ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০২৩ ২০:২০ Asia/Dhaka

রংধনু আসরের শিশু-কিশোর বন্ধুরা, কেমন আছো তোমরা? আশা করি যে যেখানে আছো ভালো ও সুস্থ আছো। আজকের আসরে তোমাদেরকে স্বাগত জানাচ্ছি আমি গাজী আব্দুর রশীদ এবং আমি আকতার জাহান।

বন্ধুরা, তোমরা নিশ্চয়ই আল্লাহর রাসূল হযরত মূসা (আ.)-এর নাম শুনেছো! তিনি প্রাচীন মিশরের গোশন প্রদেশে জন্মগ্রহণ করেন। হযরত মূসা ছিলেন সবচেয়ে বড় পাঁচ রাসূলের অন্যতম। অন্য চারজন রাসূল হলেন- হযরত নূহ (আ.), ইব্রাহিম (আ.), ঈসা (আ.) এবং সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ রাসূল হযরত মুহাম্মাদ (সা.)।

বনী ইসরাঈলের নবী হযরত মুসা (আ.)-এর নাম পবিত্র কুরআনে সর্বাধিকবার আলোচিত হয়েছে। অর্থাৎ তাঁর নাম উদ্ধৃত হয়েছে ১৩৬ বার। হযরত মুসার সময় যে ফেরাউন ছিল তিনি ১৮তম রাজবংশের, তার নাম ছিল কাবুস। সে যুগে ফেরাউন হতো মিসরের সম্রাটের খেতাব।

এখন থেকে তিন হাজার ৩০০ বছরেরও বেশি আগে এক প্রকাশ্য জনসভা ও উৎসবের আয়োজন করে দুর্দান্ত প্রতাপশালী ফেরাউন সুদক্ষ জাদুকরদের মাধ্যমে হযরত মুসা নবীকে অপমানিত করতে চেয়েছিল। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছায় ফেরাউনের জাদুকরদের ওপর বিজয়ী হয়েছিলেন হযরত মুসা (আ.)। জাদুর প্রতিযোগিতাটি হয়েছিল মিশরের আলেক্সান্দ্রিয়া শহরে। আজকের আসরে আমরা ঐতিহাসিক সেই ঘটনাটি শোনাব। এরপর থাকবে একটি গান। আর সবশেষে থাকবে এক নতুন বন্ধুর সাক্ষাৎকার। আমাদের আজকের অনুষ্ঠানটিও গ্রন্থনা ও প্রযোজনা করেছেন আশরাফুর রহমান। তাহলে আর কথা না বাড়িয়ে প্রথমেই সত্য ঘটনাটি শোনা যাক।

প্রতীকী ছবি

হজরত মুসা (আ.)-এর পিতার নাম ছিল ইমরান এবং মাতার ইউকাবাদ। হজরত হারুন (আ.) ছিলেন হজরত মুসার সহোদর ও বড়ভাই ছিলেন। হযরত মুসা (আ.) নব্যুয়ত লাভের পর প্রথমে জাদুকরদের ও ফেরাউনকে আল্লাহর একত্ববাদ মেনে নেয়ার  এবং মূর্তি পূজা পরিহারের আহ্বান জানান। এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহর সঙ্গে অন্য কাউকে শরিক করা হলে তার যে মারাত্মক পরিণতি হবে সে সম্পর্কেও তিনি তাদের সতর্ক করে দেন। তাদের জাদু বা ভেল্কিবাজিকে তিনি আল্লাহর বিরুদ্ধে মিথ্যাচারের প্রচেষ্টা বলেও অভিহিত করেন।

কিন্তু ফেরাউন কোনো কথাই শুনল না। সে ১২ হাজার দক্ষ জাদুকর নিয়ে হযরত মুসাকে মোকাবেলা করতে চাইল। তাদের মধ্যে প্রসিদ্ধ ৫ জাদুকরের নাম ছিল শামউন, সাদুর, গাদুর, খতাত ও মুসাফা। শামউন অন্য চারজনের গুরু ছিল। তারা মিশরে পৌঁছে জানতে পারল যে, হযরত মুসা (আ.) ঘুমানোর সময় তাঁর লাঠিটি অজগর হয়ে তাঁকে পাহারা দেয়। ফলে তারা সাহস হারিয়ে ফেলে। কারণ, জাদুকররা ঘুমিয়ে পড়ার পর তাদের জাদুর কার্যকারিতা থাকে না।

নির্দিষ্ট দিনে স্থানীয় অধিবাসীরা, ফেরাউনের সভাসদ ও সেনা-সামন্তরা আলেক্সান্দ্রিয়া শহরে উপস্থিত ছিল। ফেরাউন নিজে একটি মঞ্চে বসে এ দৃশ্য দেখছিল। জাদুর যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে হযরত মূসা (আ.) জাদুকর সর্দার শামাউনকে ডেকে বললেন: আমি যদি তোমার উপর জয়ী হই তাহলে কি তুমি আমার উপর ঈমান আনবে?

শামাউন বলল, আমি এমন জাদুর কারিশমা দেখাব অন্য কোনো জাদু তার ধারে কাছে আসতে পারবে না। কাজেই আপনি যদি বিজয়ী হতে পার তাহলে অবশ্যই ঈমান আনব। কেননা, তাতে বুঝতে পারব যে, আপনার কারিশমা জাদু নয়, জাদু হলে আমার উপর জয়ী হতে পারতেন না।

এসময় জাদুকররা জানতে চাইল, হে মূসা! জাদু কি আপনিই আগে নিক্ষেপ করবেন, না আমরা নিক্ষেপ করব?

মূসা (আ) বললেন, তোমরাই নিক্ষেপ কর। জাদুকররা রশি ছেড়ে দিল মাঠে। সাথে তাদের হাতের লাঠিও। লাঠি আর রশি সাপ হয়ে লাফালাফি শুরু করল ময়দান জুড়ে। মূসার দিকে বারে বারে ধেয়ে আসে, ভেল্কি দেখায়। ফেরাউন আর তার লোকজনের মনে খুশির বাঁধভাঙ্গা জোয়ার। মূসার পরাজয় সুনিশ্চিত। আসমানী আদেশের অপেক্ষায় থাকেন আল্লাহর নবী।

এসময় ওহী আসল: (ইকো) “আমি মূসার প্রতি প্রত্যাদেশ করলাম, তুমিও তোমার লাঠি নিক্ষেপ কর। সহসা তা তাদের অলীক মিথ্যা সৃষ্টিগুলোকে গিলতে লাগল।” (সূরা আ‘রাফ, আয়াত-১১৭)

হযরত মূসা তার লাঠি মাটিতে রাখার সাথে সাথে তা অজগর হয়ে প্রকাণ্ড হা করে ওসব গিলতে লাগল। অগণিত মানুষ হতবাক, ভীত বিহ্বল, এদিক-সেদিক দৌঁড়ঝাপ করতে লাগল।

জাদুর মহারণে যখন সত্য উদ্ভাসিত হল, মিথ্যা পরাজিত হল, তখন মূসা ও হারুণ (আ) উভয়ে শোকরানা সিজদায় মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। তখন জাদুকররাও মূসাকে অনুকরণ করল। 'তারা সমস্বরে বলে উঠল, আমরা ঈমান আনলাম জগতসমূহের প্রতিপালকের প্রতি।' (সূরা আ‘রাফ, আয়াত-১২১)

জালিম শাসক ফেরাউন দূর থেকে এসব দৃশ্য দেখেছিল। এসময় জনগণকে ক্ষেপিয়ে তোলার কৌশল নিয়ে ফেরাউন বলল, আজকের জাদু সম্পূর্ণ পাতানো খেলা। এর পেছনে তোমাদের অন্য মতলব আছে। ফেরাউন বলল, "আমি তোমাদেরকে অনুমতি দেয়ার পূর্বে তোমরা তার উপর বিশ্বাস স্থাপন করলে? এটাতো এক চক্রান্ত; তোমরা সজ্ঞানে এই চক্রান্ত করেছ নগরবাসীদেরকে নগর থেকে বহিষ্কার করার জন্য। তোমরা শীঘ্রই এর পরিণাম জানতে পারবে।”  

এসময় জাতির উদ্দেশ্যে জ্বালাময়ী এক ভাষণ দিল ফেরাউন। জনগণকে সত্যের বিরুদ্ধে দাঁড় করাতে সবচে বড় অস্ত্রটি অর্থাৎ দেশদ্রোহিতার অভিযোগ আনল ফেরাউন। হযরত মূসার নিন্দা জানিয়ে ফেরাউন বলল, তোমরা মিশরবাসীকে দেশ থেকে বহিষ্কারের ষড়যন্ত্র করেছ। তোমাদের উদ্দেশ্য মিশরের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা। তোমরা কানে কানে সেই শলা-পরামর্শই করেছ।

দু’জন কিবতি ছাড়া সব জাদুকর ছিল বনি ইসরাঈল বংশোদ্ভুত। তাদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলার উস্কানিমূলক বক্তৃতার সাথে তাদের দমিয়ে রাখার জন্য এক ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করল ফেরাউন। সদম্ভে ঘোষণা করল: “আমি তোমাদের হাত পা বিপরীত দিক হতে কর্তন করবই; অতঃপর তোমাদের সকলকে শূলবিদ্ধ করবই। ডান পা আর বাম হাত অথবা বাম পা আর ডান হাত। অবশ্যই তোমাদেরকে ফাঁসিকাষ্টে ঝুলিয়ে রাখব।” (সূরা আ‘রাফ, আয়াত-১২৪)

ফেরাউনের এমন হুমকিকে পাত্তাই দিল না জাদুকররা। ঈমানি শক্তির বিস্ফোরণে তাদের রক্ত কণিকায় শিহরণ জাগল আল্লাহর মহব্বতের আর তাঁর পথে শাহাদত লাভের তামান্নার। যে জাদুকররা সকালে কাফের ছিল তারাই বিকেল বেলা খাঁটি মুসলমানে রূপান্তরিত হল। আল্লাহর নবীকে পরাস্ত করতে রশি নিয়ে এসেছিল, এখন নিজেরা বন্দি হয়ে গেল ঈমানের রশিতে। ক্ষমতাধর ফেরাউন যখন হাতপা কর্তন আর শূলীতে চড়ানোর হুমকি দিল তখনও তারা অবিচল। মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচার কোনো আকুতি তাদের নাই। “তারা বলল, আমারা আমাদের প্রতিপালকের নিকট অবশ্যই প্রত্যাবর্তন করব।” (সূরা আ‘রাফ, আয়াত-১২৫)

তাদের ঈমানী চেতনার সামনে দুনিয়ার সব সুখ সম্ভোগ, ফেরাউনের সান্নিধ্য, পদোন্নতি, বেতন ভাতা বৃদ্ধির প্রলোভন তুচ্ছ হয়ে গেল। ফেরাউনকে তারা মুখের উপর বলে দিল: “তুমি তো আমাদেরকে শাস্তি দিচ্ছ শুধু এ জন্য যে, আমরা আমাদের প্রতিপালকের নিদর্শনে ঈমান এনেছি, যখন তা আমাদের নিকট এসেছে। হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে ধৈর্য দান কর এবং মুসলমানরূপে আমাদের মৃত্যু দাও।” (সূরা আ‘রাফ, আয়াত-১২৬)

জাদুকররা আরও বলল: অন্যায়ের সামনে মাথা নত করা, জালিমের সহযোগিতা করা, জুলুমের সমর্থক হয়ে পদ পদবী লাভ করা, তার চেয়ে আমাদের কাছে মৃত্যু অনেক শ্রেয়। জন্মেছি তো মরতে হবেই। এই মরণ যদি আল্লাহর রাহে হয়, সত্যের পথে হয় সেটিই হবে জীবনের পরম সাফল্য।

“তারা বলল, আমাদের নিকট যে স্পষ্ট নিদর্শন এসেছে তার উপর এবং যিনি আমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন তার উপর তোমাকে আমরা কিছুতেই প্রাধান্য দিব না। সুতরাং তুমি কর যা তুমি করতে চাও। তুমি তো কেবল পার্থিব জীবনের উপর কর্তৃত্ব করতে পার"। (সূরা তোয়াহা, আয়াত-৭২)

জাদুকরেরা আরও বলল: “আমরা নিশ্চয়ই আমাদের প্রতিপালকের প্রতি ঈমান এনেছি, যাতে তিনি আমাদের অপরাধ ক্ষমা করেন এবং তুমি আমাদেরকে জাদু করতে যে বাধ্য করেছ তাও যেন ক্ষমা করেন। আর আল্লাহ শ্রেষ্ঠ ও স্থায়ী। ”(সূরা তোয়াহা, আয়াত-৭৩)

তারা আরও বলল: আমাদের সামনে জীবন মৃত্যুর অপার রহস্য উন্মোচিত হয়ে গেছে যে, “যে তার প্রতিপালকের নিকট অপরাধী হয়ে উপস্থিত হবে তার জন্য তো আছে জাহান্নাম, সেথায় সে মরবেও না, বাঁচবেও না। এবং যারা তার নিকট উপস্থিত হবে মুমিন অবস্থায় সৎকর্ম করে তাদের জন্য আছে সমুচ্চ মর্যাদা। স্থায়ী জান্নাত, যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত, সেথায় তারা স্থায়ী হবে এবং এই পুরস্কার তাদেরই, যারা পবিত্র।” (সূরা তোয়াহা, আয়াত-৭৪-৭৬)

বন্ধুরা,  অনুষ্ঠানের এ পর্যায়ে রয়েছে পথশিশুদের নিয়ে একটি গান। গানটির গীতিকার বিলাল হোসাইন নূরী, সুরকার মশিউর রহমান আর গেয়েছে শিশুশিল্পী আহমেদ নাফিস।

বন্ধুরা, নাফিসের চমৎকার কণ্ঠে গানটি গানটি শুনলে। তোমরা সবাই পথশিশুদের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবে- কেমন? তো অনুষ্ঠানের এ পর্যায়ে তোমাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবো বাংলাদেশের এক নতুন বন্ধুকে। 

ইশরাত আলম

শিশু-কিশোর বন্ধুরা, তোমরা ভালো ও সুস্থ থেকো আবারো এ কামনা করে গুটিয়ে নিচ্ছি রংধনুর আজকের আসর।#

পার্সটুডে/আশরাফুর রহমান/২৬

ট্যাগ