এপ্রিল ২৫, ২০২২ ১৯:০৭ Asia/Dhaka

নিউমার্কেট নিয়ে নানা খেলা চলছে। তবে যা ঘটল তা দুর্ভাগ্যজনক। রেডিও তেহরানকে দেয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে একথা বলেছেন সিনিয়র সাংবাদিক, দৈনিক মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী।

১৮ এপ্রিল রাতে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিউমার্কেট এলাকার ব্যবসায়ীদের সংঘর্ষ হয়। রাতের ঐ ঘটনার জের গড়ায় পরদিন মঙ্গলবার পর্যন্ত। দিনভর শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে এখন পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছেন দুজন। আহত হয়েছেন বেশ কয়েকজন।

সংঘর্ষের ঘটনার বেশ পর হত্যাসহ তিনটি মামলা হয়েছে। আসামি করা হয়েছে ১৪০০ জনকে। ঐ সংঘর্ষের ঘটনায় বিএনপি নেতা মকবুল হোসেনকে গ্রেপ্তার করে তিনদিনের রিমান্ডে নেয়া হয়।

হেলমেট পরা অস্ত্রধারী যারা ছিল তারা ছাত্রলীগের কর্মী

এদিকে ঐ ঘটনায় কুরিয়ার সার্ভিস কর্মী নাহিদ হোসেনকে যে কুপিয়ে রক্তাক্ত করেছিল তাকেসহ সংঘর্ষের ঘটনায় হেলমেট পরা অস্ত্রধারী যারা ছিল তাদেরকে শনাক্ত করা হয়েছে। তারা সবাই ছাত্রলীগের কর্মী। মিডিয়াতে খবর এসেছে, নিউমার্কেট এলাকায় সংঘর্ষ-অস্ত্রধারীদের খোঁজ নেই, গ্রেপ্তার বিএনপি নেতা।

নিউমার্কেট এলাকায় ঐ সংঘর্ষের ঘটনা নিয়ে মতিউর রহমানের চৌধুরী বলেন, নিউমার্কেটের ঘটনাটি ঘোলাটে এবং রহস্যময়। পরিকল্পিত কিনা তা তদন্তে বের হবে। তবে ঘটনাটি দুর্ভাগ্যজনক।

তিনি আরও বলেন, এমন ঘটনা এর আগেও অনেকবার হয়েছে। আমি তো ৩০ বছর ধরে দেখছি। তবে এবারের ঘটনাটা পরিকল্পিত এতে কোনো সন্দেহ নেই। ঐ ঘটনার পেছনে উদ্দেশ্য আছে!

পুরো সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলো। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ, উপস্থাপনা ও তৈরি করেছেন গাজী আবদুর রশীদ।

রেডিও তেহরান: জনাব মতিউর রহমান চৌধুরী, বাংলাদেশের রাজধানী নিউমার্কেটে ব্যবসায়ী-দোকান কর্মী ও ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বড় রকমের সংঘর্ষের ঘটনায় l দুইজনের মৃত্যু হয়েছে। এই ঘটনাকে আপনি কীভাবে দেখছেন? বিষয়টি নিয়ে আবারো ছাত্র-রাজনীতি কিন্তু প্রশ্নের মুখে….।

মতিউর রহমান চৌধুরী: দেখুন, ব্যাপারটা আসলে ঘোলাটে। আসলে কি ঘটেছিল সে কথা কেউই বলতে পারছে না। আসলে কি ছাত্ররা টাকা না দিয়ে বারবার খাচ্ছিল এমন অভিযোগ আছে? আবার অন্য অভিযোগও আছে। সেটি হচ্ছে নিউমার্কেটাকে সরিয়ে ঢাকার আগারগাঁওয়ে নিয়ে যাওয়া। তো নানা খেলা ছলছে। অনেকটাই রহস্যজনক। পুলিশ নীরব ও নিষ্ক্রিয় ছিল। এ খবর প্রায় সব গণমাধ্যমে এসেছে আপনারা দেখেছেন। তবে পুলিশের তরফে অবশ্য বলা হয়নি কেন তারা দ্রুত অ্যাকশনে না গিয়ে বিলম্বিত অ্যাকশনে গেছে! এ ঘটনাটা আসলেই দুর্ভাগ্যজনক। ঈদ সামনে মানুষের কেনাকাটা আছে। দু’জনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। আরও কয়েকজন গুরুতর আহত। কেন এটি করা হচ্ছে, এটা পরিকল্পিত কি না তা অবশ্য তদন্ত বের হবে। তবে বাংলাদেশে কোনো তদন্তের রিপোর্ট আজ পর্যন্ত বের হয়নি। আমি শুনিনি কোনো ঘটনার তদন্ত রিপোর্ট বের হয়েছে। কোনো একটি ঘটনার পর পরিস্থিতিকে সামাল দিতে একটি তদন্ত কমিটি হয়। এ পর্যন্ত হাজার হাজার তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। তবে সেই সব তদন্ত কমিটির রিপোর্ট পাওয়ার জন্য আরেকটি তদন্ত কমিটি গঠন করা দরকার বলে আমি মনে করি। কারণ কিছুই তো আলোর মুখ দেখে না। তো সেই পরিস্থিতিতে আপনি যে প্রশ্নটি করেছেন, সেই ঘটনাটি না ঘটলেও পারত। আর ঘটলেও এতদূর যাওয়ার কথা ছিল না।

নিউ মার্কেটের সংঘর্ষ

রেডিও তেহরান:  সংঘর্ষ শুরুর কয়েক ঘণ্টা পর পুলিশ সেখানে উপস্থিত হয়। বিষয়টি নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠছে। আপনি কী বলবেন?

মতিউর রহমান চৌধুরী: দেখুন, এ ব্যাপারে যেটা শোনা যায় এবং গণমাধ্যমে কিছু কিছু ইঙ্গিতও পাওয়া যাচ্ছে। যারা এটি ঘটিয়েছে তারা সবাই শাষক দলের সঙ্গে সংযুক্ত। যে কারণে তাদের বিরুদ্ধে অ্যাকশনে গেলে অন্যরকম পরিস্থিতি হতে পারে। এটা একটি কারণ হতে পারে। আবার এই ঘটনার পর হল বন্ধ ঘোষণা করা হলো অথচ ছাত্ররা তা মানল না। নিশ্চয়ই এতে অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে। যেহেতু এটা রাজনৈতিক কোনো ঘটনা না ফলে যাতে কোনোরকমের জন বিক্ষোভ যাতে না হয় সেটা বন্ধ করা! এভাবে নানারকমের চিন্তাভাবনা আছে। তবে আমি মনে করি পুলিশের ভূমিকা সত্যিকারার্থে রহস্যজনক। পুলিশ চেষ্টা করলে আগে থেকেই পরিস্থিতিটা সামাল দিতে পারত। তাহলে হয়ত প্রাণহানি ঘটত না; ক্ষয়ক্ষতি বাড়ত না। মানুষের মধ্যে সংশয় দেখা দিত না। ঐ ঘটনার দিন ঢাকা শহর স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। যে কারণে আমার মনে হয় এই পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে বা যায় তাতে ঘটনাটিকে সামাল দেয়ার চেষ্টা করছে। তবে পরিস্থিতিটা যেভাবে ঘোলাটে হয়েছে তার পেছনে বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য ছিল। যে কারণে পুলিশ উপস্থিত থাকলেও কোনো অ্যাকশনে যায়নি। আমি একটু আগে রহস্যের কথা বলছিলাম, আসলে দীর্ঘদিন ধরে নিউমার্কেটকে এখান থেকে সরিয়ে বড় বড় কমপ্লেক্স তৈরি করার জন্য রিয়েল স্টেটের ব্যবাসায়ীরা চেষ্টা করছে। এটাকে আগারগাঁওয়ে শিফট করার। তবে ব্যবসায়ীরা এটা মানতে রাজী নয়। তারা এখান থেকে যাবেন না। এরকম কিছু খবরাখবর আছে।

রেডিও তেহরান:  যেসব কারণে সংঘর্ষ শুরু হয়েছে তাতে বাহ্যত ছাত্রদের দায় বেশি বলে অনেকেই মনে করছেন। প্রশ্ন হচ্ছে- এ ধরনের ঘটনায় জড়ানো কী ঢাকা কলেজের শক্ষার্থীদের জন্য জরুরি ছিল? এ ঘটনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ইডেন কলেজের শিক্ষার্থীরাও রাজপথে নেমে আসেন।

মতিউর রহমান চৌধুরী: দেখুন, এটা মোটামুটি অনেকাংশেই সত্য কোনো কোনো জায়গায়। সব জায়গায় অবশ্যই না। আর সবাই তো এক না। কিছু কিছু ছেলেপেলে হয়তো খাওয়া দাওয়া করে বসের কথা বলে।  এরকম অভিযোগ থাকবে এবং আছে। ঢাকা কলেজের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ আজকে নতুন না। আমি গত ত্রিশ বছর ধরে একথা শুনছি। তবে এর আগে কখনও এরকম ব্যাপকভাবে যায়নি। অন্য সময় এরকম ঘটনা ঘটলে ছাত্ররা নিজেদের মধ্যে মিটমাট করে নিয়েছে। হয়তো ব্যবসায়ী নেতারা ছাত্র নেতাদের নিয়ে বসেছে। তবে এসব ছিল বিচ্ছিন্ন ঘটনা। তবে এবারের ঘটনাটা পরিকল্পিত এতে কোনো সন্দেহ নেই। ঐ ঘটনার পেছনে উদ্দেশ্য আছে। আর সেই উদ্দেশ্যটাই আপনাকে এতক্ষণ বলার চেষ্টা করলাম। তবে যেটা বললেন ঢাকা কলেজ, ইডেন কলেজ কিংবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে। হ্যাঁ শুধু এটাই নয় অন্য যেকোনো কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ দুর্ভাগ্যজনক এবং অনভিপ্রেত। আমাদের এই কালচার থেকে বেরিয়ে আসা উচিত। ঐ ঘটনার পর ব্যবসায়ীরা সাহস করতে পারছে না। যদিও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হয়েছে। তবে এটি আবার যে হবে না তার কোনো গ্যারান্টি নেই।

নিউ মার্কেট সংঘর্ষের ঘটনায় বিএনপি নেতা মকবুল গ্রেপ্তার

আরেকটি বিষয় যে দলীয় সংস্কৃতি। দলের লোক হলেই সাত খুন মাফ। তাদেরকে কোনো আইনের আওতায় আনা যাবে না। এই সংস্কৃতি দীর্ঘদিন ধরে চলছে। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে- ছাত্রদের ওপর যে রাজনৈতিক প্রোটেকশনটা দেয়া হচ্ছে এটা বন্ধ না হলে এ ধরনের ঘটনা আজ হয়তো থামল কিন্তু কাল নাও থামতে পারে। পরশু আবার এমন ঘটনা ঘটতে পারে। সেকারণে রাজনৈতিক প্রোটেকশনটা দেয়া বন্ধ করতে হবে। নিজ দলের লোক হলে সাত খুন মাফ। আমারা দেখছি আপনিও দেখছেন। বিদেশে মিডিয়াতে কাজ করেন, মিডিয়ার লোক হিসেবে আপনারাও সব খবর জানেন। আমরাতো দেখছি সামান্য কিছু হলেই সাথে সাথে গ্রেপ্তার হয়ে যায়। কিন্তু ঐ ঘটনার দুদিনেও কেউ গ্রেপ্তার হয়নি। মামলা হয়নি। পরে মামলা হলো এবং গ্রেফতার হলো। তবে আসলে ঐ ঘটনার কি উদ্দেশ্যে এখনও পর্যন্ত স্পষ্ট না।

রেডিও তেহরান: জনাব মতিউর রহমান চৌধুরী, আমরা সাক্ষাৎকারের শেষাংশে চলে এসেছি। তো সবশেষে আপনার কাছে জানতে চাইব, সংঘর্ষে দুই পক্ষই পেট্রোল বোমা ব্যবহার করেছে বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। অর্থাৎ সাধারণ ব্যবসায়ীদের মধ্যে অস্ত্র গোলাবারুদ ব্যবহারের প্রবণতা ছড়িয়ে পড়েছে। বিষয়টিকে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

মতিউর রহমান চৌধুরী: দেখুন, এই ধরণের ঘটনা থেকে অনেক অনেকরকম সুযোগ নিয়ে থাকে এবং নেয়। আপনি যেকথা বললেন, আমিও সেকথা শুনেছি। পুলিশ যদি অ্যাকশানে না যায়, তদন্ত না হয় তাহলে আসল ঘটনার কিছুই তো বের হবে না। বলতে গেলে এ নিয়ে কিছুই হচ্ছে না। আবার ধামাচাপা দিয়ে একটা প্রলেপ দিয়ে দোকান খোলা হলো। ঐ ঘটনায় দেশে এবং বিদেশে মানুষের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়েছে। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে এইরকম একটা জাতীয় সমস্যা তৈরি হবে এটা কেউ কল্পনাও করেনি। আমরাও ভাবতে পারিনি। মিডিয়াও অনেক খবরের ভেতরে যেতে পারছে না নানাবিধ কারণে আপনি সেটা জানেন। আমি সেটা নাইবা বল্লাম, তবে আমি মনে করি এই পরিস্থিতিতে সরকারের আরও কঠোর হওয়া উচিত; আরও দায়িত্বশীল হওয়া উচিত।

আর আমাদের ছাত্রদের মধ্যে যে একটা ভাব-আমি ছাত্র, আমি দলের লোক। আমাকে কিছু করতে পারবে না। এই মনোভাব থাকা উচিত নয়। আবার কিছু ব্যবসায়ী আছেন তারাও উসকে দিয়েছেন- একথাও সত্য। সবকিছু মিলিয়ে সেখানে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা হয়েছে এবং অনেকটা স্বাভাবিক হয়েছে। তবে আমার ধারনা এ ব্যাপারটা এখানেই শেষ হবে না। আরও অনেক দূর গড়াবে।

রেডিও তেহরান: তো জনাব মতিউর রহমান চৌধুরী বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার নিউমার্কেট এলকায় ব্যবসায়ী, দোকান কর্মচারী এবং ঢাকা কলেজের ছাত্রদের মধ্যে সে  সম্পর্কে রেডিও তেহরানকে সময় দেয়ার জন্য আপনাকে আবারও অশেষ ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

মতিউর রহমান চৌধুরী: আপনাকেও ধন্যবাদ।#

পার্সটুডে/গাজী আবদুর রশীদ/২৫

ট্যাগ