আফগানিস্তানে উগ্র সালাফি গোষ্ঠীর প্রভাব বিস্তারের রহস্য: পর্ব-পাঁচ
গত পর্বের আলোচনায় আমরা আফগানিস্তানে ওয়াহাবি সালাফি চিন্তাধারা বিস্তারে বেশ কয়েকজন ব্যক্তির ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করেছি। বিশেষ করে পাকিস্তানে ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা মাদ্রাসা, দাতব্যকেন্দ্র ও প্রশিক্ষণ শিবির প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে উগ্র সালাফি চিন্তাধারা প্রচারের কথা উল্লেখ করেছি।
এসব কেন্দ্রে সৌদি আরবসহ আরো কয়েকটি দেশ থেকে সালাফি চিন্তাধারায় প্রভাবিত আরব যোদ্ধাদেরকে এনে প্রশিক্ষণ দেয়া হতো এবং পরে তাদেরকে আফগানিস্তানে পাঠানো হতো। এ ভাবে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে সালাফি মতবাদের প্রভাব বাড়তে থাকে। অবশ্য পাকিস্তানে অনেক আগে থেকেই দেওবন্দের ছত্রছায়ায় ওয়াহাবি সালাফি চিন্তাধারার বিস্তার লাভ করেছিল। যদিও দেওবন্দ ওয়াহাবিদের দ্বারা আংশিক প্রভাবিত হয়েছিল কিন্তু এ দুই মতাদর্শের মধ্যে মৌলিক পার্থক্যও ছিল।
রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে বিভিন্ন জিহাদি গ্রুপগুলোকে যারা নেতৃত্ব দিতেন তারা পাকিস্তানের পেশোয়ারে অবস্থান করতেন। সেখানেই দেওবন্দ ও ওয়াহাবিদের মধ্যে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এ কারণে আফগানিস্তানের বিভিন্ন দল ও জিহাদি সংগঠনের নেতাকর্মীরা নিজেদেরকে অভিন্ন চিন্তা ও আদর্শ অর্থাৎ সালাফি দৃষ্টিভঙ্গির অনুসারী বলে মনে করতো।
কিছু কিছু চিন্তাভাবনা দেওবন্দ ও সালাফিদেরকে কাছাকাছি নিয়ে আসলেও অনেক ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে বেশ দূরত্বও ছিল। এটা আরো বেশি স্পষ্ট হয়ে ওঠে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে মুজাহিদদের বিজয়ের পর। বিভিন্ন জিহাদি গ্রুপের অভ্যন্তরীণ মতবিরোধ, আঞ্চলিক দেশগুলো বিশেষ করে পাকিস্তানের হস্তক্ষেপ, ইসলামি আইন বা নীতি শাস্ত্র নিয়ে ধর্মীয় সংগঠনগুলোর পরস্পর বিরোধী অবস্থান প্রভৃতি কারণে তাদের একক কোনো নেতৃত্ব গড়ে উঠেনি। ফলে ধর্মীয় ও জাতিগত বিরোধ ক্রমেই প্রকট আকার ধারণ করে এবং তারা ক্ষমতার লড়াইয়ে লিপ্ত হয়। সালাফি চিন্তাধারায় প্রভাবিত আরবরা প্রথম থেকেই নিজেদের নিরপেক্ষ অবস্থান ধরে রাখার চেষ্টা চালায় এবং তাদের কেউ কেউ আফগানিস্তানের গৃহযুদ্ধ থেকে নিজেদেরকে দূরে সরিয়ে রাখে। তারা এ অঞ্চল ত্যাগ করে মধ্যপ্রাচ্যের অন্য এলাকা অবস্থান নিলেও অনেকে আবার আল-কায়দার পতাকা তলে আফগানিস্তানেই থেকে যায়। পোশতুন জাতির সঙ্গে মিশে গিয়ে এসব আরব আফগান তালেবানকে সমর্থন দেয়। অনেক আরব আফগান পশতুন ভাষী মেয়েদের বিয়ে করে তাদের সঙ্গে আত্মীয়তার সম্পর্ক গড়ে তোলে।
এভাবে আফগানিস্তানের বিভিন্ন গ্রুপ, ধর্মীয় সংগঠন ও জাতিগোষ্ঠীর লোকেরা ওয়াহাবি সালাফিদের দ্বারা প্রভাবিত হতে থাকে।
গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ারের ইসলামি দল, ইউনুস খালেসের ইসলামি দল, আব্দুর রব আল রাসুল সাইয়াফের ইসলামি ইউনিয়ন পার্টি এবং তালেবানের কোনো কোনো অংশের কথা উল্লেখ করা যায় সালাফিদের দ্বারা কমবেশি প্রভাবিত হয়েছিল। কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ে একদল তরুণের আন্দোলনের মাধ্যমে গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ারের হেজবে ইসলামি দলের আত্মপ্রকাশ ঘটে এবং বলা যায় আফগানিস্তানে কমিউনিজমের প্রভাব ঠেকানোই ছিল তাদের মূল উদ্দেশ্য। এরপর এই দলের নেতারা পাকিস্তানে গিয়ে একদল সমর্থককে নিয়ে সেখানেও তাদের শাখা বিস্তার করেন। বলা হয় আফগানিস্তানে পাকিস্তানের সামরিক, রাজনৈতিক ও আদর্শিক প্রভাব বিস্তারে হেকমতিয়ারের হেজবে ইসলামি দলের ভূমিকা রয়েছে। এ ছাড়া, ১৯৮৭ সালে সালাফি জিহাদিরা আফগান সীমান্তবর্তী পাকিস্তানের শিয়া অধ্যুষিত পারাচিনার এলাকায় যে ভয়াবহ হামলা চালিয়ে ব্যাপক রক্তপাত ঘটিয়েছিল তার নেতৃত্বে ছিলেন হেকমতিয়ার।
তবে আরব ও আল কায়দার মতো সংগঠনের সঙ্গে হেকমতিয়ারের দলের যে খুব ঘনিষ্ঠতা ছিল এমন নয়। তিনি সোভিয়েতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চলাকালে সৌদি আরবের কাছ থেকে আর্থ-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সহযোগিতা পেলেও আরব ও আল কায়দা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থার সাথে তার সহযোগিতা উল্লেখযোগ্য মাত্রায় ছিল না।
তারা অন্য আরব দেশের কাছ থেকেও সাহায্য পেত যা কিনা পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা বাহিনীর মাধ্যমে তাদের হাতে আসতো। এ কারণে এই দলটিকে সালাফিদের সাথে সম্পর্কযুক্ত করে দেখা হয়। এটিই একমাত্র দল যারা তালেবান পরবর্তী সময় দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে নিজেদেরকে দূরে সরিয়ে রেখেছিল। প্রায় ১৫ বছর পর তারা ২৬ ধারা বিশিষ্ট সমঝোতা পত্রের ভিত্তিতে আফগানিস্তানের নির্বাচিত সরকারের সঙ্গে সন্ধি চুক্তিতে সই করে। যদিও হেকমতিয়ারের গায়ে উগ্র দায়েশ বা আইএস জঙ্গি গোষ্ঠী ও সালাফিদের তকমা লেগে আছে কিন্তু তিনি তার বেশ কিছু গ্রন্থে ওয়াহাবি সালাফি চিন্তা ধারার বিরোধী উল্লেখ করে নিজেকে সুন্নি হিসেবে তুলে ধরেছেন। মোটকথা তার আচরণ ও কর্মকাণ্ডে প্রমাণিত হয় তিনি একজন উচ্চাভিলাষী রাজনৈতিক সুবিধাবাদী ব্যক্তি।
হেকমতিয়ার যখন পাকিস্তানে ছিলেন তখন আফগানদের জন্য আমেরিকা যে বিপুল সাহায্য পাঠাতো তার বেশিরভাগই হেকমতিয়ারের মাধ্যমেই আফগানদের কাছে পৌঁছাতো। যদিও তালেবান শাসনের প্রথম দিকে হেকমতিয়ার আমেরিকার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন কিন্তু পরে তাদের পতনের পর হঠাৎ তিনি আফগান সরকারে যোগ দিয়ে রাজধানী কাবুলে ফিরে যান। ফলে আবারো তিনি আমেরিকার দেয়া সাহায্য সহযোগিতা থেকে লাভবান হতে থাকেন। এমনকি আফগানিস্তানে দায়েশ বা আইএস জঙ্গিদের তৎপরতা বিশেষ করে শিয়া মুসলমানদের ওপর জঙ্গিদের হামলাকে তিনি সমর্থন করতেন। কিন্তু এখন তালেবান ফের ক্ষমতায় আসার পর গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ার বলেছেন, তালেবানই একমাত্র সরকার যাদের প্রতি আমার পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। তবে সম্প্রতি তালেবান কর্তৃপক্ষ দায়েশ বা আইএস জঙ্গিদের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার অভিযোগে হেকমতিয়ারের অনুগত বেশ ক'জন সদস্যকে গ্রেফতার করেছে। হেকমতিয়ার এ ঘটনার প্রতিবাদ জানালেও এতে এটাও প্রমাণিত হয়েছে যে দায়েশের সাথে তার সম্পর্ক রয়েছে।
আফগানিস্তানে ওয়াহাবি সালাফি চিন্তাধারার অনুপ্রবেশে আরো যারা ভূমিকা রেখেছে তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, মৌলভি ইউনুসের নেতৃত্বে আরেকটি ইসলামি সংগঠন। তিনি ১৯৬০ সালে মুসলিম ব্রাদারহুডে যোগ দেন এবং তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি সাইয়্যেদ কুতুবের রচনা অনুবাদ করেন। তিনি ড. নাজিবুল্লাহর সরকারের পতনের পর তালেবান সরকারে যোগ দিয়েছিলেন।
এ ছাড়া, আব্দুর রব আল রাসুলের নেতৃত্বে ১৯৮০ সালে ইসলামি ইউনিয়ন পার্টি গঠিত হয়। তার সঙ্গে সাবেক সৌদি রাজা ফাহাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। তিনি আফগানিস্তানে ওয়াহাবি সালাফি মতবাদ প্রচারে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছিলেন।
মোটকথা, এসব ইসলামি দল ও সংগঠন আফগানিস্তানে ওয়াহাবি সালাফি মতবাদ প্রচারে ভূমিকা রাখে অথবা আইএস জঙ্গিদের সাথে তাদের কোনো না কোনো সম্পর্ক গড়ে ওঠে। বলা যায় আফগানিস্তানে দরিদ্রতার সুযোগ নিয়ে তারা সেখানে ওহাবিয়াত প্রতিষ্ঠা করে। #
পার্সটুডে/এমআরএইচ
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।