মে ০৬, ২০২৩ ১৫:১০ Asia/Dhaka

প্রিয় পাঠক ও শ্রোতাবন্ধুরা! সালাম ও শুভেচ্ছা নিন। আশা করি যে যেখানেই আছেন ভালো ও সুস্থ আছেন। ইরানের কালজয়ী গল্পের পসরা গল্প ও প্রবাদের গল্পের আজকের আসরে আমরা শুনবো চমৎকার একটি প্রাচীন গল্প। গল্পটি এরকম: 

প্রাচীনকালে সাত সমুদ্র তের নদীর ওপারে বাস করতো এক অত্যাচারী বাদশা। মানুষ তার অত্যাচারে অতীষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। সবাই মনের গহীনে বিদ্রোহ আর ঘৃণার বীজ বপন করে যাচ্ছিলো। অপেক্ষায় ছিল উপযুক্ত সময়ের। সুদে আসলে প্রতিশোধ নেওয়ার সময়-সুযোগ খুঁজছিলো সবাই। পক্ষান্তরে জালেম বাদশাহ কেবল রঙ্গ-রসে মজে থাকতো। বিলাসী জীবনযাপন করতে গিয়ে সে নিরীহ জনতার কথা ভাববারও অবকাশ পেত না।  

মানুষের কাছ থেকে জোরপূর্বক খাজনা আদায় করে নিজে বিলাসী জীবনযাপন করতো। ওই বাদশা এমনকি নিজের সেনাবাহিনী-যারা তারই সেবায় নিয়োজিত ছিল-তাদের প্রাপ্য অধিকারও দিতো না। উল্টো বরং তাদেরকেও বঞ্চিত করতো। যতই দিন যেতে লাগলো ততই বাদশার কারাগারগুলো বন্দিতে পূর্ণ হতে লাগলো। কিন্তু বেশিরভাগ জনতাই বাদশার এই জুলুম অত্যাচার সহ্য করতে পারছিল না। তারা তাই দেশ ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে শুরু করলো। এভাবে যতই দিন যাচ্ছিলো ততই দেশের জনসংখ্যা কমে যেতে লাগলো। এসব ব্যাপারে বাদশার কোনো খবরই ছিল না। সে তার মতোই প্রাসাদে আরাম-আয়েশে, ভোগ-উপভোগে লিপ্ত ছিল। যে-ই তার এসব কাজের প্রতিবাদ করতো তাকেই সে বন্দিশালায় পাঠিয়ে দিতো। 

এভাবে যেতে যেতে একদিন বাদশাহ তার প্রাসাদে বিশ্রাম নিচ্ছিলো। তার মন্ত্রীরা এবং তার সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তারা তার পাশে অবস্থান করছিলো। দরবারের কবি তাদেরকে ফেরদৌসীর শাহনামা কাব্যগ্রন্থ থেকে একটি অধ্যায় আবৃত্তি করে শোনাচ্ছিল। শাহনামার ওই অধ্যায়টি ছিল জাহাক এবং সেনা-কর্মকর্তা ফেরেদুনের মধ্যকার সংঘর্ষ সম্পর্কে। মন্ত্রী বাদশাহকে বললো: আপনি তো জানেন ফেরেদুনের কোনো রাজ্য ছিল না, গুপ্তধন ছিল না এমনকি কোনো সেনাবাহিনীও ছিল না। তাহলে কীভাবে ফেরেদুন জাহাককে পরাজিত করে ক্ষমতার মসনদে আরোহন করলো? বাদশাহ কিছুক্ষণ ভাবলো। তারপর মন্ত্রীর প্রশ্নের জবাবে বললো: শাহনামার গল্পে যেরকমভাবে বর্ণিত হয়েছে, তা হলো: জনগণ ফেরেদুনের চারপাশে এসে সমবেত হলো এবং ফেরেদুনের সাহায্যে এগিয়ে এলো।

Image Caption

বাদশাহ আরও বললো: দেশের মানুষ যারা তখনকার বাদশাহর অত্যাচারে অতীষ্ঠ হয়ে পড়েছিল তারা বাদশাহর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লো এবং ফেরেদুনকে সিংহাসনে বসিয়ে ক্ষান্ত হলো। সর্বোপরি কথা হলো জনগণের সহযোগিতা ও সমর্থনে ফেরেদুন বিজয় লাভ করেছে আর জাহাক পরাজিত হয়েছে। মন্ত্রী তখন জিজ্ঞেস করলো: হে বাদশাহ! মানুষের সহযোগিতা সমর্থনই যদি সিংহাসনে আরোহনের কারণ হয় তাহলে তুমি কেন তোমার চারপাশ থেকে জনগণকে সরিয়ে দিচ্ছো? তুমি কি তোমার বাদশাহী চালিয়ে যেতে চাও না? বাদশাহ তখন পাল্টা জানতে চাইলো: কীভাবে সম্ভব জনগণকে বাদশাহর চারপাশে জমায়েত করা যায় এবং বাদশাহর সাহায্য সহযোগিতায় নিয়ে আসা যায়? মন্ত্রী বললো: "বাদশাহকে সদয় হতে হবে। জনগণের প্রতি তার মায়া, ভালোবাসা থাকতে হবে। কিন্তু তোমার মধ্যে এই দুটি গুণের কোনোটাই নেই।" মন্ত্রীর কথা বাদশাহর মোটেও ভালো লাগলো না। 
বাদশাহ কোথায় মন্ত্রীর সুন্দর পরামর্শটাকে কাজে লাগিয়ে জনগণের সন্তোষ অর্জনের চেষ্টায় এগিয়ে যাবে, তা না, উল্টো সে পরামর্শদাতা মন্ত্রীকে কারাবন্দি করার আদেশ দিলো। মন্ত্রী কী আর করবে! কারাগারেই কাটাতে হলো তাকে দীর্ঘদিন। এদিকে বাদশাহ ঠিকই তার আয়েশি জীবনযাপনে অভ্যস্থ হয়ে পড়লো। জনগণের ওপর জুলুম নির্যাতন আগের মতোই চালিয়ে যেতে লাগলো। মানুষও ঠিকঠাকমতো সুযোগের অপেক্ষায় দিন কাটাতে লাগলো। অপেক্ষা করতে লাগলো কখোন বাদশাহকে মসনদ থেকে নামিয়ে দেওয়া যায়! এরইমাঝে বাদশাহর চাচাতো ভাইয়েরা এক কাণ্ড ঘটিয়ে বসলো। তারা যখন দেখলো দেশের পরিস্থিতি ভালো না, জনগণ বাদশাহর ওপর ব্যাপক অসন্তুষ্ট। যে-কোনো মুহূর্তেই বিপর্যয় ঘটে যাবার আশঙ্কা রয়েছে-তখন তারা বাদশাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসলো। 

দেশে সম্ভাব্য নিরাপত্তাহীনতার পরিস্থিতি আন্দাজ করে চাচাতো ভাইয়েরা বাদশাহিতে তাদের অংশ ও অধিকার দাবি করে বসলো। সেইসঙ্গে জালেম বাদশাহর বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান করলো। বাদশাহকে তারা বললো: এই বাদশাহিতে আমাদেরও অংশ আছে। আমাদের বাবারাও এই বাদশাহির জন্য অনেক খেটেছেন, শ্রম দিয়েছেন, জীবন দিয়েছেন। তুমি দীর্ঘ সময় বাদশাহি করেছো। এবার আমাদের পালা! বাদশাহ নাছোড়বান্দা। সে হাল ছাড়লো না। মনে মনে ভেবেছিলো আগের মতোই জুলুম অত্যাচার অব্যাহত রেখে সে ক্ষমতায় থাকতে পারবে। সে ভাবতেই পারে নি যে চাচাতো ভাইয়েরা জনগণের সঙ্গে একত্রিত হয়েই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে প্রয়োজনীয় কাজকর্ম এবং পরিকল্পনা নিয়ে নিয়েছে।

সুপরিকল্পিতভাবে চাচাতো ভাইয়েরা যখন জনগণকে সঙ্গে নিয়ে বাদশাহর বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান করে বসলো, বাদশাহ আর সুবিধা করতে পারলো না। কেননা জনগণ তার অত্যাচারে অতীষ্ঠ হয়ে গিয়েছিল। তাদের কোনোরকম সমর্থন বাদশাহর প্রতি ছিল না। অগত্যা বাদশাহকে সিংহাসন ছেড়ে দিতেই হলো। বরখাস্ত হয়ে যাবার পর তার চাচাতো ভাইদের মধ্য থেকে একজন নতুন বাদশাহ হিসেবে মনোনীত হলো। বাদশাহীর মসনদে আসীন হলো নয়া বাদশাহ। সে জ্ঞানী মন্ত্রীকে কারাগার থেকে মুক্ত করে দিয়ে নিজের মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দিলো। এ অবস্থা দেখে সাবেক বাদশাহ আফসোস করতে লাগলো: কেন সে ওই মন্ত্রীর উপদেশ বা পরামর্শগুলোকে কাজে লাগালো না। মন্ত্রী নতুন বাদশাহকে বললো: 
হে বাদশাহ! তুমিও যদি আমাদের পরামর্শ ও উপদেশকে পরোয়া না করে, জনগণের কথা বিবেচনা না করে তোামর চাচাতো ভাইয়ের মতোই জুলুম নির্যাতনের রাজ কায়েম করো, তাহলে তোমার পরিনতিও তার মতোই হবে। দেশের মানুষ তোমার বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠবে। কথায় আছে না-জুলুমের রাজ কায়েম করে কোনো হুকুমাতই বেশিদিন টিকে থাকতে পারে না। এমন কোনো জালেম নেই যে-কিনা এই পৃথিবীতেই তার জুলুমের শাস্তি ভোগ করে যায় না।#

পার্সটুডে/এনএম/৬/৬৫

মূল ফার্সি গল্পের রূপান্তর: নাসির মাহমুদ

ট্যাগ