স্বাস্থ্যকথা
'রেজিস্টার্ড ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া একটি প্যারাসিটামলও খাবেন না'
শ্রোতাবন্ধুরা! রেডিও তেহরানের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বিষয়ক অনুষ্ঠান স্বাস্থ্যকথার আসরে সবাইকে স্বাগত জানাচ্ছি আমি গাজী আবদুর রশীদ। আশা করছি আপনারা ভালো আছেন। অসুখ-বিসুখ এবং চিকিৎসা দুটো বিষয়ের সম্পর্ক খুবই গভীর। অসুখ হলে চিকিৎিসার প্রশ্ন-যেতে হবে ডাক্তারের কাছে। কিন্তু বাংলাদেশের গাঁও গেরামের এমনকি শহরের বহু মানুষকে দেখা যায় অসুখ হলে নিজে নিজেই ডাক্তারি করেন। এটা কি ঠিক পদ্ধতি? সে প্রশ্ন থেকেই যায়। তো কোনো অসুখ হলে কিভাবে চিকিৎসা করা উচিত সে বিষয় নিয়ে আজ আমরা কথা বলব।
আর আলোচনা করবেন কানাডা প্রবাসী বিশিষ্ট চিকিৎসক ডা.শাহনাজ কাজী। তিনি দীর্ঘদিন কানাডাতে ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান হিসেবে কাজ করছেন। তো চলুন আজকের আলোচনায় যাওয়া যাক।
রেডিও তেহরান: ডা. শাহনাজ কাজী, আপনাকে রেডিও তেহরানের স্বাস্থ্যকথার আসরে স্বাগত জানাচ্ছি। প্রথমে আপনার কাছে জানতে চাইছি, যেকোনো অসুখ হলে চিকিৎসকের কাছে না গিয়ে ইচ্ছেমত যে ওষুধ খাচ্ছেন গ্রাম থেকে শহরের বেশিরভাগ মানুষ। এটি কি ঠিক? এটা কতটা ভয়াবহ হতে পারে। আসলে আমাদের চিকিৎসাটা কিভাবে হওয়া উচিত?
ডা. শাহনাজ কাজী: ধন্যবাদ আপনাকে। দেখুন, এই বিষয়টি নিয়ে বলতে পারেন আমি সবসময় মনোপীড়াতে থাকি। বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায় কি হচ্ছে তার সবটাই আমার জানা। যদিও বাংলাদেশে আমার অত কাজের অভিজ্ঞতা নেই তারপরও আমি সেখানে পড়াশুনা করেছি এবং আ্মার পুরো পরিবার বাংলাদেশে থাকে। ফলে বাংলাদেশের চিকিৎসা সেবা এবং ব্যবস্থার সবটাই আমার জানা।
তো এ সম্পর্কে প্রথমে আমি যেটি বলব সেটি হচ্ছে, আমরা যদি কেউ কোনো কারণে শারীরিক অসুস্থতা অনুভব করি। সেক্ষেত্রে অসুস্থ হওয়ার প্রথম তিন দিন অপেক্ষা করা গেলেও বা উপেক্ষা করলেও তারপর কিন্তু আমাদের অবশ্যই চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে এবং চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো কোনো ধরনের ওষুধ নেয়া অত্যন্ত ভুল হবে। ধরুন অসুস্থ হয়েছেন কোনো একটা ফার্মেসিতে গিয়ে সেখানে যিনি ওষুধ বিক্রির দায়িত্বে আছেন তাকে বললেন, ভাই আমার জ্বর হয়েছে আমি কি খাব? উনি একপাতা ওষুধ দিলেন অমনি আমি খেলে নিলাম। এটি করা যাবে না এবং এটি চিকিৎসা নয়। আমাকে একজন রেজিষ্টার্ড চিকিৎসকের কাছে গিয়ে আমার অসুস্থতার লক্ষণগুলো ডাক্তারকে বলে তাঁর পরামর্শ অনুযায়ী আমাদের ব্যবস্থা নিতে হবে।
রেডিও তেহরান: ড.শাহনাজ কাজী-আপনি রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ ব্যবহার না করার পরামর্শ দিলেন। যদি এভাবে ওষুধ ব্যবহার হয় সেটি ভুল এবং ঝুঁকিপূর্ণ। এরপর কি করতে হবে?
ড.শাহনাজ কাজী: আপনি অসুস্থতা নিয়ে একজন রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের গিয়ে লক্ষণ এবং ধরণ তাঁকে বললে তিনি সবকথা শোনার পর যদি তিনি মনে করেন কোনো ইনভেস্টিগেশন দরকার আছে তাহলে তিনি পরীক্ষা নিরীক্ষা দেবেন। আর যদি তেমন না হয়ে থাকে অর্থাৎ তাৎক্ষণিকভাবে লক্ষণের উপর ডায়গনোসিস করে ফেলতে পারেন তাহলে সেভাবে নির্দেশনা দেবেন। ডাক্তার অবশ্য লক্ষণ শুনেই অনেক সময় বুঝতে পারেন সমস্যা কি ধরনের। তবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ফিজিক্যাল ইক্সামিনেশন। আপনার লক্ষণ শোনার পর ডাক্তার আপনার কিছু শারীরিক পরীক্ষা করবেন। আপনার শরীরে হাত দিয়ে পরীক্ষা করবেন কিংবা স্টেসেথিস্কোপ দিয়ে উনি শুনবেন তারপর চিকিৎসক একটা ডায়াগনোসিসে এসে পৌঁছাবেন। তারপর ডা. আপনার চিকিৎসা দেয়া শুরু করবেন।
রেডিও তেহরান: ডা.শাহনাজ কাজী, আপনি পরীক্ষা নিরীক্ষার কথা বললেন। তো এই পরীক্ষা নিরীক্ষা বা ডায়াগনোসিস নিয়ে নানা অভিযোগের কথা শোনা যায়-তো এ বিষয়ে আপনি কি বলবেন?
ডা. শাহনাজ কাজী: হ্যাঁ এধরনের ঘটনা ঘটতে পারে কিংবা ঘটেছে কিন্তু সবক্ষেত্রে যে ঘটে তা না। এটা হয়তো ঘটে কিছু কিছু চিকিৎসকের ক্ষেত্রে। আসলে বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থাটা যেহেতেু সরকারিকরণ না সেজন্যই হয়তো এ ধরনের ঘটনা ঘটে থাকে। আমি কানাডার যে স্বাস্থ্যপ্রতিষ্ঠানে চিকিৎসক হিসাবে কাজ করি সেখানকার সাথে যদি তুলনা করি তাহলে হয়তো ব্যাপারটা বুঝতে আপনার একটু সুবিধা হবে।
সেটা হচ্ছে আমাদের এখানে যখন একজন রোগী আমাদের কাছে আসে এবং তার লক্ষণগুলো বলার পর আমাকে চিন্তা করতে হয় ঐ ব্যক্তিটির কি হয়েছে? এমন একটি চিন্তার পর একটি ধারণা আমার কাছে তৈরি হয়ে যায় ব্যক্তিটির রোগ কিংবা সমস্যা নিয়ে। আমরা এটাকে বলি ডিফারেন্সিয়াল ডায়াগনোসিস (diagnosis )।
রোগী আসার পর তার লক্ষণ শুনে আমাদের মাথায় কয়েকটি ডায়াগনোসিস ঘুরতে থাকে। আর যে ধারণাটা চিকিৎসকের মাথায় ঘুরতে থাকে সেটি নিশ্চিত হওয়ার জন্য আমরা রোগীর গায়ে হাত দিয়ে পরীক্ষা কির এবং স্টেথেস্কোপ দিয়ে পরীক্ষা করে নেই। তারপর একটা সিদ্ধান্তে আসি। কতগুলো বিষয় আছে যেমন ক্লিনিকাল ডায়াগনোসিস যেটি রোগীর হিস্ট্রি এবং ঘটনা শুনে আমরা বুঝে নিতে পারি। আর কিছু বিষয় আমরা বুঝতে পারিনা তখন আমাদেরকে ড্রাগ ইনভেস্টিগেশন করতে হয়। একইসাথে হয়তো কোনো রেডিওলজিক্যাল পরীক্ষার প্রয়োজন হয়।
এই যে ইনভেস্টিগেশনের বিষয়ে কথা বললাম –আমরা যারা কানাডাতে চিকিৎসা পেশায় আছি তাদের যে বিধান সেটি হচ্ছে আমি চাইলেই আমার ইচ্ছেমতো কাউকে কোথায় পাঠাতে পারব না। ইনভেস্টিগেশনটা আসলে রোগীর নামে রেজিস্টার্ড হবে। রোগীর একটা নিজস্ব ইউনিক একটা হেলথ কার্ড নাম্বার থাকে। যেটাকে এখানে মেডিকেয়ার বা হেলথ কার্ড বলা হয়। আর সেই নাম্বারের বিপরীতে এটি এন্ট্রি হবে। এতে বিষয়টি অনেক লিমিটেড হয়ে যায়। আমি ধরুন কোনো রোগীকে একটি পরীক্ষা দিলাম- এটি যেকোনো সময় ঐ হেলথ কার্ড নাম্বারের মাধ্যমে যে কেউ অডিট করে সেটি বের করতে পারে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। তো সেক্ষেত্রে আমাকে খুব চিন্তা করে তার রিপোর্ট লিখতে হয়। আমি রক্ত পরীক্ষা করাতে পারি, এমআরআই করাতে পারি কিন্তু অপ্রয়োজনে কোনো ডায়াগনোস্টিক পরীক্ষা করাতে পারব না।
রেডিও তেহরান: ডা. শাহনাজ কাজী, চিকিৎসার ওষুধ লেখার ক্ষেত্রেও অভিযোগের কথা শোনা যায। অনেক বেশি ওষুধ লেখেন- ইত্যাদি। এর বাস্তবতা কতটুকু?
ডা. শাহনাজ কাজী: এবার আসব ওষুধের কথায়। আমরা যখন এখানে কোনো রোগীর ওষুধ লিখব তখন আমার কিন্তু রেগুলেটরি ফোর্স আছে। সে যেকোনো সময় দেখতে পারে যে কোন সিনট্রম বা ডায়াগনোসিসের জন্য আমি কি কি ওষুধ দিলাম আমরা সব ডাক্তার সেখানে জবাবদিহিতার আওতায় আছি। একজন চিকিৎসক হিসেবে আমার প্রতিটি কাজের জন্য যেকোনো সময় তলব করতে পারে। আমাকে জবাবদিহি করতে হবে কেন তাকে এই ওষুধটি দিয়েছিলাম। সাধারণত একটি প্যারাসিটামলও একটি রোগীর জন্য খারাপ হতে পারে। আমি যে ওষুধটি লিখেছি সেটার কারণ প্রতিষ্ঠা করার জন্য আমার যথেস্ট যুক্তি থাকতে হবে।
তো কানাডাতে এসব বিষয় প্রচণ্ডভাবে রেগুলেট করা হয়। ফলে এখানে এধরনের কাজ করা সম্ভব হয় না। বাংলাদেশে এই ব্যবস্থাটা এখনও আসেনি। যার জন্য আমি বলব যদি কোনো চিকিৎসকের মনে সততা বা নৈতিক শপথগুলো আমরা চিকিৎসক হওয়ার সময় নিয়েছিলাম তাতে যদি ঘাটতি থাকে তখন উনি সেটা নড়চড় করতে পারেন। তো ঐসব বিষয়গুলো আসলে অন্যভাবে ঠিক করতে হবে।
রেডিও তেহরান: ডা.শাহনাজ কাজী,আপনি চিকিৎসা ব্যবস্থার পদ্ধতিগত ক্রটির কথা বললেন। এ ব্যাপারে সচেতন হওয়ার কথা বললেন এবং চিকিৎসককে তার নৈতিক ও আদর্শিক জায়গা থেকে সেবা দিতে হবে- এটাই তো বলতে চেয়েছেন
ডা. শাহনাজ কাজী: জ্বি অবশ্যই আমি একথা বলতে চেয়েছি। চিকিৎসা পেশাটাই একটা মহান পেশা। যখন ছোট বেলায় আমরা রচনা লিখতাম-বড় হয়ে কি হতে চাও বিষয়ে। তখন আমরা লিখতাম ডাক্তার হব এবং মানুষের সেবা করতে চাই। সুতরাং চিকিৎসা পেশার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে সেবা, সততা ও নৈতিকতা। সুতরাং অসততার প্রশ্নই উঠতে পারে না।
শ্রোতাবন্ধুরা! অসুখ হলে আমরা কিভাবে চিকিৎসা করাব সে সম্পর্কে এতক্ষণ কানাডা প্রবাসী চিকিৎসক ডা.শাহনাজ কাজী চমৎকারভাবে তার বক্তব্য তুলে ধরেছেন। এ সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ, উপস্থাপনা ও প্রযোজনা করেছেন গাজী আবদুর রশীদ।
বিশিষ্ট এই ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান বললেন, অসুখ হলে প্রথমে রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। তার পরীক্ষা নিরীক্ষা ও পরামর্শ মতো ওষুধ ব্যবহার এবং প্যাথলজিকাল টেস্ট করাতে হবে। সচেতন হতে হবে। একইসাথে চিকিৎসা ব্যবস্থার ক্রুটি ও ডাক্তারদের নৈতিকতার প্রশ্নটি তুলে ধরেছেন। তো আজকের অনুষ্ঠান থেকে বিদায় নেয়ার আগে আহবান জানাই-আসুন আমরা সবাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলি। ব্যায়ামের অভ্যাস গড়ে তুলি, পরিমিত ও সুষম খাদ্য গ্রহণ করি।#
পার্সটুডে/গাজী আবদুর রশীদ/৩০