মার্চ ২৯, ২০২৩ ১৯:৪৬ Asia/Dhaka

আমাদের আজকের আলোচনা শুরু করব পবিত্র কুরআনের সুরা রুম-এর ২১ নম্বর আয়াতের অর্থ শুনিয়ে: আর এক নিদর্শন এই যে, তিনি তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের সঙ্গিনীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তিতে থাক এবং তিনি তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয়ই এতে চিন্তাশীল লোকদের জন্যে স্পষ্ট নিদর্শনাবলী রয়েছে।

-বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর/অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।  (কাজি নজরুল ইসলাম) –অন্য কথায় নর বিনা নারী বা নারী বিনা নর পূর্ণতা পেতে পারে না। তবে তাদের মধ্যে লেনদেন ও যোগাযোগ হতে হবে সঠিক এবং বৈধ পন্থায়। ইসলাম নারী ও পুরুষকে সমান মানবীয় মর্যাদা দিয়েছে। নারীর এমন অনেক যোগ্যতা ও গুণ আছে যা পুরুষের নেই, আবার পুরুষেরও এমন অনেক দিক ও বৈশিষ্ট্য রয়েছে নারী যার মুখাপেক্ষী। তাই বিধাতা পরিবার গঠনের মাধ্যমে মানব সমাজকে দিয়েছেন ভারসাম্যের বিধান।

উৎসব অনুষ্ঠানে ঐতিহ্যবাহী পোশাক-পরা ইরানের একদল কুর্দি নারী

 

মহান আল্লাহ সুরা আলে ইমরানের ১৯৫ নম্বর আয়াতে বলেছেন,' .... আমি তোমাদের কোন পরিশ্রমকারীর পরিশ্রমই বিনষ্ট করি না, তা সে পুরুষ হোক কিংবা স্ত্রীলোক। তোমরা পরস্পর এক বা একই জাতের।'- সমাজ, সংসার ও নতুন প্রজন্ম সৃষ্টিতে নারী ও পুরুষ দৈহিক আর মানসিক ভূমিকা সমান। তাই নারী ও পুরুষ সমান গুরুত্ব ও সম্মানের অধিকারী। স্বামী-স্ত্রী মিলে পরিবার নামক সুখ ও প্রশান্তির যে বাগান গড়ে তোলেন তা তাদের দয়া ও আত্মত্যাগের ফসল। নারীর ত্যাগ ও দয়া এবং পুরুষের যত্নশীলতা ও হেফাজত ছাড়া পরিবারকে টিকিয়ে রাখা অসম্ভব। কবি নজরুল তাই লিখেছেন:  কোনোকালে একা হয়নি'ক জয়ী পুরুষের তরবারি/প্রেরণা দিয়েছে, শক্তি দিয়েছে বিজয় লক্ষী নারী।/রাজা করিতেছে রাজ্য শাসন, রাজারে শাসিছে রানী,/রানীর দরদে ধুইয়া গেছে রাজ্যের যত গ্লানি।…. নারী, সে শিখাল শিশু পুরুষেরে, স্নেহ-প্রেম, দয়া-মায়া/দীপ্ত নয়নে পরল কাজল, বেদনার ঘন ছায়া!

এবারে আমরা ইরানি কুর্দি জাতির পরিবার ও পারিবারিক সংস্কৃতির কয়েকটি দিক তুলে ধরব। প্রত্যেক জাতির মত কুর্দিরাও জীবনসঙ্গী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে নিজস্ব প্রথা ও রীতি মেনে চলে। অনেক সময় পছন্দটা ব্যক্তিগত হলেও তা জাতীয় ঐতিহ্য ও রীতি বা আচার-আচরণের সীমানা ডিঙ্গাতে পারে না। কুর্দিসহ ইরানিদের সব সমাজে বিয়ের বিষয়ে এখনও বাবা –মায়ের ভূমিকাই প্রধান। এমনকি বর ও কনে নিজস্ব পছন্দের আলোকে বিয়ে করলেও বাবা ও মা-ই সার্বিক তত্ত্বাবধান এবং অনুষ্ঠানাদি পরিচালনায় প্রধান ভূমিকা রাখেন। ইরানি কুর্দি সমাজে পরিবারের সদস্যদের নিকট-আত্মীয়ের মধ্যে বিয়ের ব্যাপক প্রচলন রয়েছে। ঐতিহ্যবাহী কুর্দি পরিবারগুলো একান্নবর্তী পরিবারের মত অনেক বড় হয়ে থাকে এবং কুর্দি নারী ও পুরুষেরা তাদের অতীত ঐতিহ্যের আলোকে নিকট-আত্মীয়ের মধ্যে বিয়ের প্রথাকে পছন্দ করেন। এ ধরনের পরিবারের সদস্যদের পারস্পরিক বন্ধন বেশ মজবুত এবং বিষয়টি তাদের জন্য সুখ ও প্রশান্তির প্রধান উৎস।

কুর্দি পরিবারের নরনারীরা পরস্পরের বন্ধু বা সহকর্মীর মত এবং জীবনের সব ক্ষেত্রে তাদের সহযোগিতা স্পষ্ট। ফলে অপবিত্র কোনো বিষয় এ ধরনের পরিবারে নেই বললেই চলে। একই কারণে কুর্দি পরিবারগুলোর কাঠামো বেশ মজবুত। অন্যান্য গোত্র বা জাতির তুলনায় কুর্দিদের মধ্যে তালাকের সংখ্যা খুবই কম। কুর্দি পরিবারের সদস্যরা নারী ও পুরুষ নির্বিশেষ পরস্পরের সুখে সুখী ও পরস্পরের দুঃখে দুঃখী। ইরানি কুর্দিরা বেশ উৎসব-প্রিয় ও আনন্দমুখর জাতি। তারা বিয়ের উৎসবে গান গেয়ে ও বাজনা বাজিয়ে এবং নানা ধরনের বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান করে বেশ আনন্দ উল্লাস প্রকাশ করে থাকে। এসব অনুষ্ঠানে নারীদের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।

গার্হস্থ্য-কাজে ব্যস্ত দু'জন ইরানি কুর্দি নারী

 

কুর্দি নারীরা পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বিশ্বের সবচেয়ে  সক্রিয় নারী সমাজের অন্যতম। তারা সন্তান জন্মদানেও বেশ উর্বর এবং  শক্তিশালী। এ ছাড়াও তারা সংগ্রামী, যোদ্ধা ও সাহসী নারী হিসেবে খ্যাত। পিতা ও স্বামীর সংসার এ উভয় ক্ষেত্রেই তারা সবার অধিকার রক্ষাসহ সুখ ও দুঃখের সঙ্গী হয়ে এবং বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে পরিবারের প্রতি তাদের গভীর অনুরাগের প্রমাণ রাখেন। এ জন্যই কুর্দি নারীদেরকে পরিবারের প্রধান ভিত্তি ও স্তম্ভ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পারিবারিক মতবিরোধ ও দ্বন্দ্ব সমাধানেও তারা দক্ষ মধ্যস্থতাকারী হিসেবে বিবেচিত। কুর্দি অধ্যুষিত অঞ্চলের শিশুরা শৈশব থেকেই নিজস্ব সংস্কৃতি ও প্রথায় প্রশিক্ষণ নিয়ে এইসব ঐতিহ্য রক্ষার অনুরাগী হিসেবে গড়ে ওঠে। কার্পেট বুনন, জায়নামাজ বুনন, পশমের চাটাই তৈরি, নানা ধরনের পোশাক তৈরি, গয়না ও অলংকার নির্মাণ, প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে টুপি তৈরি ইত্যাদি নানা শিল্প সামগ্রী তৈরিতে কুর্দিদের সুনাম কয়েক হাজার বছরের। কুর্দি ছেলে ও মেয়েরা বংশ পরম্পরায় এসব শিল্প নির্মাণ মায়েদের কাছ থেকে শিখে এসেছে।  

কুর্দি নারীরা কেবল শান্তির সময় নয় যুদ্ধ ও সংকটের সময়ও সক্রিয় থেকে সামাজিক ও অর্থনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে যেতে অভ্যস্ত। এ ধরনের সংকটের সময় তারা বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠেন।কুর্দি পরিবারগুলোর আরেকটি বড় বৈশিষ্ট্য হল তাদের পোশাকগুলো বেশ সুন্দর, বিচিত্রময় রং ও ডিজাইনের। কুর্দি নারীরা পরিপূর্ণ হিজাব বা ইসলামী শালীন পোশাক পরে থাকেন। হিজাব পরিধানের কারণে কুর্দি নারীরা বেশ স্বাধীনতার শক্তি অর্জন করেন এবং সমাজে ভূমিকা রাখাও তাদের জন্য এ কারণে সহজ।

অনুষ্ঠানের এ পর্যায়ে আমরা সফল বিয়ে সম্পর্কে ক'টি কথা বলব। বিয়ে করার আগে জীবন-সঙ্গীর ধর্মীয় চিন্তা ও বিশ্বাস সম্পর্কে জেনে নিন। কারণ এক্ষেত্রে মিল না থাকলে বিয়ে সুখের হওয়া তো দূরের কথা বিয়ে বৈধই হবে না। পবিত্র কুরআনের বিধান অনুযায়ী মুমিন ব্যক্তি কোনো কাফের বা মুশরিক নারীকে বিয়ে করতে পারে না। মুমিনের জীবনসঙ্গীকে হতে হবে একত্ববাদী। মুমিনের বিশ্ব-দৃষ্টি ও কাফের-মুশরিকের বিশ্ব-দৃষ্টি এক নয়। অস্তিত্ব জগত ও জীবন সম্পর্কে তাদের দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য আকাশ ও জমিনের মত ব্যাপক। মুমিনের পথ রহমত, ক্ষমা ও ভালোবাসার আর কাফের মুশরিকের পথ হল অজ্ঞতা, ধ্বংস ও জাহান্নামের পথ। মুসলিম নারীকে বিধর্মীদের কাছেও বিয়ে দেয়া পবিত্র কুরআনের দৃষ্টিতে একই কারণে হারাম।  সুরা মায়েদার ৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে:

আজ তোমাদের জন্য পবিত্র বস্তুসমূহ হালাল করা হল। আহলে কিতাবদের খাদ্য তোমাদের জন্যে হালাল এবং তোমাদের খাদ্য তাদের জন্য হালাল। তোমাদের জন্যে হালাল সতী-সাধ্বী মুসলমান নারী এবং তাদের সতী-সাধ্বী নারী, যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে তোমাদের পূর্বে, তোমরা যখন তাদেরকে মোহরানা দাও তাদেরকে স্ত্রী করার জন্যে,  অবৈধভাবে কামবাসনা চরিতার্থ করার জন্যে কিংবা গুপ্ত প্রেমে লিপ্ত হওয়ার জন্যে নয়। যে ব্যক্তি বিশ্বাসের বিষয় অবিশ্বাস করে, তার শ্রম বিফলে যাবে এবং পরকালে সে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। #


পার্সটুডে/এমএএইচ/২৯

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।
 

ট্যাগ