মার্চ ২৮, ২০২৩ ২১:০৬ Asia/Dhaka

চীনের মধ্যস্থতায় ইরান-সৌদি আরবের মধ্যকার সাম্প্রতিক চুক্তি এখন বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত বিষয়ের মধ্যে অন্যতম। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি নিয়ে রেডিও তেহরানের সাথে দুই পর্বে কথা বলেছেন সিনিয়র সাংবাদিক, ডেইলি স্টার পত্রিকার বাংলা বিভাগের সম্পাদক, রাজনৈতিক ভাষ্যকার এবং জনপ্রিয় উপস্থাপক গোলাম মোর্তজা।

বিশিষ্ট এই সাংবাদিক বলেন,ইরান-সৌদি আরবের মধ্যকার চুক্তি মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে যত মুসলিম দেশ আছে তাদের মধ্যে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে ইসরাইল যুক্তরাষ্ট্র চুক্তিটি নিয়ে কোন কৌশল অবলম্বন করে এবং চীন, সৌদি আরব ও ইরান তা কীভাবে মোকাবেলা করে সেটা দেখার বিষয়। তবে এ চুক্তির বাস্তবায়ন নিয়ে অনেক খেলাধুলা হবে।

সাক্ষাৎকারটি উপস্থাপনা ও তৈরি করেছেন গাজী আবদুর রশীদ। গ্রহণ করেছেন সিরাজুল ইসলাম।

জনাব গোলাম মোর্তজা- রেডিও তেহরানের আলাপন অনুষ্ঠানে আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছি।

রেডিও তেহরান:  জনাব গোলাম মোর্তজা, ইরান- সৌদি আরবের মধ্যে চুক্তির বিষয়টি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বর্তমানে সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। সবার মুখে বিশেষ করে রাজনীতি সচেতন ব্যক্তি মাত্রই বিষয়টি নিয়ে ভাবছে। বিশ্ব রাজনীতিতে নতুন কিছুর ইঙ্গিত দেখছে। তো আজকের পর্বের শুরুতে আপনার কাছে জানতে চাইব,   আপনার কী মনে হয় ইরান এবং সৌদি আরবের মধ্যকার এই চুক্তি আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বড় কোনো পরিবর্তনের সূচনার ইঙ্গিত?

গোলাম মোর্তজা: ইরান-সৌদি আরবের মধ্যকার যে চুক্তি হয়েছে সত্যি সত্যি যদি দৃশ্যমান এই চুক্তি যদি ঠিক থাকে তাহলে পুরো মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে যতগুলো মুসলিম দেশ আছে তাদের মধ্যে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এর ব্যাপক প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা আছে এবং এই অঞ্চলের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রমুখী যে নীতি তারও অনেকটা পরিবর্তন হতে পারে। এ অঞ্চলের দেশগুলোর অনেকেই এমনটি চাইতে পারে যে আমরা একমুখী নীতিতে থাকব না। আমরা দ্বিমুখী নীতিতে যাব। চীনের সঙ্গে আমরা একটা সুসম্পর্ক করব। অর্থাৎ সৌদি আরব যদি নেতৃত্বে থাকে এবং পথ দেখায় তাহলে এ অঞ্চলের আরও বহু দেশের সে পথে হাঁটার একটা সুযোগ ও সম্ভাবনা আছে।

আপনি জানেন যে সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ যে অর্থনৈতিক শক্তি আছে তারা অনেকটাই সৌদি আরব যে নীতিতে চলে সেই একই নীতিতে চলে। সৌদি আরবের সাথে চীনের সুসম্পর্ক আছে। তো তারা যদি চীনের উপর নির্ভরশীল হয়ে ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে সেক্ষেত্রে অন্যান্য দেশেরও সেই পথে হাঁটার সম্ভাবনা আছে।

রেডিও তেহরান: জনাব গোলাম মোর্তজা,  বিশ্বের বহু দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি এককভাবে নির্ভর করে থাকে। এমনটি দেখা যায়। এই চুক্তির ফলে সেই একক নির্ভরতার জায়গাটি থেকে অনেকে সরে আসবে কি না?

গোলাম মোর্তজা: দেখুন, মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলের দেশগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি একক নির্ভরতা কমিয়ে চীনের দিকে মুখ ফেরাতে পারে একই সঙ্গে অন্যান্য দেশেরও ইরানের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার একটা প্রক্রিয়া শুরু করতে পারে। পারার একটা সম্ভাবনা আছে। সেটা যদি হয় তাহলে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ইউরোপের যে অবস্থান আছে ইরানের প্রতি; ইউরোপও চাইবে ইরানকে পুরোপুরিভাবে চীনের দিকে ছেড়ে না দিয়ে ইরানকে তার পক্ষে রাখার চেষ্টা করবে। অর্থাৎ এক ধরনের প্রতিযোগিতামূলক একটা প্রেক্ষাপট তৈরি হতে পারে।

রেডিও তেহরান:  শ্রোতাবন্ধুরা! আবারও ফিরে এলাম সাক্ষাৎকারে। জনাব গোলাম মোর্তজা, ইরান এবং সৌদি আরবের মধ্যকার এ চুক্তির প্রকাশ্য বিরোধিতা করেছেন ইসরাইলের নেতারা। এর কারণ কি? বিষয়টি নিয়ে নিয়ে আপনার বিশ্লেষণ ও দৃষ্টিভঙ্গি  কি?

গোলাম মোর্তজা:  ইসরাইল বিরোধিতা করবে, ইসরাইলের নেতৃবৃন্দ বিরোধিতা করবে সেটাই স্বাভাবিক। কারণ সৌদি আরবের সাথে শুধুমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক থাকে এবং নির্ভরশীলতা থাকে তাহলে ইসরাইল যা বলবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সৌদি আরবকে দিয়ে সেটাই করাবে। কিন্তু সেটা না করে সৌদি আরবের মতো দেশের চীনের সঙ্গে সম্পর্ক যদি ঘনিষ্ঠ হয় এবং এবং চীন যদি প্রভাবিত করে ইরানের সঙ্গে সৌদি আরবের সম্পর্কে স্বাভাবিক করানোর দিকে  নিয়ে যেতে পারে তখন ইসরাইল যা চাইবে এ অঞ্চলে সেরকমটি তখন আর হবে না। অর্থাৎ ইসরাইলের প্রভাব কমে যেতে পারে। আর প্রভাব কমে যেতে পারে বলেই ইসরাইলের চিন্তিত হবার কারণ আছে। আর সে কারণে এই চুক্তিটি বাস্তবায়ন হবে কি হবে না তার অনেকখানি নির্ভর করবে ইসরাইলি কূটনীতি কতটা সৌদি আরবের উপরে প্রভাব ফেলতে পারল। বিশেষ করে নিরাপত্তাগত জায়গাটিতে যে কথাটি বলা হয় যে যুবরাজ সালমান অনেকটাই ইসরাইলের ওপর নির্ভরশীল। আর সেটা যদি সত্যি হয়ে থাকে তাহলে এখানে নানা সমস্যা তৈরি হবে। আর এই ধরনের একটি চুক্তি করার ক্ষেত্রে আমার ধারনা যে সৌদি আরব বা যুবরাজ সালমান এই নিরাপত্তাগত কিংবা  এইসব বিষয় চিন্তা করেই তিনি অগ্রসর হয়েছেন। তো সেই কারণে আমার মনে হয় না যে এই চুক্তি একেবারে হুট করে একেবারে বাতিল করা যাবে। তবে অনেক খেলাধুলা হবে।

রেডিও তেহরান: জনাব গোলাম মোর্তজা আমরা সাক্ষাৎকারের শেষ দিকে চলে এসেছি। সবশেষে যে বিষয়টি জানতে চাইব সেটি হচ্ছে, ইরান-সৌদি চুক্তির পর একটি খবর বেরিয়েছে সৌদি আরবে জাতিসংঘের উদ্যোগে ২ দিনব্যাপী একটি পর্যটন বিষয়ক অনুষ্ঠান হতে যাচ্ছে, যেখানে ইসরাইলসহ  বিশ্বের ২৩ টি দেশের দাওয়াত পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ইসরাইলের প্রতিনিধি দলের ভিসার অনুরোধ বাতিল করে দিয়েছে সৌদি আরব। এছাড়া সংযুক্ত আরব আমিরাত ইসরাইলের কাছ থেকে যে ক্ষেপনাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কিনতে চেয়েছিল সেটি কেনা স্থগিত করেছে। কারণ হিসেবে তারা দেখিয়েছে নেতানিয়াহুর সরকার যেহেতু সংকটে সে কারণে আপাতত আমরা  বিষয়টি স্থগিত করছি। এখানে সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের পক্ষ থেকে দুটি ঘটনা ঘটেছে। এ দুটি ঘটনা নিয়ে আপনার বিশ্লেষণ কি?

গোলাম মোর্তজা: দেখুন, আপনি যে দুটি ঘটনার কথা বললেন, সেই দুটি ঘটনা বিশ্ব মিডিয়ায় আলোচিত হয়েছে। এই দুটো বিষয়ের নানাবিধ ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ চলছে। আমি যে সৌদি আরবের নিরাপত্তার বিশেষ করে শাসক পরিবারের নিরাপত্তার ব্যাপারে ইসরাইলের ওপর নির্ভরশীল হয়েছিল বলে একধরনের গুঞ্জন রয়েছে। সেই জায়গাগুলোতে হয়তো একধরনের টানাপড়েন তৈরি হয়েছে। আর সবচেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে-সৌদি আরবের মধ্যে এই বোধোদয়টা এসেছে যে আমরাই তো বড় শক্তি তাহলে আমরা কেন ইসরাইলের ওপর নির্ভর করে থাকব বা ইসরাইল যা বলবে সেটাই আমি করব কেন? ইসরাইল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বলবে আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আমাদেরকে বলবে আর আমাদের সেই নীতিতে চলতে হবে আমার ধারনা এই জায়গা থেকে বের হয়ে আসতে চাইছে সৌদি আরব। আর সৌদি আরবের নীতির প্রতিফলন সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ আরও অন্যান্য দেশের ওপর পড়বে। ইরান যখন পারমাণবিক চুক্তি করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের সাথে তখন তার একটি প্রভাব সারা বিশ্বে পড়েছিল। চুক্তিটি বাস্তবায়ন কিন্তু হয়নি। এ বিষয়টি কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে। সেই কারণে এখানে যত ঘটনাই ঘটুক না কেন আমাদের অপেক্ষা করতে হবে শেষ পর্যন্ত যে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আর কি কি ঘটে! মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইল এখানে কোন্‌ কৌশল অবলম্বন করে এবং সেই কৌশল চীন, সৌদি আরব এবং ইরান কতটা যোগ্যতা এবং দক্ষতার সঙ্গে মোকাবেলা করতে পারবে তার উপর নির্ভর করবে এই চুক্তির ভবিষ্যত।

রেডিও তেহরান: তো জনাব গোলাম মোর্তজা, ইরান-সৌদি আরবের মধ্যে চুক্তি  যেটি বর্তমান সময়ে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে সবচেয়ে আলোচিত বিষয়; সেই বিষয়টি নিয়ে রেডিও তেহরানের সাথে ২ পর্বে কথা বলার জন্য আপনাকে অবারও অনেক অনেক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

গোলাম মোর্তজা: আপনাদেরকে এবং দর্শক-শ্রোতাদের সবাইকে ধন্যবাদ।#

পার্সটুডে/গাজী আবদুর রশীদ/২৮

  • বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ