আগস্ট ১৪, ২০২২ ১৭:০৬ Asia/Dhaka

পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠানের 'কুরআনের আলো'র সূরা ক্বাফ'এর সংক্ষিপ্ত তাফসিরের আলোচনা শেষ করেছি। এখন সূরা জারিয়াতের সংক্ষিপ্ত তাফসির শুরু করব। মক্কায় অবতীর্ণ এ সূরায় পার্থিব জীবন ও পরকাল, সৃষ্টজগতে আল্লাহ তায়ালার অস্তিত্বের নির্দশন, কয়েকজন নবীর কাহিনী এবং পথভ্রষ্ট কিছু জাতির পরিণতি বর্ণনা করা হয়েছে। এই সূরার ১ থেকে ৬ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:

 بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِیم

وَالذَّارِیَاتِ ذَرْوًا ﴿١﴾ فَالْحَامِلاتِ وِقْرًا ﴿٢﴾ فَالْجَارِیَاتِ یُسْرًا ﴿٣﴾ فَالْمُقَسِّمَاتِ أَمْرًا ﴿٤﴾ إِنَّمَا تُوعَدُونَ لَصَادِقٌ ﴿٥﴾ وَإِنَّ الدِّینَ لَوَاقِعٌ ﴿٦﴾

“বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম।”

“শপথ সেই বাতাসের যা তীব্র বেগে [বিভিন্ন জিনিস] উড়িয়ে নিয়ে যায়।” (৫১:১)

“অতঃপর শপথ বোঝা বহনকারী মেঘপুঞ্জের।” (৫১:২)

“অতঃপর শপথ স্বচ্ছন্দ গতিময় নৌযানের।” (৫১:৩)

“অতঃপর শপথ [আল্লাহর নির্দেশে] কর্মসমূহ বণ্টনকারী ফেরেশতাগণের।”(৫১:৪)

“তোমাদেরকে যার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে তা অবশ্যই সত্য।”(৫১:৫)

“আর নিশ্চয় প্রতিদান [দিবস] অবশ্যম্ভাবী।”(৫১:৬)

পবিত্র কুরআনের আরো কিছু সূরার মতো এই সূরাও কয়েকটি শপথের মাধ্যমে শুরু হয়েছে। এখানে আল্লাহ তায়ালা মেঘমালা ও বাতাসের মতো প্রাকৃতিক বিষয়ের শপথের কথা বলেছেন যেগুলো আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণের মাধ্যমে সারাবিশ্বে প্রাণী ও উদ্ভিদের প্রাণ সঞ্চারে ভূমিকা পালন করে। শপথ সেই নৌযানের যা পানির উপরে ভেসে থাকে ও বাতাসের সাহায্যে যাত্রী ও পণ্য বহন করে বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে নিয়ে যায়। এবং শপথ সেসব ফেরেশতাদের যারা মানুষের রিজিক বণ্টনের দায়িত্ব পালন করে।

নিঃসন্দেহে মানুষ, প্রাণী ও উদ্ভিদের প্রাণ বৃষ্টির পানিবর্ষণের ওপর নির্ভরশীল। আর বৃষ্টি যাতে ভূপৃষ্ঠের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে সেজন্য বাতাস মেঘমালাকে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে নিয়ে যায়। সাগরে চলাচলকারী নৌযান বা জাহাজগুলিও মানুষের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বর্তমান আধুনিক যুগেও ভারী পণ্য পরিবহনের জন্য সবচেয়ে বড় ও সবচেয়ে সস্তা বাহন হচ্ছে জাহাজ।

নিঃসন্দেহে পবিত্র কুরআনে এসব বিষয়ের শপথ বর্ণনা করার মাধ্যমে মানবজীবন পরিচালনায় আল্লাহর শক্তি ও প্রজ্ঞার বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। এর মাধ্যমে পরকাল অস্বীকারকারীদের একথা বোঝানো হয়েছে যে, আল্লাহ তায়ালা বিশ্বজগত সৃষ্টি করেই ক্ষান্ত হননি বরং আকাশ ও জমিনের মধ্যবর্তী সবকিছু সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালনার জন্য সুন্দর ব্যবস্থাপনাও করে দিয়েছেন। তিনি তাঁর নবী-রাসূলগণের মাধ্যমে মানবজাতিকে একথাও জানিয়ে দিয়েছেন যে, একদিন এই সুন্দর পার্থিব জীবনের ইতি ঘটবে এবং সেদিন মানুষকে এই জীবনের কর্মের হিসাব দিতে হবে।

এই ছয় আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে:

১- মেঘমালা, বাতাস ও বৃষ্টির মতো প্রাকৃতিক বিষয়ের প্রতি আল্লাহর শপথ মানুষকে এই সৃষ্টিজগত পরিচালনায় ঐশী ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করতে উৎসাহিত করে।  আর এসব নিয়ে গবেষণা করলে আল্লাহকে চেনা সম্ভব হয়।

২- আল্লাহ তায়ালা বস্তুগত ও অবস্তুগত মাধ্যমের সাহায্যে বিশ্বজগত পরিচালনা করেন।

৩- বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, আমরা আমাদের জীবনে যার তার প্রতিশ্রুতিতে বিশ্বাস করি; অথচ আমাদের সৃষ্টি ও পালনকর্তা আল্লাহর প্রতিশ্রুতির প্রতি আমাদের বিন্দুমাত্র আস্থা নেই।

সূরা জারিয়াতের ৭ থেকে ৯ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:

وَالسَّمَاءِ ذَاتِ الْحُبُکِ ﴿٧﴾ إِنَّکُمْ لَفِی قَوْلٍ مُخْتَلِفٍ ﴿٨﴾ یُؤْفَکُ عَنْهُ مَنْ أُفِکَ ﴿٩﴾

“শপথ বহু পথ বিশিষ্ট [ও সৌন্দর্যমণ্ডিত] আকাশের।” (৫১:৭)

“নিশ্চয় তোমরা [পবিত্র কুরআন সম্পর্কে] মতবিরোধপূর্ণ ও অসংলগ্ন কথায় লিপ্ত।” (৫১:৮)

“যে [সত্য থেকে] বিচ্যুত হয়েছে তাকেই তা থেকে ফিরিয়ে নেয়া হয়।”(৫১:৯)

আগের আয়াতগুলোতে বর্ণিত শপথের পর এই তিন আয়াতে আকাশমণ্ডলীর বিশালত্বের শপথ করা হয়েছে। এই আকাশে রয়েছে কোটি কোটি নিহারিকা, গ্রহ ও নক্ষত্র যেগুলো রাতের অন্ধকারে সৌন্দর্যমণ্ডিত বাতির মতো আকাশজুড়ে জ্বল জ্বল করে জ্বলতে থাকে।

কিন্তু কাফেররা আসমান ও জমিন পরিচালনায় আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছাশক্তি এবং মানবজাতিকে হেদায়েতের জন্য নবী-রাসূলগণের প্রতি ওহী নাজিল হওয়া ইত্যাদি বিষয়ে সংশয় পোষণ করে। এ ধরনের মানুষ নানা অজুহাতে নবী-রাসূলগণ এবং তাঁদের শিক্ষাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। তবে তাদের কাছে যেমন কোনো শক্তিশালী যুক্তি নেই তেমনি তাদের বিশ্বাসও দৃঢ় নয়। এ কারণে তাদের অবস্থান দুর্বল ও তাদের বক্তব্য অসংলগ্ন ও পরস্পরবিরোধী। কিন্তু এর বিপরীতে সত্য পথ একটি এবং তা সুস্পষ্ট যুক্তি ও সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত।

যে ব্যক্তি সত্যকে সঠিকভাবে চেনার পরও উল্টোপথে হাঁটবে সে পথভ্রষ্ট হবে এবং জেনেশুনে যে পথভ্রষ্টতায় লিপ্ত হওয়ার কারণে আল্লাহ তায়ালা তার সঠিক পথে ফিরে আসার পথ রুদ্ধ করে দেবেন; ফলে সে বিভ্রান্তির অতল গহ্বরে হারিয়ে যাবে।

এই তিন আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

১- পরকাল অস্বীকারকারীদের কাছে কোনো স্পষ্ট যুক্তি বা দলিল নেই। কাজেই তাদের বক্তব্য অসংলগ্ন এবং কখনও কখনও স্ববিরোধী ও পরস্পরবিরোধী।

২- সরল-সঠিক পথ মাত্র একটি। কিন্তু ভ্রান্ত পথ অসংখ্য-অগণিত।

৩- যেকোনো বিচ্যুতি ও গোনাহের কাজ আরো অনেক বিচ্যুতি ও আরো বেশি গোনাহ করার পথ খুলে দেয়। আর এভাবে চলতে থাকলে আল্লাহর রাস্তায় ফিরে আসা কঠিন হয়ে যায়।

সূরা জারিয়াতের ১০ থেকে ১৪ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:

قُتِلَ الْخَرَّاصُونَ ﴿١٠﴾ الَّذِینَ هُمْ فِی غَمْرَةٍ سَاهُونَ ﴿١١﴾ یَسْأَلُونَ أَیَّانَ یَوْمُ الدِّینِ ﴿١٢﴾ یَوْمَ هُمْ عَلَى النَّارِ یُفْتَنُونَ ﴿١٣﴾ ذُوقُوا فِتْنَتَکُمْ هَذَا الَّذِی کُنْتُمْ بِهِ تَسْتَعْجِلُونَ ﴿١٤﴾

“ধ্বংস হোক মিথ্যাচারীরা।” (৫১:১০)

“যারা সন্দেহ-সংশয়ে নিপতিত, উদাসীন!” (৫১:১১)

“তারা জিজ্ঞাসা করে, প্রতিদান দিবস কবে হবে?” (৫১:১২)

“যে দিন তাদেরকে আগুনে জ্বালানো হবে।”(৫১:১৩)

“[তাদেরকে বলা হবে], তোমরা তোমাদের শাস্তি আস্বাদন কর! এই হচ্ছে সেই শাস্তি যা তোমরা [ঠাট্টার ছলে] তরান্বিত করতে চেয়েছিলে।”(৫১:১৪)

আগের আয়াতগুলোর ধারাবাহিকতায় এই আয়াতগুলোতে পরকালে অস্বীকারকারী কাফিরদের বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে যারা ভিত্তিহীন ধারনা নিয়ে কথা বলে ও মিথ্যাচার করে। তারা চরম সংশয়ে নিমজ্জিত ও উদাসীন হওয়া সত্ত্বেও নিজেদেরকে বুদ্ধিজীবী ও প্রজ্ঞাবান মনে করে।

কাফিররা সব সময় নবী-রাসূল ও ঈমানদারদের কাছে একটি প্রশ্ন বারবার জিজ্ঞাসা করত। আর তা হলো- কিয়ামত কবে হবে? তারা ভাবত, যেহেতু ঈমানদারদের কিয়ামত দিবসের দিনক্ষণ সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই কাজেই নিশ্চয়ই কিয়ামত দিবস বলেও কিছু নেই। তাদের এই যুক্তির উদাহরণ এমন যে, ভূমিকম্প কখন হবে তার তথ্য জানা না থাকা মানে হচ্ছে কোনোদিন ভূমিকম্প হবে না। এ ধরনের মানুষ যতক্ষণ নিজেদের শরীরে জাহান্নামের আগুনের স্পর্শ না পাবে ততক্ষণ কিয়ামত সম্পর্কে সংশয়ে পড়ে থাকবে এবং ঈমানদারদের কাছে এ সম্পর্কে বিভ্রান্তিকর প্রশ্ন করে যাবে।

এই পাঁচ আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে:

১- ধর্ম সম্পর্কে কল্পনাপ্রসূত উদ্ভট ও যুক্তিহীন বক্তব্য মানুষকে আল্লাহর রহমত থেকে দূরে সরিয়ে দেয়।

২- আমাদের যদি কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার সময় সম্পর্কে জ্ঞান না থাকে তার অর্থ এই নয় যে, আমরা কিয়ামত সম্পর্কে সংশয়ে পতিত হবো। কারণ, এই সংশয়-সন্দেহ থেকেই বহু মানুষ কিয়ামত অস্বীকারকারী বা কফিরে পরিণত হয়েছে।#

পার্সটুডে/এমএমআই/আবুসাঈদ/ ১৪

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ