জানুয়ারি ১৪, ২০২৪ ১৭:৫২ Asia/Dhaka
  • ইসরাইলের বিরুদ্ধে হামাসের আল আকসা তুফান অভিযানের ফলাফল-(পর্ব-৪)

গত পর্বের আলোচনায় আমরা গাজা যুদ্ধে হামাসের অর্জন সম্পর্কে কথা বলেছি। আজকের চতুর্থ পর্বের আলোচনায় আমরা আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক অঙ্গনে আমেরিকা কিভাবে ইসরাইলকে সহযোগিতা করছে সে সম্পর্কে কথা বলবো।

জাতিসংঘ সনদের ৫১ অনুচ্ছেদে আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বৈধ প্রতিরক্ষার অধিকারকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। জাতিসংঘ সনদের এই অনুচ্ছেদ অনুসারে, মার্কিন সরকার দাবি করছে যে, ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর ইসরাইলের আত্মরক্ষার অধিকার রয়েছে। এ অজুহাতে তারা গাজার জনগণের বিরুদ্ধে ইসরাইলের যুদ্ধ, অপরাধযজ্ঞ ও গণহত্যাকে আত্মরক্ষা হিসাবে দেখানের চেষ্টা করছে।

কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল তাদের বর্বর আগ্রাসনকে আত্মরক্ষা বলে দাবি করলেও তাদের আত্মরক্ষার কোনো অধিকার নেই। কেননা প্রথমত, ইসরাইল একটি দখলদার শক্তি। ৭৫ বছর আগে ইসরাইল ফিলিস্তিন ভূখণ্ড দখলের কাজ শুরু করে এবং এখনো তা অব্যাহত রয়েছে। দ্বিতীয়ত, ইসরাইলে হামাসের আক্রমণ ছিল গত ৭৫ বছরের সহিংসতা, দমন-পীড়ন ও অপরাধের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া মাত্র। এমনকি জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্থেনিও গুতেরেসও বলেছেন, "কোনো কারণ ছাড়া হামাস ইসরাইলে হামলা চালায়নি।"

২০২৩ সালের শুরুতে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর নেতৃত্বে চরমপন্থী ও বর্ণবাদী সরকার গঠনের পরপরই তারা ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে আগ্রাসন ও নির্যাতনের মাত্রা বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। সম্প্রতি গাজায় যুদ্ধ শুরুর আগে সাত মাসে যে পরিমাণ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করা হয়েছে আগের বছর ১২ মাসে ঠিক ততখানি ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছিল ইসরাইলি সেনারা। এসব কারণে গত ৭ আগস্ট হামাস ইসরাইলে যে হামলা চালিয়েছে তা ছিল সম্পূর্ণ বৈধ প্রতিরক্ষা। কিন্তু আমেরিকা দখলদার ইসরাইলের আত্মরক্ষার নামে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ইসরাইলের পক্ষে সাফাই গাইছে এবং ইসরাইলের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক যে কোনো উদ্যোগ গ্রহণে বাধা দিচ্ছে। শুধু মার্কিন সরকারের বাধার কারণে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ এখন পর্যন্ত ইসরাইলের বিরুদ্ধে কেনো পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে।

গত ৯ ডিসেম্বর অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকার বিরুদ্ধে চলমান ইসরাইলি গণহত্যা অবিলম্বে বন্ধ করার আহ্বান জানিয়ে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধবিরতির যে প্রস্তাব তোলা হয়েছিল তাতে ভেটো দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। 

নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে সবগুলো আরব দেশের পাশাপাশি ৫৫টি দেশের পক্ষ থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাত প্রস্তাবটি উত্থাপন করে।  চীন, রাশিয়া ও ফ্রান্সসহ নিরাপত্তা পরিষদের ১৫টি স্থায়ী ও অস্থায়ী সদস্যদেশের মধ্যে ১৩টি প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয়। কিন্তু প্রস্তাবটির বিরোধিতা করে সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা এবং ভোটদানে বিরত থাকে সাবেক উপনিবেশবাদী দেশ ব্রিটেন। ব্রিটিশ সরকারের এই আচরণ প্রসঙ্গ দেশটির লেবার পার্টির সাবেক নেতা জেরেমি করবিন বলেছেন, “আজ রাতে যুক্তরাজ্য যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়ে জাতিসংঘের একটি প্রস্তাব সমর্থন করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।” তিনি বলতে চেয়েছেন, ব্রিটেন ভোটদানে বিরত থেকে নিরপেক্ষ অবস্থান নেয়নি বরং গাজায় যুদ্ধ বন্ধ করার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে।

নিরাপত্তা পরিষদের ওই ভোটাভুটির আগে জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস প্রস্তাবটি পাস করার জন্য সদস্য দেশগুলোর প্রতি জোর আবেদন জানিয়ে বলেছিলেন, গাজা উপত্যকার নিরপরাধ নারী ও শিশুদের প্রাণ বাঁচাতে এই মুহূর্তে যুদ্ধ বন্ধ করতে হবে।

বিশ্ব মোড়লের দাবিদার আমেরিকার ভেটোতে প্রস্তাবটি পাস না হওয়ায় সংযুক্ত আরব আমিরাতের উপ রাষ্ট্রদূত মোহাম্মাদ আবুশাবাব দুঃখ প্রকাশ করে বলেছেন, অবিরাম বোমাবর্ষণের শিকার গাজাবাসীর কাছে আমরা কোনো ভালো বার্তা পাঠাতে পারলাম না।

প্রকৃতপক্ষে, অবৈধভাবে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত মার্কিন সরকার ইসরাইলের বিরুদ্ধে উত্থাপিত ৫০টিরও বেশি প্রস্তাবে ভেটো দিয়েছে। বর্তমানে গাজায় যুদ্ধের শেষ ৪০ দিনের মধ্যে, ৫ টি প্রস্তাব জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে পেশ করা হয়েছিল, যার মধ্যে ৪টি প্রস্তাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ফ্রান্স ভেটো দিয়েছিল এবং মাত্র ৪০ দিন পর, নিরাপত্তা পরিষদে একটি প্রস্তাব অনুমোদিত হয়েছিল, যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভোট দেওয়া থেকে বিরত ছিল। যদিও জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ এবং ইউনেস্কোতে ইসরাইল বিরোধী প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে পাশ হয়েছিল কিন্তু প্রস্তাব বাস্তবায়নের নিশ্চয়তা দিতে পারে কেবলমাত্র নিরাপত্তা পরিষদ। তাই গাজায় যুদ্ধ বন্ধের প্রস্তাবে আমেরিকা ভেটো প্রদান করে প্রকৃতপক্ষে নিরাপত্তা পরিষদকে অসম্মানিত করেছে এবং গাজার জনগণের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে।  

ইসরাইলের সমর্থনে আমেরিকার আরেকটি পদক্ষেপ হলো আরব ও অন্যান্য মুসলিম দেশগুলোকে ইসরাইলের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেয়া থেকে বিরত থাকার জন্য চাপ ও হুমকি সৃষ্টি। ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় যুদ্ধ শুরুর পর মার্কিন কর্মকর্তারা বহুবার পশ্চিম এশীয়া অঞ্চল সফর করেছেন এবং এই অঞ্চলের আরব দেশগুলোর কর্মকর্তাদের সাথে দেখা করেছেন। যুদ্ধকালীন অবস্থায় কোনো দেশ যাতে ইসরাইলের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের পদক্ষেপ না নেয় সেজন্য মার্কিন কর্মকর্তারা আরব সরকারগুলোকে সতর্ক করে দিয়েছিল। ইয়েমেনের আনসারুল্লাহর নেতা আব্দুল মালিক আল-হুথি এ প্রসঙ্গে বলেছেন, "মার্কিন কর্মকর্তারা আরব ও অন্য মুসলিম দেশগুলোর ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করেছে যাতে তারা কেউ গাজার জনগণকে সহায়তার যেকোনো প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে।"

এদিকে, ভূ-মধ্যসাগরসহ পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে যুদ্ধজাহাজ এবং সেনা পাঠিয়ে মার্কিনীরা সবাইকে দেখিয়ে দিয়েছে যে তারা প্রয়োজনে ইসরাইলের সমর্থনে সামরিক পদক্ষেপ নেবে। এটা ঠিক যে আরব ও অন্য মুসলিম সরকারগুলোর আচরণে ফিলিস্তিনিদের প্রতি জোরালো সমর্থনের প্রমাণ পাওয়া যায়নি কিন্তু এ ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হুমকি ও ভীতি প্রদর্শন তাদের এই নিস্ক্রিয়তার পেছনে ভূমিকা রেখেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ইয়েমেনের আনসারুল্লাহ নেতা যেমনটি বলেছেন, গাজায় ইসরাইলি বর্বরতার প্রতি আমেরিকা ও ইউরোপীয় দেশগুলোর সমর্থন দেয়া থেকে পাশ্চাত্য সমাজের জঘন্য মানসিকতা যেমন প্রকাশ পেয়েছে তেমনি অধিকার ও স্বাধীনতার ব্যাপারে তাদের দাবির মিথ্যাচারিতাও প্রমাণিত হয়েছে।'  #

পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ