নভেম্বর ০১, ২০২২ ১৫:১২ Asia/Dhaka
  • ইরান-ইরাক যুদ্ধের ইতিহাস (১৩৫): তেহরানের কাছে বাগদাদের শোচনীয় পরাজয়ের কারণে

ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে শুধু যে তৎকালীন পরাশক্তিগুলো এবং ইউরোপীয় দেশগুলোই ইরাকের পাশে দাঁড়িয়েছিল তাই নয় সেইসঙ্গে ইসলামি সম্মেলন সংস্থা বা ওআইসি এবং জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন বা ন্যামের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলিও সাদ্দাম সরকারকে সমর্থন দিয়েছিল।

যে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন গঠিত হয়েছিল যুদ্ধ ঠেকাতে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা করতে সেই ন্যাম ইরাক-ইরান যুদ্ধে নিজের দায়িত্ব সঠিক সময়ে যথাযথভাবে পালন করতে পারেনি।  যুদ্ধবিরোধী সংস্থা হিসেবে ন্যামের উচিত ছিল ইরানের ওপর ইরাকের আগ্রাসনের নিন্দা জানানো। কিন্তু সংস্থাটি তা জানায়নি। যুদ্ধের পুরোটা সময়ে নিয়মিত বিরতিতে উদ্বেগ প্রকাশ এবং দুই দেশের প্রতি যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানানোর মধ্যেই দায়িত্ব সীমিত রেখেছিল জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন।

এই আহ্বান এমন সময় জানানো হতো যখন যুদ্ধের সমাপ্তি ইরাকের পক্ষে এবং ইরানের বিপক্ষে যায়। যখন আগ্রাসী ইরাকি বাহিনী ইরানের ভূমিতে অবস্থান করছে তখন যুদ্ধ বন্ধ করার আহ্বান মূলত আগ্রাসী বাহিনীর কর্মকাণ্ডকে স্বীকৃতি দেওয়ার শামিল। ইরানের আবাসিক এলাকাগুলোতে ইরাকি বাহিনীর বোমাবর্ষণ, ইরানের বাণিজ্যিক জাহাজগুলোতে সাদ্দাম বাহিনীর হামলা, ইরানের যাত্রীবাহী বিমানে হামলা চালিয়ে শত শত নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করা- ইত্যাদি বিষয়ে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন নীরব দর্শকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল। ফলে দেখা যাচ্ছে, ইরাক-ইরান যুদ্ধের সময় জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন তার চিরচেনা রূপ হারিয়ে ফেলেছে এবং একটি দেশের ওপর আরেকটি দেশের আগ্রাসন প্রতিহত করার ক্ষেত্রে নিজের দায়িত্ব পালনে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।

এদিকে যুদ্ধের শুরুতে ইরাকি বাহিনী যখন ইরানের একটি বড় অংশ নিজেদের দখলে নিয়ে নিয়েছে তখন ওআইসি উভয় দেশকে যুদ্ধ বন্ধ করার আহ্বান জানায়। অথচ এই ওআইসি শুরুতে ইরাকি বাহিনীকে আগ্রাসন চালানো থেকে বিরত থাকতে বলেনি বা আগ্রাসনের নিন্দা জানায়নি। যুদ্ধ শুরুর ২০ মাস পর ইরানি যোদ্ধারা খোররামশাহর পুনরুদ্ধার করার পর ওআইসি একটি যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দেয়। প্রস্তাবে আগ্রাসী দেশকে চিহ্নিত করার কথা বলা হলেও আগে উভয় দেশের সেনাবাহিনীকে আন্তর্জাতিক সীমান্তে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানানো হয়। কিন্তু এই প্রস্তাব বাস্তবায়নের কোনো গ্যারান্টি ছিল না। এ কারণে ইরানের জোর দাবি ছিল, আগে আগ্রাসী বাহিনীকে চিহ্নিত করতে এবং তার কাছ থেকে যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ গ্রহণ করার পর যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

এরপর থেকে ওআইসি নিজের নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে সরে গিয়ে ইরাকের পক্ষ অবলম্বন করতে শুরু করে। সার্বিকভাবে যুদ্ধে ইরাকের প্রতি বিশ্বের বড় শক্তিগুলোর সমর্থন দেখে ওআইসি প্রভাবিত হয় এবং যুদ্ধ বন্ধ করার ব্যাপারে নিরপেক্ষ অবস্থানে থেকে কথা বলতে ব্যর্থ হয়। অবশেষে ইরাকের স্বৈরাচারী শাহ সরকার ইরান ও ইরাকের ওপর আট বছরের যুদ্ধ ও ধ্বংসলীলা চাপিয়ে দিয়ে ইরানের দখলীকৃত সকল ভূখণ্ড থেকে সেনা প্রত্যাহার করতে সম্মত হয়। সেইসঙ্গে ১৯৭৫ সালের আলজিয়ার্স চুক্তিও আনুষ্ঠানিকভাবে মেনে নেয় সাদ্দাম সরকার। অথচ ১৯৮০ সালে সাদ্দাম টেলিভিশন ভাষণে আলজিয়ার্স চুক্তি ছিঁড়ে ফেলে ইরানের ওপর একতরফা আক্রমণের নির্দেশ দিয়েছিল। মূলত ব্যক্তি সাদ্দামের ওই উদ্ধত আচরণের কারণে ইরাক-ইরান যুদ্ধ শুরু হয়েছিল।

যাই হোক, ইরাকের প্রতি বিশ্বের বেশিরভাগ দেশের রাজনৈতিক সমর্থন ও বড় শক্তিগুলোর সার্বিক পৃষ্ঠপোষকতা সত্ত্বেও ওই যুদ্ধে ইরানের বিজয় থেকে একটি সিদ্ধান্তেই উপনীত হওয়া যায়। আর তা হলো- এই যুদ্ধে বিজয়ে আত্মিক ও সাংস্কৃতিক উপাদান অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ইসলামি বিপ্লবের মহান নেতা ইমাম খোমেনী (রহ.) বহুবার এ বিষয়টির প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। তিনি যুদ্ধাস্ত্র ও সেনা সংখ্যার দিক দিয়ে ইরাক ও ইরানের মধ্যকার বিশাল তারতম্যের বিষয়টি তুলে ধরে বলেন: যখন প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সবগুলো শক্তি আগ্রাসী ইরাকি বাহিনীর পেছনে দাঁড়িয়েছে তখন আত্মিক দিক দিয়ে উন্নত চরিত্রের অধিকারী ইরানি যোদ্ধাদের একনিষ্ঠ চিত্তে দেশরক্ষা করার প্রচেষ্টা না থাকলে আমাদের দেশকে কেউ রক্ষা করতে পারত না।

প্রকৃত অর্থেই ইরানি যোদ্ধাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের দৃঢ়তা তাদেরকে আগ্রাসী ইরাকি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে বিজয় দান করেছে। ইরানি যোদ্ধাদের অন্তরে ধর্মীয় বিশ্বাসের শেকড় ছিল অত্যন্ত গভীর। ফলে যুদ্ধের ময়দান থেকে শুরু করে ফ্রন্ট লাইনের শিবিরগুলোতে ইরানি যোদ্ধাদের আচরণে সেই ধর্মীয় বিশ্বাসের ছাপ লক্ষ্য করা যেত। তারা ধর্মীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশরক্ষার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। এ কারণে তারা যুদ্ধে আহত হওয়াসহ যেকোনো পরিস্থিতিতে ধৈর্য্যের চরম পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছেন। সেইসঙ্গে যেকোনো মুহূর্তে দেশের জন্য সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ করতেও তারা প্রস্তুত ছিলেন। আত্মিক গুণে গুণান্বিত এসব যোদ্ধা আত্মত্যাগের যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তা এক কথায় অতুলনীয়।

ইরানি যোদ্ধারা মহান আল্লাহ এবং তার অসীম ক্ষমতাকে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন। তারা একথা জানতেন যে, তাদের দেশ আগ্রাসন ও জুলুমের শিকার হয়েছে। এ কারণে তারা আগ্রাসী বাহিনীর বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার জন্য যুদ্ধ করাকে নৈতিকতার মাণদণ্ডেও শ্রেষ্ঠ ভাবতেন। তারা সুস্পষ্টভাবে জানতেন, ইরাকি বাহিনী ইরানের ওপর অন্যায়ভাবে যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে। কাজেই এ যুদ্ধে ইরাক বাতিল ও তাগুতি শক্তিতে পরিণত হয়েছে। ইরানি যোদ্ধারা জানতেন, এরকম অবস্থায় সত্যের পক্ষের শক্তিকে বিজয়ী হতে আল্লাহ তায়ালা সাহায্য করেন।  তারা আরো জানতেন, আত্মরক্ষা করতে গিয়ে পরাজিত হলে চলবে না।  ইসলামের শত্রুদের হত্যা করা কিংবা শহীদ হওয়া- উভয় ক্ষেত্রে মুসলিম যোদ্ধাকে বিজয়ী বলে ধরে নেওয়া হয়। মহানবী (সা.) ও তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের প্রতিও ইরানি যোদ্ধাদের ছিল অগাধ বিশ্বাস ও ভালোবাসা। জিহাদের ময়দানে তাদের পদাঙ্ক অনুসরণের চেষ্টা সার্বক্ষণিকভাবে করে গেছেন ইরানি যোদ্ধারা।#

পার্সটুডে/এমএমআই/১

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

 

ট্যাগ