মার্চ ১২, ২০২২ ২০:০৫ Asia/Dhaka

গত আসরে আমরা ইরানের পক্ষ থেকে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ৫৯৮ নম্বর প্রস্তাব গ্রহণ করে ইমাম খোমেনী (রহ.) জাতিসংঘকে যে চিঠি দিয়েছিলেন সে সম্পর্কে আলোচনা করেছি। আজকের আসরে আমরা ওই চিঠির বিষয়বস্তু সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করার পাশাপাশি ইরানে আবার ইরাকি বাহিনীর আগ্রসন শুরু করা নিয়ে কথা বলব।

ইসলামি বিপ্লবের মহান নেতা ইমাম খোমেনী দেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও সেনা অধিনায়কদের পরামর্শক্রমে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ৫৯৮ নম্বর প্রস্তাব মেনে নেওয়ার কথা ঘোষণা করেন। ইমামের কাছে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে যেসব রিপোর্ট আসছিল তা বিশ্লেষণ করে তিনি একথা উপলব্ধি করেন যে, সাদ্দামের নেতৃত্বাধীন ইরাক সরকার যুদ্ধ চালিয়ে যেতে চায় এবং ইরানকে ধরাশায়ী করার জন্য বাগদাদ একের পর এক পরিকল্পনা করে যাচ্ছে।  প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের দুই পরাশক্তি ইরাক সরকারের হাতে বিপুল পরিমাণ সমরাস্ত্র তুলে দিয়েছে যার এক দশমাংশ সংগ্রহ করার সুযোগও ইরানের জন্য রাখা হয়নি। এ অবস্থায় ইমাম এই ভেবে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন যে, যুদ্ধ চলতে থাকলে ইরান আরো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং শত্রু  তার অশুভ লক্ষ্য অর্জনের সুযোগ পাবে। কাজেই যুদ্ধ শুরু করার জন্য সাদ্দামকে অভিযুক্ত করার সুযোগ সৃষ্টি না হলেও জাতিসংঘের ৫৯৮ নম্বর প্রস্তাব মেনে নিলে অন্তত যুদ্ধ বন্ধ করে ব্যাপক মাত্রায় প্রাণহানি এড়ানো যাবে।

ইমাম খোমেনী জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ৫৯৮ নম্বর প্রস্তাব গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর ইরানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী জাতিসংঘ মহাসচিব পেরেজ ডি কুয়েয়ারকে পাঠানো এক চিঠিতে বলেন: “ন্যায় ও শান্তি প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যসহ গোটা বিশ্বে শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা করা এবং অসংখ্য মানুষের জীবন রক্ষা করার লক্ষ্যে ইরান জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ৫৯৮ নম্বর প্রস্তাব মেনে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।” ইরানের প্রেসিডেন্টের চিঠি পাওয়ার পর পেরেজ ডি কুয়েয়ার ঘোষণা করেন, ইরান নিঃশর্ত ও আনুষ্ঠানিকভাবে জাতিসংঘের ৫৯৮ নম্বর প্রস্তাব মেনে নিয়েছে।  তিনি বিষয়টি নিয়ে শলাপরামর্শের জন্য নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য দেশগুলোর বৈঠক ডাকার জন্য ওই পরিষদের প্রধানকে অনুরোধ করেন। পরবর্তী এক সপ্তাহ থেকে ১০ দিনের মধ্যে ইরাক ও ইরানের মধ্যে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হবে বলে ডিকুয়েয়ার আশা প্রকাশ করেন।

এদিকে ইরানের বেশিরভাগ মানুষ, বিশেষ করে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে ইচ্ছুক তরুণ সমাজের জন্য ৫৯৮ নম্বর প্রস্তাব মেনে নেওয়া সহজ ছিল না। তাদেরকে বিষয়টি বোঝানোর জন্য ইসলামি বিপ্লবের মহান নেতা ইমাম খোমেনী (রহ.) জাতির উদ্দেশে এক বাণীতে বলেন: “সত্যিকার অর্থে সবার জন্য বিশেষ করে আমার জন্য জাতিসংঘের প্রস্তাব মেনে নেয়া ছিল অত্যন্ত কষ্টকর। আমি কয়েকদিন আগে পর্যন্ত প্রতিরোধ চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তে অটল ছিলাম এবং যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার মাধ্যমেই দেশ ও বিপ্লবের স্বার্থ রক্ষিত হবে বলে মনে করতাম। কিন্তু রাজনৈতিক ও সামরিক কর্মকর্তাদের পরামর্শে আমি জাতিসংঘের প্রস্তাব মেনে নিয়ে যুদ্ধবিরতিতে সম্মতি দিয়েছি। আমি মনে করছি, এই মুহূর্তে বিষয়টি মেনে নিলে দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থ রক্ষিত হবে। ” ইমাম তার বাণীতে বলেন, “যে পরিস্থিতির কারণে আমি যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব মেনে নিলাম তা এখনই প্রকাশ করছি না; তবে সময়মতো সেকথা প্রকাশিত হবে। ”

প্রকৃতপক্ষে বিপ্লব পরবর্তী যুদ্ধ পরিস্থিতিতে দেশের জনগণের মধ্যে যাতে বিভেদ সৃষ্টি না হয় সেজন্য ইমাম খোমেনী যুদ্ধবিরতি মেনে নিতে সম্মত হন। ইমাম তার বার্তায় এই ক্রান্তিকাল অতিক্রম করাকে অতি জরুরি বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, আমার এ ঘোষণার পর অনেকেই আবেগের বশে অনেক কথা বলবেন। কি করা উচিত ছিল, কি করা উচিত হয়নি- ইত্যাদি নানা কথাবার্তা হবে। এ ধরনের কথাবার্তায় দেশের ভবিষ্যত প্রশ্নে জনগণের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রতিফলিতে হলেও এখন সত্যিই এসব কথা বলার সময় নয়।

ওদিকে, ইরাকের তৎকালীন স্বৈরশাসক সাদ্দাম যুদ্ধক্ষেত্রে নিজের অবস্থান শক্তিশালী হয়েছে ভেবে জাতিসংঘের প্রস্তাব মেনে নিতে রাজি হননি। জাতিসংঘের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে বাগদাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও সাদ্দাম সরকার ইরানের ওপর আগ্রাসন চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ইরান জাতিসংঘের প্রস্তাব মেনে নেওয়ার তিন দিন পর ১৯৮৮ সালের ২২ জুলাই ইরানের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী যখন জাতিসংঘ মহাসচিবের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছিলেন তখন ইরাকি বাহিনী কুশাক ও শালামচে এলাকা দিয়ে ইরানের অভ্যন্তরে আগ্রাসন চালায়। তারা আহওয়াজ-খোররামশাহর মহাসড়ক ধরে সামনে অগ্রসর হয় এবং খোররামশাহর শহরটি আবার অবরোধ করার চেষ্টা চালায়। আগ্রাসী ইরাকি বাহিনী যুদ্ধের শুরুতে একবার ওই শহর দখলে নিয়েছিল এবং প্রায় দুই বছর পর ইরানি যোদ্ধারা সেটি পুনরুদ্ধার করেছিলেন।

এবার ইরাকি বাহিনীর খোররামশাহর অভিমুখী অগ্রাভিযানের খবর ছড়িয়ে পড়লে ইরানি জনগণ প্রচণ্ড ক্ষোভে ফেটে পড়ে। তারা আবার যুদ্ধে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেয়। যেসব যুবক বিগত আট বছর ধরে যুদ্ধক্ষেত্রে ছিলেন এবং একাধিকবার আহত হয়েছেন তারাও আবার যুদ্ধে যাওয়ার জন্য লাইনে দাঁড়ান। ইরানের খুজিস্তান প্রদেশের গভর্নর এক বার্তায় ঘোষণা করেন: “শত্রু  সেনারা আহওয়াজ শহরের কাছাকাছি চলে আসার পর সাধারণ জনগণ তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে এবং প্রদেশের চিত্র সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে।  আহওয়াজের পাশাপাশি সুসাংগার, শুশ, আন্দিমেশ্‌ক ও দেজফুলসহ প্রদেশের সব শহরের জনতা সামর্থ্য অনুযায়ী যুদ্ধাস্ত্র নিয়ে রাস্তায় নেমে এসেছে এবং তারা প্রতিটি শহরে প্রতিরক্ষা ব্যূহ গড়ে তুলেছে। দেশের সেনাবাহিনীর পাশাপাশি সাধারণ জনগণ তাদের মাতৃভূমি রক্ষার জন্য যে দৃঢ় মনোভাব দেখাচ্ছে তাতে শত্রু  সেনারা আর সামনে অগ্রসর হওয়ার সাহস পাবে বলে মনে হয় না।” #

পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ /১২

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ