মে ১৭, ২০২৩ ১৮:০৭ Asia/Dhaka

গত অনুষ্ঠানে আমরা সমকালীন ইতিহাসে পদার্থবিজ্ঞানে ইরানি গবেষক অধ্যাপক মাহমুদ হেসাবির অবদান ও তার বিভিন্ন কর্মকাণ্ড নিয়ে কথা বলেছি। গত অনুষ্ঠানে আমরা বলেছিলাম অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী মাহমুদ হেসাবি চিকিৎসা, গণিতশাস্ত্র ও জ্যোতির্বিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন। আজকের অনুষ্ঠানে আমরা অধ্যাপক মাহমুদ হেসাবির জীবনের আরো কিছু দিক এবং আরেকজন গবেষক ও চিন্তাবিদ ড. অলেনুশ তেরিয়ন সম্পর্কে কথা বলবো।

ফার্সি ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি অধ্যাপক মাহমুদ হেসাবির গভীর আগ্রহ ও ভালোবাসা ছিল সবার জন্য বড় দৃষ্টান্ত। তিনি মনে করতেন এ ভাষার সমৃদ্ধির কারণে ইরানি সংস্কৃতির খ্যাতি আজ সর্বত্র। তিনি তার লেখনিতে প্রযুক্তি ক্ষেত্রে ব্যবহৃত বিভিন্ন বিদেশি শব্দের পরিবর্তে ফার্সি শব্দ ব্যবহার শুরু করেন। তার এই পরিশ্রমের কারণে এখনো ইরানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে বিদেশি শব্দের পরিবর্তে ফার্সি বহু শব্দের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়।

অধ্যাপক মাহমুদ হেসাবি ব্যক্তিগত জীবনে খুবই হাসিখুশি ও বিনয়ী ছিলেন। তিনি কম কথা বলতেন এবং চিন্তা করতেন বেশি। তিনি অল্পে তুষ্ট ও মিতব্যয়ী ছিলেন। যা কিছু পেতে সেটাকে তিনি সৃষ্টিকর্তার অশেষ নেয়ামত মনে করতেন এবং সেটার পূর্ণ ব্যবহার করতেন। তিনি কখনোই জ্ঞানার্জন থেকে বিরত থাকতেন না। এমনকি অন্য ভাষা শেখার জন্য প্রতিদিন রাতে এক ঘণ্টা সময় ব্যয় করতেন।

অ্যাস্ট্রোফিজিক্স বা জ্যোতিপদার্থবিজ্ঞান এমন একটি বিদ্যা যা জ্যোতিপদার্থবিজ্ঞানের বস্তু ও ঘটনা অধ্যয়নের ক্ষেত্রে পদার্থবিজ্ঞানের পদ্ধতি ও নীতিগুলো প্রয়োগ করা হয়। পদার্থবিজ্ঞানের যে শাখায় মহাবিশ্বের সমস্ত বস্তু যেমন, গ্রহ, নক্ষত্র, ধূমকেতু, উল্কা, ছায়াপথ, পালসার যা চৌম্বক আবর্তিত নিউট্রন তারকা, ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণগহ্বর ইত্যাদি সম্পর্কে আলোচনা করা হয় তাকে 'জ্যোতিপদার্থবিজ্ঞান' বলে। 'জ্যোতিপদার্থবিজ্ঞান' মহাকাশ গবেষণা বা জ্যোতির্বিদ্যারই একটি শাখা যা কিনা মহাকাশে গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান ও গতিবিধির ওপর প্রচলিত সরাসরি নজরদারির পরিবর্তে পদার্থবিদ্যা ও রসায়নের নীতিগুলো ব্যবহার করা হয়।

প্রকৃতপক্ষে, জ্যোতিপদার্থবিজ্ঞান আসলে জ্যোতির্বিদ্যা সংক্রান্ত নানা বস্তুর অধ্যয়ন ও গবেষণা। সমগ্র মহাবিশ্বের পদার্থবিদ্যা বিগ ব্যাং মডেল দ্বারা বর্ণিত হয়েছে। এখন থেকে প্রায় ১৩৭০ কোটি বছর আগে মহাবিশ্ব এক অতি ঘন ও উত্তপ্ত বিন্দুর মতো অবস্থা থেকে প্রচণ্ড বিস্ফোরণের মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছে। এক অকল্পনীয় ক্ষুদ্র বিন্দুর প্রকাণ্ড বিস্ফোরণের মাধ্যমে সম্প্রসারণশীল মহাবিশ্বের সৃষ্টি হয় বলে এই মতবাদ বিগ ব্যাং বা মহাবিস্ফোরণ তত্ত্ব নামে পরিচিত।

 একক বস্তুটিই মহাবিশ্বের মূল বস্তু যা পরবর্তী কালে প্রসারণের ফলে সম্প্রসারণশীল মহাবিশ্বের সৃষ্টি হয় এবং বস্তুটিও শীতল হতে থাকে। এই সময় থেকেই প্রসারণের শুরু যা বিগ ব্যাং নামে পরিচিত। মহাজাগতিক বস্তু প্রসারণের ফলে ক্রমশ ঠাণ্ডা হতে থাকে এবং গামা রশ্মি মহাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে ও পরমাণুর ছোট কণার উদ্ভব হয়। বিগ ব্যাংএর কয়েক মিনিট পর সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বস্তুকণা ক্রমশ ঘন হয়ে নিউট্রন ও প্রোটন তৈরি করে। এই প্রোটন ও নিউট্রন থেকে হাইড্রোজেন তৈরি হয় এবং দুটি হাইড্রোজেন পরমাণুর বিক্রিয়ার ফলে হিলিয়াম তৈরি হয়। অভিকর্ষ শক্তির ফলে হাইড্রোজেন ও হিলিয়ামের সমন্বয় ঘটে এবং যে উষ্ণতার সৃষ্টি হয়, তা অত্যন্ত উজ্জ্বল গ্যাস যুক্ত মেঘ সৃষ্টি করে। এই মেঘ থেকেই কয়েকশো মিলিয়ন বছর পর নক্ষত্র ও গ্যালাক্সির সৃষ্টি হয়। গ্যালাক্সির বস্তুকণা ও গ্যাসীয় পদার্থ অভিকর্ষীয় বলের কারণে একত্রিত হয়ে নীহারিকা বা নেবুলার সৃষ্টি করে। অনবরত আণবিক বিস্ফোরণ ঘটতে থাকায় নীহারিকায় ভারি উপাদানের সৃষ্টি হয়। নীহারিকার কেন্দ্রীয় নক্ষত্রের চারপাশে শিলা ও ধাতুর সমন্বয় থেকেই নক্ষত্রের চারপাশে ঘুরতে থাকা গ্রহ গুলির সৃষ্টি হয়। এইভাবে প্রায় ৪.৬ বিলিয়ন বছর আগে আমাদের সৌর জগতের সৃষ্টি হয়েছিল।

সমসাময়িক যুগে একজন বিখ্যাত এবং প্রভাবশালী ইরানি নারী বিজ্ঞানী যিনি জ্যোতিপদার্থবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অনেক বড় অবদান রেখেছেন তিনি হচ্ছেন অলেনুশ তেরিয়ন। তিনি ইরানের জ্যোতিপদার্থবিজ্ঞানের জননী হিসেবে পরিচিত। অলেনুশ তেরিয়ন ১৯২০ সালে আর্মেনিয় সংস্কৃতিমনা পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন এবং ওই পরিবারেরই তিনি পড়ালেখা করেন। তেহরান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি অনার্স ডিগ্রি লাভ করেন এবং এ বিশ্ববিদ্যালয়ে তাকে বিজ্ঞান অনুষদের ল্যাবরেটরিতে নিরীক্ষক বা সুপারভাইজার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। এরপর পড়াশোনা অব্যাহত রাখার জন্য তিনি ফ্রান্সের সোরবন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পান এবং সেখান থেকে তিনি ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। সেখানে অধ্যাপনা করার প্রস্তাব পেলেও তা ফিরিয়ে দিয়ে তিনি ইরানে ফিরে আসেন।

ড. অলেনুশ তেরিয়ন পড়াশোনা ও গবেষণা চালানোর জন্য পদার্থ বিজ্ঞান বেছে নেয়ার কারণ সম্পর্কে বলেছেন, 'আপনি যখন কোনো ভালো শিক্ষকের তত্বাবধানে থেকে কোনো বিষয়ে পড়াশোনা শুরু করবেন তখন ওই বিষয়ের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়বেন।

আমি পদার্থবিজ্ঞানে আকৃষ্ট হয়ে পড়ার প্রধান কারণ ছিল এ বিষয়ে আমি একজন ভালো ও গুনি শিক্ষক পেয়েছিলাম। আমি এ বিষয়ে এতোটাই আগ্রহী ছিলাম যে আমার পিতাকে বলেছিলাম এমন কাজ করতে চাই যা এর আগে কেউ করেনি। আমি প্রমাণ করতে চাই এ ক্ষেত্রে ছেলে মেয়েদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। একজন মানুষের যদি যোগ্যতা থাকে তাহলে সে যেকোনো অসাধ্যকে সাধ্য করতে পারে এবং আমি তা  প্রমাণ করেছি'।

ড. অলেনুশ তেরিয়ন ১৯৫৯ সালে তৎকালীন পশ্চিম জার্মানি সরকারের বৃত্তি নিয়ে সোলার ফিজিক্স অবজারভেটরি কেন্দ্রে অধ্যয়ন ও গবেষণা করার সুযোগ পান। এরপর তিনি ইরানে ফিরে আসেন। ইরানে প্রথম সোলার ফিজিক্স অবজারভেটরি প্রতিষ্ঠায় তিনি প্রধান ভূমিকা পালন করেন। একই সাথে তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার কাজও শুরু করেন। তিনিই ছিলেন প্রথম ইরানি নারী বিজ্ঞানী যিনি অ্যাস্ট্রোফিজিক্স বা জ্যোতিপদার্থবিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ড. অলেনুশ তেরিয়ন ১৯৬৬ সালে তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-পদার্থবিদ্যা কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন এবং এর তিন বছর পর তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের জিওফিজিক্স ইনস্টিটিউটের সৌর পদার্থবিদ্যা গবেষণা বিভাগের প্রধান হিসেবে নিযুক্ত হন। তিনি সোলার ফিজিক্স অবজারভেটরিতে কাজ শুরু করেন যেটির প্রতিষ্ঠায় তারই বড় ভূমিকা ছিল। ড. অলেনুশ তেরিয়ন ফার্সি, আর্মেনিয়া, তুর্কি, ইংরেজি ও ফরাসি ভাষায় দক্ষ ছিলেন। ২০১০ সালে তার ৯০তম জন্ম বার্ষিকী পালিত হয়। তিনি তার বাড়ি ও সমস্ত সম্পদ আর্মেনিয় শিক্ষাবিদদের জন্য দান করে যান। ওই বছরেই তিনি বার্ধক্যজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করেন।#  

পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন/১৭

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

 

ট্যাগ