সুখের নীড়- পর্ব ১২
ইসলামী ও ইরানি পরিবার বিষয়ক ধারাবাহিক আলোচনা অনুষ্ঠান সুখের নীড় থেকে আপনাদের সবাইকে জানাচ্ছি প্রাণঢালা শুভেচ্ছা।
পরিবার ব্যবস্থার প্রকৃতিটাই এমন যে পরিবারের সদস্যদের পারস্পরিক মায়া-মমতা ও ভালবাসাই সবচেয়ে বেশি দেদীপ্যমান। তাই কোনো কোনো বিশেষজ্ঞের মতে পারিবারিক পরিবেশের প্রকৃতি কঠোর আইন জারি ও হুকুম-নির্দেশের ক্ষেত্র বা প্রতিষ্ঠানগুলোর মতো নয়। পরিবারের ওপর আইনের প্রভাব সামান্য। অন্যদিকে মানবীয় ও নৈতিক মূল্যবোধগুলো চর্চা করতে চাইলে পরিবারগুলোর দরজা সে জন্য সব সময়ই খোলা। অন্য কথায় মায়া-মমতাই পরিবারকে টিকিয়ে রাখার সবচেয়ে বড় ভিত্তি ও পরিবারের মূল প্রাণশক্তি। নারী ও পুরুষের আত্মিক বিকাশ এবং সাফল্যের সর্বোচ্চ শিখরে ওঠার মাধ্যম হল পরিবার। তাই পরিবারের সদস্যদের মধ্যে পারস্পরিক প্রীতি ও মমতা টইটম্বুর মাত্রায় থাকা উচিত। মহানবীর (সা) পবিত্র আহলে বাইতের সদস্য হযরত ইমাম বাক্বির-আ. বলেছেন, মানুষের মধ্যে সেই আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় যে তার স্ত্রী বা স্বামীকে সবচেয়ে বেশি শ্রদ্ধা করে।
গত পর্বের আলোচনার আমরা ইরানে বিয়ের জন্য পাত্র-পাত্রী বাছাইয়ের রীতি ও বিবাহ-পূর্ব অনুষ্ঠান বা রীতিগুলো সম্পর্কে যা বলেছি আজ তার সংক্ষিপ্ত-সার তুলে ধরে পরবর্তী পর্যায়গুলোর বর্ণনা দেব। প্রাথমিক পর্যায়ে পাত্রের অনুপস্থিতিতে বর-পক্ষ কনে পক্ষকে পছন্দ করলে দ্বিতীয় পর্যায়ে পাত্রের উপস্থিতিতে আবারও দুই পক্ষ এক অনুষ্ঠানে মিলিত হয়। পাত্র-পাত্রী পরস্পরকে পছন্দ করার বিষয়ে চূড়ান্ত মত দিলে বিয়ের প্রস্তুতি নেয়া হয়। ফার্সি ভাষায় 'বালেহ্ বরুন' নামে পরিচিত এ অনুষ্ঠানে উভয় পক্ষ পাত্রীর মোহরানা ও অন্যান্য শর্ত নিয়ে কথা বলেন এবং পাত্রীকে আংটি, ফুল ও মিষ্টিসহ নানা উপহার দেয়ার পাশাপাশি বিয়ের শর্তাদি সংক্রান্ত সমঝোতা-পত্রে উভয় পক্ষ স্বাক্ষর করেন। এ পর্যায়ে পাত্র ও পাত্রী বিয়ের জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ বলে বিবেচিত হন। ইরানে এভাবেই বাগদান বা এনগেইজম্যান্ট প্রক্রিয়া শুরু হয় ও কোনো কোনো আধুনিক পরিবারে এ সময় থেকে আনুষ্ঠানিক বিয়ের পূর্ব পর্যন্ত সময়কে বাগদত্ত হওয়ার কাল হিসেবে ধরা হয়। আধুনিক ইরানি পরিবারগুলোতে বাগদানের এ সময়টি দীর্ঘস্থায়ী হয় যাতে পাত্র ও পাত্রী সহজেই পরস্পরকে আরও বেশি জানতে পারেন এবং যাতে তারা আরও ঘনিষ্ঠ হয় কিংবা তারা বিয়ের সিদ্ধান্তে অনড়-অবিচল কিনা তাও বোঝা যায়।
ইরানে বা ফার্সি ভাষায় বাগদানের অনুষ্ঠানকে ন'মজাদি বলা হয়। ন'মজাদির সময় অতিক্রান্ত হলে আক্দ্ বা বিয়ে পড়ানোর অনুষ্ঠান করা হয়। ন'মজাদি ও আক্দ্ এর মধ্যবর্তী সময় ইরানি পাত্র-পাত্রীদের জন্য অত্যন্ত সুখময় মধুর দিন হিসেবে বিবেচিত। তবে ইরানের রাষ্ট্রীয় আইন অনুযায়ী বাগদান বা ন'মজাদি পর্ব সম্পন্ন হওয়ার পরও পাত্র ও পাত্রী পক্ষ ইচ্ছে করলে বিয়ের আয়োজন বাতিলও করতে পারেন। কোনো যুক্তি-সঙ্গত কারণ ছাড়াই পাত্র পক্ষ বিয়ের আয়োজন বাতিল করলে কনে পক্ষ বিয়ের প্রস্তুতি সংক্রান্ত খরচের অর্থ বাবদ পাত্র পক্ষের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়ের অধিকার রাখেন এবং উভয় পক্ষ যেসব উপহার বিনিময় করেছিল তা ফেরত নেয়ারও অধিকার রাখেন।
ইরানে বিয়ের ন'মজাদি বা বাগদানের অনুষ্ঠানগুলোতে কখনও খুব কম ব্যক্তি ও কখনও বিপুল সংখ্যক ব্যক্তি অংশ নেন। এ অনুষ্ঠান কখনও খুব স্বল্প পরিসরে সাদামাটাভাবে পালন করা হয় এবং অঞ্চল ও পরিবারভেদে বেশ সাড়ম্বরেও তা পালন করা হয়। তবে যে কোনো বাগদান অনুষ্ঠানেই কনেকে আংটি, নামাজের পোশাক, ফুল, মিষ্টি কিংবা উভয় পক্ষের সম্মতিতে স্বর্ণমুদ্রা বা স্বর্ণের বার ও সংসারের নানা জরুরি দ্রব্য দেয়া হয়। ন'মজাদি পর্বের পর উভয় পরিবারের মধ্যে যোগাযোগ ও যাওয়া-আসা বৃদ্ধি পায়। কোনো কোনো ইরানি পরিবারে, বিশেষ করে পাত্র পক্ষে এমন ধারণা দেখা যায় যে ন'মজাদি পর্ব সম্পন্ন হওয়ার অর্থই হল পাত্রী বা কনে তাদের ছেলের বউ হয়ে গেছেন সার্বিকভাবে। অন্যদিকে কোনো কোনো পরিবার, বিশেষ করে পাত্রী পক্ষ মনে করেন যে চূড়ান্ত আকদ্ অনুষ্ঠান না হওয়া পর্যন্ত পাত্র এখনও তাদের মেয়ের জন্য পরপুরুষ এবং পাত্র-পাত্রী কেবল দুই পরিবারের অন্য সদস্যদের সম্মিলিত সমাবেশেই পরস্পরের সঙ্গে দেখা সাক্ষাতের অধিকার রাখে ও তারা অন্যদের বাদ দিয়ে নির্জনে সফরে যাওয়ার অধিকারও রাখেন না।
ইরানের বিভিন্ন অঞ্চলে বিবাহ-পূর্ব বাগদান অনুষ্ঠান হিসেবে খ্যাত নমজাদির অনুষ্ঠানের রীতি ও কায়দায় অনেক পার্থক্য দেখা যায়। ইরানের কোনো কোনো অঞ্চলে নমজাদি বা বাগদানের দুই বছর পর বিয়ের অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। এর কারণ হল বরকে সংসারের নানা জরুরি পণ্য বা যৌতুক সংগ্রহ করতে হয় বিয়ের আগেই। বিয়ের পরবর্তী আনুষ্ঠানিকতাও ইরানের নানা অঞ্চলে বিভিন্ন ধরনের। যেমন, ইরানের বেলুচিস্তান অঞ্চলে বিয়ের পর বা আক্দ্ অনুষ্ঠানের পর কনেকে বরের বাড়িতে না নিয়ে বরং বরকেই কনের বাড়িতে নেয়া হয়!
দাম্পত্য জীবনকে সুখময় করতে স্বামী ও স্ত্রীর উচিত পরস্পরের দোষ-ত্রুটি প্রচার না করে বরং সেগুলো ঢেকে রাখা। পবিত্র কুরআনে সুরা বাক্বারার ১৮৭ নম্বর আয়ার একাংশে এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে: তারা তোমাদের পরিচ্ছদ বা আবরণ তথা পোশাক এবং তোমরা তাদের পরিচ্ছদ বা আবরণ তথা পোশাক।#
পার্সটুডে/এমএএইচ/আবুসাঈদ/ ০৮
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।