মে ০৯, ২০২২ ১৯:৪৭ Asia/Dhaka
  • আফগানিস্তানে উগ্র সালাফি গোষ্ঠীর প্রভাব বিস্তারের রহস্য: পর্ব-তিন

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আফগানিস্তানের ঘটনাবলী বিশেষ করে তালেবান গোষ্ঠী ওই দেশটির ক্ষমতা নেয়ার পর উগ্র তাফকিরি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী দায়েশ বা আইএস জঙ্গিদের একের পর এক হামলায় শুধু যে শত শত নিরীহ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে তাই নয় একইসঙ্গে দেশটির সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তাও চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে। আফগানিস্তানের প্রতিবেশী দেশগুলোও হুমকির মুখে রয়েছে এবং তারা গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এ সংক্রান্ত ধারাবাহিক আলোচনার আজকের অনুষ্ঠানে আমরা পাকিস্তানে উগ্র ওয়াহাবি সালাফি গোষ্ঠীর প্রভাব বিস্তারের কারণ ও তাদের প্রতি কয়েকট

গত অনুষ্ঠানে আমরা ১৯৭৮ সালের ২৭ এপ্রিলে আফগানিস্তানে কমিউনিস্টদের অভ্যুত্থানের আগে ওই দেশে প্রভাব বিস্তারে সৌদিপন্থী ওয়াহাবি সালাফিদের প্রচেষ্টা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছিলাম এবং সেই সময়টাতে ওয়াহাবিদের ব্যর্থতার কিছু দিক তুলে ধরেছিলাম। আফগানিস্তানে কমিউনিস্টদের অভ্যুত্থানের আগে আরেকটি যে কারণে ওয়াহাবিরা প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি সেটা হচ্ছে ওয়াহাবি সালাফিরা শাফায়াত, তাওয়াস্সুল ও কবর বা মাজার জিয়ারতের বিরোধিতা করতো। কিন্তু আফগানিস্তানের সুন্নি হানাফি মাজহাবে বিশ্বাসী জনগণ ছিল সুফিবাদী তরিকতপন্থীদের দ্বারা প্রভাবিত। আফগানিস্তানে শত শত মাজার ও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির কবর রয়েছে। জনগণ এসব মাজার ও কবরকে বিশেষভাবে শ্রদ্ধা করে। কিন্তু ওয়াহাবি সালাফিরা মাজার ও কবর যিয়ারত করাকে হারাম ও বেদাত ফতোয়া দিয়ে জনগণকে কবরে না যাওয়ার পরামর্শ দিত। এসব কারণে আফগান জনগণ সালাফিদেরকে গ্রহণ করতে পারেনি এবং সালাফিরাও আফগানিস্তানে খুব বেশি প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। এক পর্যায়ে ক্ষুব্ধ আফগান জনগণ ওয়াহাবি সালাফিদেরকে ধর্ম প্রচারের অনুমতি দেয়নি। ফলে ওয়াহাবিদের কার্যক্রম আলাদা মসজিদের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছিল।

কান্দাহারের একজন প্রত্যক্ষ অধিবাসী এ ব্যাপারে বলেছেন, কান্দাহারে ওয়াহাবি সালাফিদের মাত্র একটি মসজিদ ছিল এবং এটাকে সবাই চিনতো। তাই  যারাই সালাফিদের মসজিদে যেত জনগণ তাদেরকেই ঘৃণার চোখে দেখতো। এ কারণে ওয়াহাবি সালাফিরা তাদের মসজিদে যেতে সবাইকে উৎসাহিত করার জন্য বিপুল অর্থ ব্যয় করতো। জনপ্রতি এই অর্থের পরিমাণ ছিল অন্তত একজন শ্রমিকের দৈনিক মজুরির সমান। কিন্তু তারপরও ওয়াহাবিরা আফগান জনগণকে তাদের দিকে টানতে ব্যর্থ হয়।

১৯৭৮ সালের ২৭ এপ্রিলে আফগানিস্তানে কমিউনিস্টদের অভ্যুত্থানের আগে ওয়াহাবি সালাফিরা আফগানিস্তানে কোনো জায়গা করতে তো পারেনি এমনকি পাকিস্তানের পোশতু অধ্যুষিত এলাকায়ও কোনো গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। ওই এলাকার বেশিরভাগ মানুষ সুফিবাদী তরিকত পন্থী হওয়ায় কিংবা বড় জোর দেওবন্দি ধারায় থাকায় সেখানে ওয়াহাবি সালাফিরা কোনো প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি বরং মানুষ তাদেরকে ঘৃণা করতো।

পাকিস্তানের পোশতু অধ্যুষিত এলাকায় প্রথম যে ব্যক্তি ওয়াহাবি সালাফিদেরকে জায়গা করে দিয়েছিলেন তিনি হচ্ছেন মৌলভি মোহাম্মদ তাহের যিনি মাওলানা তাহের নামে পরিচিত ছিলেন। তিনি ছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কমান্ডার মেজর অমেরের পিতা। মাওলানা তাহের 'মাওলানা পাঞ্জপির' নামেও খ্যাতিমান ছিলেন। কারণ তিনি পাকিস্তানের খায়বার পাখতুন খোয়া প্রদেশের সাওয়ারি উপশহরের পাঞ্জপির এলাকার বাসিন্দা ছিলেন। সে সময় তিনিই ছিলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি ওয়াহাবি সালাফিদেরকে ওই অঞ্চলে আমন্ত্রণ জানান।

প্রথম দিকে স্থানীয় জনগণের তীব্র প্রতিবাদ ও বিরোধিতার সম্মুখীন হয় সালাফিরা। জনগণ মাওলানা পাঞ্জপিরকে ও সালাফিদেরকে অমুসলিম ও ঘৃণার যোগ্য বলে মনে করতো। কিন্তু পর্যায়ক্রমে এবং আফগানিস্তানের পরিবর্তিত পরিস্থিতির সুযোগে ওয়াহাবি সালাফিরা পাকিস্তানের পাখতুন খোয়া প্রদেশ এবং আফগানিস্তানের উপজাতি অধ্যুষিত এলাকায় নিজেদের জায়গা করে নিতে কিছুটা সক্ষম হয়। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে মাওলানা পাঞ্জপিরের ছেলে মেজর অমের ও কর্নেল ইমাম ছিলেন এমন সব ব্যক্তি যারা তালেবান গোষ্ঠী তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন।

১৯৭৮ সালের ২৭ এপ্রিলে আফগানিস্তানে কমিউনিস্টদের অভ্যুত্থানের পর ওয়াহাবি সালাফিরা সমগ্র ওই অঞ্চলে তাদের ভ্রান্ত ও উগ্র আকিদা বিশ্বাস ছড়িয়ে দেয়ার বিরাট সুযোগ পায়। মূলত তখন থেকে আফগানিস্তানে সৌদি আরবের প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্র তৈরি হয়। আগেই যেমনটি বলেছি উগ্র ওয়াহাবি সালাফি আকিদা বিশ্বাসের সঙ্গে আফগানিস্তানের জনগণের পরিচয় প্রায় ১০০ বছর ধরে। ১৯১২ সালে সৌদি ওয়াহাবি মুফতি শেইখ মোহাম্মদ শারেহ মদিনা শহর থেকে মধ্যএশিয়ার ফারগানে উপত্যকা এলাকায় যান এবং সেখানকার স্থানীয় জনগণের কাছে সালাফি ও ওয়াহাবি আকিদা বিশ্বাস তুলে ধরেন। তিনি বেশ কিছু সংখ্যক অনুসারী পেয়ে যান এবং এরপর তারই অনুসারী বা সমর্থকরা আফগানিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় বাদাখশান, কুনার, খোস্ত ও নুরেস্তানের উপজাতি অধ্যুষিত এলাকায় প্রবেশ করে সেখানে সালাফি মতবাদ প্রচারে ভূমিকা রাখে। কিন্তু ওয়াহাবিরা প্রথমে তাদের আকিদা বিশ্বাস নিয়ে আফগানিস্তানে প্রভাব বিস্তার করলেও কমিউনিস্ট বিপ্লবের পর তারা উগ্রতার দিকে সাধারণ মানুষকে ধাবিত করে এবং জনগণকে জিহাদের দিকে আহ্বান জানায়। 

সৌদি আরবের নেতৃত্বে আরবরা দুই দিক থেকে তাদের সালাফি আকিদা বিশ্বাস আফগানিস্তানে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা চালায়। প্রথমত, তারা আফগানিস্তানে হাজার হাজার ধর্মীয় শিক্ষা কেন্দ্র ও মাদ্রাসা এবং দুটি মসজিদ তৈরি করে। সেখানে গড়ে ওঠা জিহাদি গ্রুপে বহু আরব স্বেচ্ছাসেবী সরাসরি যোগ দিয়েছিল। এ ছাড়া, সৌদি আরব আফগানিস্তানে ওয়াহাবি মতবাদের বিস্তার, ইরানের ইসলামি বিপ্লবের বিরুদ্ধে পাল্টা আরেকটি শক্তিকে দাঁড় করানো, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে বিপুল পুঁজি বিনিয়োগ এবং সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে আফগানদের যুদ্ধে কোটি কোটি ডলার ব্যয় করেছে। বিশেষ করে সালাফি চিন্তাধারায় প্রভাবিত আরব যোদ্ধাদেরকে আফগানিস্তানে মোতায়েনের ক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা রেখেছিল সৌদি আরব।

সৌদি আরব ১৯৮১ সালে এবং ১৯৮২ সালে আফগানিস্তানে দুটি ব্যাংক স্থাপন করে। এ ব্যাংকের মাধ্যমে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধে রিয়াদ আফগানদেরকে আর্থিক সহায়তা দিয়েছিল। এমনকি বিভিন্ন দেশের মসজিদ ও দাতব্য সংস্থার পক্ষ থেকেও সাধারণ জনগণের কাছ থেকে সংগৃহীত বিপুল অর্থ সৌদি ব্যাংকের মাধ্যমে আফগানিস্তানে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হতো। (music)

ওয়াহাবি সালাফিদের মতবাদ প্রচারের লক্ষ্যে এসব মসজিদ ও মাদ্রাসা শুধু যে পাকিস্তানের খাইবার পাখতুন খোয়া, বেলুচিস্তান ও উপজাতি অধ্যুষিত অন্যান্য এলাকায়  প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে তাই নয় একই সঙ্গে পাকিস্তানের দূরবর্তী পাঞ্জাব ও সিন্ধু প্রদেশেও তৈরি করা হয়েছে। সৌদি আরব এসব মসজিদ ও মাদ্রাসায় উগ্র সালাফি মতবাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে ও বিশেষ বাহিনী তৈরী করে তাদেরকে আফগানিস্তানের জিহাদে পাঠাতো। এভাবে ধর্মের নামে বিকৃত ওয়াহাবি মতবাদ প্রচার এবং উগ্র একটি গোষ্ঠী তৈরিতে বিপুল অর্থ ব্যয় করেছিল সৌদি আরব।#

পার্সটুডে/এমআরএইচ

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন। 

ট্যাগ