মির্জা হাসান রোশদিয়ে, আলী খান নাজেমুল উলুম, ডক্টর সিনাক, ডক্টর ঈসা সাদিক
জ্ঞান-বিজ্ঞানে ইরানিদের অবদান-(পর্ব-¬¬৪১)
গত আলোচনায় আমরা ইরানে আধুনিক বিজ্ঞানশিক্ষা ও অন্যান্য ক্ষেত্রে জ্ঞানচর্চা শুরুর ইতিহাস নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে বিখ্যাত আমির কাবিরের প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞান শিক্ষা কেন্দ্র দারুল ফুনুনের কথা উল্লেখ করেছিলাম। আজকের আলোচনায়ও আমরা আধুনিক শিক্ষার প্রসার এবং একাডেমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠায় বেশ কয়েকজন শিক্ষাবিদের অবদান নয়ে আলোচনা করবো।
ইরানের অভ্যন্তরীণ সংস্কার সাধনের লক্ষ্যে দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনের স্বল্প সময়ে অর্থাৎ তিন বছরের কিছু বেশি সময়ে আমির কবির যে প্রশংসনীয় উদ্যোগ নিয়েছিলেন সেগুলোর মধ্যে ছিল ধর্মকে পুনরুজ্জীবিত করা এবং সমাজে ন্যায়বিচার সম্প্রসারণের পদক্ষেপ নেওয়া এবং দেশের স্বাধীনতা ও আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষা করা। তার প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞান শিক্ষাকেন্দ্র 'দারুল ফুনুন' থেকে শিক্ষা সমাপ্ত করে বহু জ্ঞানিগুনী ব্যক্তির আবির্ভাব ঘটেছিল যাদের অনেকে ইরানের ঐতিহাসিক সাংবিধানিক আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। কিন্তু নাসিরুদ্দিন শাহ কাজারের শাসনামলের শেষের দিকে তার চারপাশের লোকজন বিশেষ করে প্রশাসন ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বরা এমনকি 'দারুল ফুনুন' এর কর্তাব্যক্তিরাও শিক্ষার খরচ বাড়িয়ে দেয়ায় এবং কেবল বিশেষ ব্যক্তিদের সন্তানদের শিক্ষার সুযোগ করে দেয়ার কারণে এই শিক্ষাকেন্দ্রে সাধারণ মানুষের প্রবেশের কোনো সুযোগ থাকতো না। যাইহোক, রাজধানী তেহরানের নাসের খসরু স্ট্রিটে অবস্থিত 'দারুল ফুনুন' শিক্ষাকেন্দ্রটি বর্তমানে জাদুঘরে রূপান্তরিত করা হয়েছে এবং বহু দর্শনার্থী জাদুঘর দেখতে এসে নিকট অতীতে ইরানে আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের ইতিহাসের সাথে পরিচিতি হয়।
তেহরানে 'দারুল ফুনুন' প্রতিষ্ঠার ৪৩ বছর পর মির্জা হাসান রোশদিয়ের প্রচেষ্টায় তাবরিজ প্রদেশে প্রথম নতুন ধাঁচের প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। মির্জা হাসান তাবরিজি মূলত রোশদিয়ে নামে পরিচিত যিনি ছিলেন ইরানের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ এবং এ কারণে তাকে ইরানের নতুন সংস্কৃতির জনক বলা হয়। মির্জা হাসান রোশদিয়ে তাবরিজে নতুন ধাঁচের প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার চার বছর পর তৎকালীন শাসক মোজাফ্ফার উদ্দিন শাহের মন্ত্রী মির্জা আলী খান আমিনউদ্দৌলার আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে মির্জা হাসান রোশদিয়ে তেহরানে আসেন এবং তেহরানে 'রোশদিয়ে বিদ্যালয়' নামে নতুন একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। ওই একই বছর তেহরানে শিক্ষা বিষয়ক একটি বিশেষ সংস্থা গড়ে তোলা হয় এবং পাশাপাশি ওই স্কুলে বিজ্ঞান বিষয়ক শিক্ষা-প্রশিক্ষণ দেয়ার কাজও শুরু হয়। বিজ্ঞান শিক্ষা ও গবেষণা বিষয়ক এই স্কুলে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক নামে দুটি বিভাগ ছিল। প্রাথমিকে চার বছর এবং মাধ্যমিকে তিন বছর ক্লাসের ব্যবস্থা ছিল।
আলী খান নাজেমুল উলুম ছিলেন নব গঠিত ওই শিক্ষাকেন্দ্র বা স্কুলের প্রধান পরিচালক। তিনি ছিলেন দারুল ফুনুনের প্রথম দিকের ও পুরানো ছাত্রদের একজন।
তিনি প্যারিসের সেন্ট সাইর পলিটেকনিক স্কুলে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি দারুল ফুনুনেও শিক্ষকতা করেছিলেন এবং তিন বছর ইস্পাহানের হুমায়ুনি স্কুলের প্রধানের দায়িত্বে ছিলেন। আলী খান নাজেমুল উলুমের পরিচালিত বিজ্ঞান বিষয়ক হাইস্কুলের পাঠ্যবস্তু ছিল হুবহু ইউরোপীয় দেশগুলোর বিজ্ঞান শিক্ষার সমমানের। এই বিদ্যালয়ে গণিত, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, সাহিত্য ও ভাষা পড়ানো হতো এবং শিক্ষকরা ছিলেন তৎকালীন সময়ের খ্যাতনামা ব্যক্তিত্ব। মজার বিষয় হচ্ছে, এই স্কুলের ছাত্রদের পড়ানোর জন্য 'পদার্থ বিজ্ঞান কোর্স' নামে প্রথম পদার্থ বিজ্ঞানের যে বইটি পড়ানো হতো তা লিখেছিলেন মোহাম্মদ আলী ফুরুগি।
যদিও এই বইটিতে কোনো অনুশীলনী প্রশ্ন কিংবা সমস্যার সমাধান তেমন ছিল না, তবে এর গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল পদার্থজ্ঞান সংক্রান্ত সর্বশেষ তথ্যের উপস্থিতি যা সঠিক, পরিষ্কার এবং তুলনামূলকভাবে সহজ বাক্যে লেখা হয়েছিল। বইটির শেষ অধ্যায়ে, ক্যাথোডিক রশ্মি, এক্স-রে, বৈদ্যুতিক তরঙ্গ এবং বেতার টেলিগ্রাফি সম্পর্কে আলোচনা অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এসব বিষয় খুব বেশি দিন আগে আবিষ্কৃত না হলেও তা এই বইয়ের পাঠ্যসূচীর অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল যা কিনা ইরানে আধুনিক বিজ্ঞানচর্চার পরিবেশকে সুগম করতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।
আধুনিক ও একাডেমিক রূপে ইরানে উচ্চ শিক্ষার ইতিহাস একশত বছরের। ১৮৫৫ সালে ইরানে শিক্ষামন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং নাসিরউদ্দিন শাহ কাজার শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে আলিকুলি মির্জা এতেজাদ সুলতানিয়েকে নিয়োগ দিয়েছিলেন।
১৯২৬ সালে তৎকালীন ইরানের পার্লামেন্ট সদস্য ডক্টর সিনাক প্রথম তেহরান বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি সবার দৃষ্টিগোচর করেন। এরপর ১৯৩১ সালে ডক্টর ঈসা সাদিক উচ্চতর শিক্ষা লাভের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান এবং পড়া শেষ করে দেশে ফিরে এসে তিনি তেহরানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা সরকারের কাছে তুলে ধরেন। তার এ প্রস্তাব সরকার সাদরে গ্রহণ করে। এরপর ডক্টর ঈসা সাদিক, ডক্টর আলী আসগর হেকমাত, ডক্টর মাহমুদ হেসাবিসহ আরো অন্যান্যদের উত্থাপিত তেহরান বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব ১৯৩৪ সালের ২৯ মে জাতীয় পরিষদের বৈঠকে অনুমোদন লাভ করে।
এরপর দারুলফুনুন, স্কুল অফ পলিটিক্যাল সায়েন্স, স্কুল অফ মেডিসিন, হাই স্কুল অফ এগ্রিকালচার, রুরাল ইন্ডাস্ট্রিজ অর্থাৎ গ্রামী শিল্প, স্কুল অফ এগ্রিকালচার অফ মোজাফফারি, ইরানের প্রথম কৃষি স্কুল, স্কুল অফ আর্টস অ্যান্ড ক্রাফটস, হাই স্কুল অফ আর্কিটেকচার, তেহরানের উচ্চ বিদ্যালয় এবং অন্যান্য উচ্চ শিক্ষা কেন্দ্র এসবই তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় আনা হয়।
খাজা নাসিরুদ্দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যুত প্রকৌশল ফ্যাকাল্টির কাছেই অবস্থিত টেলিযোগাযোগ ফ্যাকাল্টি যা কিনা ১৯২৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এরপর ১৯৩৯ সালে এই ফ্যাকাল্টির নীতিমালা জাতীয় পরিষদে অনুমোদন লাভ করে। এই ফ্যাকাল্টি তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে পুরানো শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত।
যাইহোক, চিকিৎসা বিজ্ঞানে তেহরান স্কুল অফ মেডিসিন এবং দারুল ফুনুনকে ইরানের উচ্চতর চিকিৎসা শিক্ষার প্রথম প্রতিষ্ঠান বা ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। প্রথম আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ১৮৭৮ সালে উরুমিয়ে শহরে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং মুজাফ্ফরউদ্দিন শাহ কাজার নিজেই কয়েকজনের স্নাতক সনদে স্বাক্ষর করেছিলেন। #
পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।