষমতা রাখেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি ধীরে ধীরে এটি সৃষ্টি করেছেন এবং এ থেকে বিশ্বজগত পরিচালনায় কার্যকারণ ব্যবস্থার উপযোগিতা প্রমাণিত হয়েছে।

২- আল্লাহর সৃষ্ট বিশ্বজগত অনেক বিশাল।আর এই বিশাল জগত আল্লাহ তায়ালার অনন্ত শক্তি ও ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ।

৩- আমরা যেন সত্য বলার ক্ষেত্রে অপবাদ, গালিগালাজ ও অবমাননাকর কথাবার্তায় ভড়কে না যাই ও হতাশ হয়ে না পড়ি। আমাদেরকে ধৈর্য ধরে সৎকাজে লেগে থাকতে হবে।

৪- যেকোনো সমস্যার মোকাবিলায় ধৈর্য ধরার সর্বোত্তম উপায় হলো দিনরাতের যেকোনো সময়ে আল্লাহ তায়ালাকে স্মরণ করা।

৫- আল্লাহকে স্মরণ করার জন্য বাধাধরা কোনো সময় নেই। তবে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আল্লাহকে স্মরণ করার সবচেয়ে ফজিলতপূর্ণ ও শ্রেষ্ঠ সময়।

সূরা ক্বাফ 'এর  ৪১ থেকে ৪৪ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:

وَٱسۡتَمِعۡ يَوۡمَ يُنَادِ ٱلۡمُنَادِ مِن مَّكَانٖ قَرِيبٖ (41) يَوۡمَ يَسۡمَعُونَ ٱلصَّيۡحَةَ بِٱلۡحَقِّۚ ذَٰلِكَ يَوۡمُ ٱلۡخُرُوجِ (42) إِنَّا نَحۡنُ نُحۡيِۦ وَنُمِيتُ وَإِلَيۡنَا ٱلۡمَصِيرُ (43) يَوۡمَ تَشَقَّقُ ٱلۡأَرۡضُ عَنۡهُمۡ سِرَاعٗاۚ ذَٰلِكَ حَشۡرٌ عَلَيۡنَا يَسِيرٞ (44)

“আর মনোনিবেশ সহকারে শুনুন ও অপেক্ষা করুন সেদিনের, যেদিন এক ঘোষণাকারী নিকটবর্তী স্থান হতে ডাকবে।”(৫০:৪১)

“সেদিন মানুষ অবশ্যই শ্রবণ করবে এক বিকট আওয়াজ, সেদিনই [কবর থেকে] বের হবার দিন।” (৫০:৪২)

“আমিই জীবন দান করি, মৃত্যু ঘটাই এবং [সকলের] প্রত্যাবর্তন আমারই দিকে।” (৫০:৪৩)

“যেদিন তাদের [মৃতদেহের উপর] থেকে যমীন বিদীর্ণ হবে এবং লোকেরা [কবর থেকে বেরিয়ে] ত্রস্ত-ব্যস্ত হয়ে ছুটোছুটি করবে, এটা হাশর বা এমন এক সমাবেশ [যেখানে সব মানুষকে একত্রিত করা] আমার জন্য অতি সহজ।” (৫০:৪৪)

এই আয়াতগুলোতে কিয়ামতের দিনে একটি বিশাল সমাবেশ শুরু হওয়ার কথা বলা হয়েছে। আসমান থেকে আসা এক বিকট শব্দের পর এই সমাবেশে উপস্থিত হবে সৃষ্টির শুরু থেকে কিয়ামত পর্যন্ত মৃত্যুবরণকারী হাজার হাজার কোটি মানুষ। সেই শব্দটি এত বিকট হবে যে, সৃষ্টিজগতের যেকোনো প্রান্ত থেকে সেই শব্দকে অনেক কাছে থেকে শুনতে পাওয়া যাবে। সেই শব্দের আলোড়নে পাহাড় ভেঙে পড়বে এবং জমিন বিদীর্ণ হয়ে যাবে। আর মাটি ভেদ করে সকল মৃত ব্যক্তি জীবিত হয়ে দ্বিগ্বিদিগ ছুটতে থাকবে।

এই আয়াতগুলোতে একথাও বলা হয়েছে যে, যে আল্লাহ মানুষকে প্রথমবার পৃথিবীতে সৃষ্টি করেছেন এবং তাদেরকে মৃত্যু দিয়েছেন আজ কিয়ামতের দিন তিনিই আবার তাদেরকে জীবিত করেছেন যাতে তারা তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্যপানে এগিয়ে যেতে পারে।

এই চার আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় দিক হলো:

১- কিয়ামত হবে সশরীরে। প্রতিটি মানুষ মাটি ভেদ করে বেরিয়ে আসবে এবং কিয়ামতের ময়দানে সমবেত হবে।

২- মৃত্যু ও জীবন একমাত্র আল্লাহ তায়ালার হাতে রয়েছে। আর কিয়ামতের দিন মৃত মানুষের আবার জীবিত হয়ে ওঠার জন্য এটিই সর্বোত্তম প্রমাণ।

সূরা ক্বাফ 'এর  ৪৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:

نَّحۡنُ أَعۡلَمُ بِمَا يَقُولُونَۖ وَمَآ أَنتَ عَلَيۡهِم بِجَبَّارٖۖ فَذَكِّرۡ بِٱلۡقُرۡءَانِ مَن يَخَافُ وَعِيدِ (45)

“[কাফিররা] যা বলে তা আমি ভাল জানি, আর আপনি তাদের উপর জবরদস্তিকারী নন [যে তাদেরকে জোর করে সত্য পথে নিয়ে আসবেন], কাজেই যে আমার শাস্তির প্রতিশ্রুতিকে ভয় করে তাকে উপদেশ দান করুন কুরআনের সাহায্যে।”  (৫০:৪৫)

আগের আয়াতগুলোর ধারাবাহিকতায় এই আয়াতে আবার রাসূলুল্লাহ (সা.)কে উদ্দেশ করে মহান আল্লাহ বলছেন: কিয়ামত দিবস অস্বীকারকারীরা যে কারণে আপনার দাওয়াতের বাণী প্রত্যাখ্যান করে এবং অন্যদেরকেও আপনার প্রতি ঈমান আনতে বাধা দেয় তা আমার ভালো করে জানা আছে। আপনি কখনই এ আশা করবেন না যে, সব মানুষ আপনার প্রতি ঈমান আনবে। কারণ, আমি মানুষকে স্বাধীন সত্ত্বা দিয়ে সৃষ্টি করেছি এবং যেকোনা পথ বাছাই করার ক্ষমতা তার আছে। রাসূল হিসেবে আপনার দায়িত্ব হচ্ছে মানুষের কাছে রিসালাতের দায়িত্ব পৌঁছে দেওয়া এবং তাদেরকে তাদের কর্মের পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করা। কাউকে দ্বীন ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করা আপনার দায়িত্ব নয়।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

১- মানুষকে সতর্ক করার শ্রেষ্ঠ মাধ্যম আল-কুরআন। কাজেই মানুষকে দ্বীনের দাওয়াত দেওয়া ও তাদের সামনে নৈতিকতার শিক্ষা তুলে ধরতে হবে কুরআনের আয়াত বর্ণনা করে।নিজস্ব পদ্ধতিতে আবিস্কৃত গল্প বা বাণী শুনিয়ে দ্বীনের দাওয়াত দেওয়া যাবে না।

২- ঐশী ধর্মগুলোতে যা কিছু বলা হয়েছে তা সহজাতভাবে মানুষের চরিত্রে দিয়ে আল্লাহ দিয়ে দিয়েছেন। দ্বীনের দাওয়াতকারীদের কর্তব্য শুধু সেগুলো জাগিয়ে তোলা। নবী-রাসূলগণ ঠিক এ কাজটিই করেছেন।

৩- নবী-রাসূলগণের দায়িত্ব ছিল ধর্ম প্রচার করা; কাউকে ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করা নয়।কারণ, ব্যক্তিকে স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি কাজে লাগিয়ে ধর্ম গ্রহণ করতে হবে।

৪- কিয়ামত দিবসের পুরস্কার ও শাস্তি সম্পর্কে আল্লাহ যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তাতে বিশ্বাস করলে নবী-রাসূলদের দাওয়াতের বাণী মেনে নেওয়ার ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়।#

পার্সটুডে/এমএমআই/আবুসাঈদ/ ০৩

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ