জুন ১২, ২০২৩ ১৪:৫৭ Asia/Dhaka

শ্রোতাবন্ধুরা, সালাম ও শুভেচ্ছা নিন। আশা করছি আপনারা সবাই ভালো আছেন। আপনাদের হয়তো মনে আছে গত আসরে আমরা সূরা হাদিদের আলোচনা শেষ করেছি। আজ থেকে আমরা এর পরবর্তী সূরা অর্থাৎ সূরা মুজাদালার সংক্ষিপ্ত তাফসির উপস্থাপন করব। মদীনায় অবতীর্ণ এই সূরায় ২২টি আয়াত রয়েছে এবং এতে মূলত পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্কের ওপর আলোকপাত করা হয়েছে। সূরাটির প্রথম আয়াত থেকে এটির নামকরণ করা হয়েছে যেখানে রাসূলুল্লাহর (সা.)-এর সঙ্গে একজন নারীর কথোপকথন বর্ণিত হয়েছে। প্রথমেই এই সূরার ১ ও ২ নম্বর আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:

بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ

قَدْ سَمِعَ اللَّهُ قَوْلَ الَّتِي تُجَادِلُكَ فِي زَوْجِهَا وَتَشْتَكِي إِلَى اللَّهِ وَاللَّهُ يَسْمَعُ تَحَاوُرَكُمَا إِنَّ اللَّهَ سَمِيعٌ بَصِيرٌ (1) الَّذِينَ يُظَاهِرُونَ مِنْكُمْ مِنْ نِسَائِهِمْ مَا هُنَّ أُمَّهَاتِهِمْ إِنْ أُمَّهَاتُهُمْ إِلَّا اللَّائِي وَلَدْنَهُمْ وَإِنَّهُمْ لَيَقُولُونَ مُنْكَرًا مِنَ الْقَوْلِ وَزُورًا وَإِنَّ اللَّهَ لَعَفُوٌّ غَفُورٌ (2)

“বিসমিল্লাহির রহমানির রাহিম।”

“আল্লাহ অবশ্যই শুনেছেন সে নারীর কথা; যে তার স্বামীর বিষয়ে আপনার সাথে বাদানুবাদ করছিল এবং আল্লাহর কাছেও ফরিয়াদ জানাচ্ছিল। আল্লাহ তোমাদের দুজনের কথোপকথন শোনেন; নিশ্চয় আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বদ্ৰষ্টা।” (৫৮:১)

“তোমাদের মধ্যে যারা নিজেদের স্ত্রীদের সাথে ‘যিহার’ করে [অর্থাৎ স্ত্রীদেরকে তাদের মায়ের সঙ্গে তুলনা করে নিজেদের জন্য হারাম করে নেয় তারা জেনে রাখুক যে] তাদের স্ত্রীরা তাদের মাতা নয়; যারা তাদেরকে জন্মদান করে, শুধু তারাই তাদের মাতা, তারা তো  [জাহেলি যুগের অভ্যাসবশত] অসঙ্গত ও ভিত্তিহীন কথাই বলে। অবশ্য আল্লাহ অধিক পাপমোচনকারী, পরম ক্ষমাশীল।” (৫৮:২)

ইসলামপূর্ব আরবের একটি রীতি ছিল, যখনই কোনো স্বামী তার স্ত্রীর ওপর প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হতো তখন তাকে বলত: তুমি আমার কাছে আমার মায়ের মতো। এই বাক্যটি ব্যবহার করে সে তার স্ত্রীকে অসঙ্গত উপায়ে তালাক দিত। এই পদ্ধতিতে তালাক হলে ওই নারীর পক্ষে অন্য কোনো পুরুষের সঙ্গেও বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া সম্ভব হতো না। এই ধরনের তালাককে জিহার বলা হতো।

মদীনায় ইসলাম ছড়িয়ে পড়ার পর সেখানকার একজন পুরুষ ক্ষুব্ধ হয়ে তার স্ত্রীর সঙ্গে এই আচরণ করে এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই অনুতপ্ত হয়। এ অবস্থায় ওই ব্যক্তির স্ত্রী নিজের করণীয় ঠিক করতে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে আসেন এবং তাঁর সঙ্গে বিতর্কে লিপ্ত হন। আল্লাহর রাসূল তাকে বলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত এ ব্যাপারে আল্লাহর নির্দেশনা না আসছে ততক্ষণ পর্যন্ত স্বামীর সঙ্গে তোমার মেলামেশা হারাম থাকবে। এ অবস্থায় ওই নারী তার সমস্যা সমাধানের জন্য আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করেন। অনেকটা তাৎক্ষণিকভাবেই আল্লাহ তায়ালা এই আয়াত নাজিল করে বলেন: স্ত্রীকে মায়ের সঙ্গে তুলনা একটি ভ্রান্ত তুলনা।  আল্লাহ তায়ালা এ ধরনের তুলনা পছন্দ করেন না।  এই আয়াতের মাধ্যমে জাহেলি যুগের সেই তালাক প্রথা রহিত করা হয়।

এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো:

১- রাসুলুল্লাহ (সা.) সাধারণ মানুষের মধ্যেই বসবাস করতেন এবং নারী-পুরুষ নির্বিশেষে যে কেউ তাদের ব্যক্তিগত সমস্যা সমাধানের জন্য তাঁর কাছে ধর্না দিতে পারত।

২- জাহেলি যুগের কিছু রীতি ও প্রথা নারীদের জন্য ছিল নিপীড়নমূলক। ইসলাম এসব প্রথা তুলে দিয়ে নারীদের জন্য সম্মানজনক জীবন নিশ্চিত করেছে।

৩- মহান আল্লাহ মানুষের পারিবারিক ও সামাজিক জীবন সম্পর্কে সম্যক অবহিত এবং তিনি নিজের প্রজ্ঞার ভিত্তিতে তাদের জন্য ন্যায়পূর্ণ বিধান জারি করেছেন।

৪- নারী পুরুষ যেন পরস্পরের প্রতি মিথ্যা অপবাদ আরোপ অথবা ভ্রান্ত ও অশ্লীল কথা মুখে উচ্চারণ করে পারিবারিক জীবনে বিঘ্ন সৃষ্টি না করে।

এবারে এই সূরার ৩ ও ৪ নম্বর আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:

وَالَّذِينَ يُظَاهِرُونَ مِنْ نِسَائِهِمْ ثُمَّ يَعُودُونَ لِمَا قَالُوا فَتَحْرِيرُ رَقَبَةٍ مِنْ قَبْلِ أَنْ يَتَمَاسَّا ذَلِكُمْ تُوعَظُونَ بِهِ وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرٌ (3) فَمَنْ لَمْ يَجِدْ فَصِيَامُ شَهْرَيْنِ مُتَتَابِعَيْنِ مِنْ قَبْلِ أَنْ يَتَمَاسَّا فَمَنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَإِطْعَامُ سِتِّينَ مِسْكِينًا ذَلِكَ لِتُؤْمِنُوا بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ وَتِلْكَ حُدُودُ اللَّهِ وَلِلْكَافِرِينَ عَذَابٌ أَلِيمٌ (4)

“আর যারা নিজেদের স্ত্রীদের সাথে যিহার করে এবং পরে [অনুতপ্ত হয় ও] তাদের উক্তি প্রত্যাহার করে, তবে একে অন্যকে স্পর্শ করার আগে একটি দাস মুক্ত করতে হবে, এই [ফরমানের মধ্য] দিয়ে তোমাদেরকে উপদেশ দেয়া যাচ্ছে। আর তোমরা যা কর, আল্লাহ সে সম্পর্কে সম্যক অবহিত।”( ৫৮:৩)

“কিন্তু যার এ সামর্থ্য থাকবে না, একে অন্যকে স্পর্শ করার আগে তাকে একাদিক্ৰমে দু’মাস সিয়াম পালন করতে হবে; যে তাতেও অসমৰ্থ, সে ষাটজন মিসকীনকে খাওয়াবে; এটা এ জন্যে যে, তোমরা যেন আল্লাহ ও তার রাসূলের উপর ঈমান আন। আর এগুলো আল্লাহর নির্ধারিত সীমা; আর [আল্লাহর বিধান অমান্যকারী] কাফিরদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।” ( ৫৮:৪)

এই দুই আয়াতে জিহার সম্পর্কে বলা হচ্ছে: এখন থেকে আর ‘তুমি আমার মায়ের মতো’ বাক্যটি বলার মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে তালাক হবে না বরং তালাকের নির্ধারিত বিধান ইসলাম স্পষ্ট করে দিয়েছে। তবে যে স্বামী এই বাক্যটি তার স্ত্রীকে ফেলেছে এবং তালাক দেওয়ার উদ্দেশ্যেই কথাটি বলেছে তাকে জরিমানা গুণতে হবে। এর ফলে সে আরেকবার একই কাজ করতে উদ্যত হবে না এবং বাকিরাও শিক্ষা পেয়ে যাবে। এ ধরনের পুরুষদের শাস্তি হচ্ছে তাদেরকে একটি গোলাম বা দাস কিনে আল্লাহর রাস্তায় মুক্ত করে দিতে হবে। যদি তা করার সামর্থ্য না থাকে তাহলে একাধারে ৬০ দিন রোজা রাখতে হবে। আর যদি রোজা রাখতে শারিরীকভাবে অক্ষম হয় তাহলে অন্তত ৬০ জন অভাবী মানুষকে পেট পুরে আহার করাবে। এই তিন কাজের যেকোনো একটি করার পরই সে তার স্ত্রীকে স্পর্শ করতে পারবে এবং স্বাভাবিক দাম্পত্য জীবন অব্যাহত রাখতে পারবে।

এই দুই আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে:

১- যেসব অন্যায় রীতিনীতির কারণে নারীদের ওপর জুলুম বা নিপীড়ন করা হতো ইসলাম তা নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি যেসব পুরুষ জুলুম করত তাদের শাস্তি বা জরিমানার ব্যবস্থা করেছে। পারিবারিক ভিত্তি মজবুত করার জন্যই এই ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।

২- মুখে আসলেই যেকোনো কথা যে কাউকে বিশেষ করে স্ত্রীকে বলে ফেলা যাবে না। কারণ, আমরা যেসব কথা বলি তার প্রত্যেকটির জন্য আল্লাহর কাছে জবাবদিহী করতে হবে।

৩- ইসলাম গোলাম বা দাস মুক্ত করার প্রতিটি সুযোগ কাজে লাগিয়েছে যাতে পর্যায়ক্রমে দাস প্রথার মূলোৎপাটন ঘটে।

৪- ইসলামে শাস্তি বা জরিমানার জন্য একাধিক পথ খোলা রাখা হয়েছে যাতে ব্যক্তি তার শারিরীক ও আর্থিক সামর্থ্য অনুযায়ী যেকোনো একটি বেছে নিতে পারে।

এবারে সূরা মুজাদালার ৫ ও ৬ নম্বর আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:

إِنَّ الَّذِينَ يُحَادُّونَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ كُبِتُوا كَمَا كُبِتَ الَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ وَقَدْ أَنْزَلْنَا آَيَاتٍ بَيِّنَاتٍ وَلِلْكَافِرِينَ عَذَابٌ مُهِينٌ (5) يَوْمَ يَبْعَثُهُمُ اللَّهُ جَمِيعًا فَيُنَبِّئُهُمْ بِمَا عَمِلُوا أَحْصَاهُ اللَّهُ وَنَسُوهُ وَاللَّهُ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ شَهِيدٌ (6)

“যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সঙ্গে শত্রুতা ও বিরোধিতা  করে তাদেরকে লাঞ্ছিত করা হবে যেমন লাঞ্ছিত করা হয়েছিল তাদের পূর্ববর্তীদেরকে। আমি সুস্পষ্ট আয়াত অবতীর্ণ করেছি আর (অস্বীকারকারী) কাফিরদের জন্য আছে অপমানজনক শাস্তি।”  ( ৫৮:৫)

“যে দিন আল্লাহ তাদের সকলকে পুনরুজ্জীবিত করে উঠাবেন অতঃপর তারা যে আমল করেছিল তা তাদেরকে জানিয়ে দেবেন।  [যেসব আমল] আল্লাহ হিসাব করে রেখেছেন যদিও [তারা] তা ভুলে গেছে। আর আল্লাহ প্রত্যেক বিষয়ে প্রত্যক্ষদর্শী।” ( ৫৮:৬)

আগের আয়াতগুলোতে জাহেলি যুগের ভ্রান্ত রীতিনীতির পার্থিব শাস্তি বর্ণনা করার পর এই দুই আয়াতে আল্লাহর নির্ধারিত সীমা লঙ্ঘনকারীদের পারলৌকিক শাস্তির কথা জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। বলা হচ্ছে: আল্লাহর নির্ধারিত বিধান ও শিক্ষার বিরোধিতা করার পরিণাম হচ্ছে কুফরি যার পরিণতি পার্থিব জীবনে অপমান ও লাঞ্ছনা। আর কুফরির মূল শাস্তি দেওয়া হবে পরকালে। মানুষ দুনিয়ার জীবনে যেসব অশ্লীল কর্ম করেছিল তা কিয়ামতের দিন তাদেরকে জানিয়ে দেওয়া হবে। এর ফলে তারা আবার অপমানিত হবে এবং এরপর তাদেরকে দেওয়া হবে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।

এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো:

১- যেকোনো বিষয়ে আল্লাহর বিধান সুস্পষ্ট হয়ে যাওয়ার পর তার বিরোধিতা করা কিংবা তা বাস্তবায়নে গড়িমসি করার পরিণতি দুনিয়া ও আখিরাতে ভালো নয়।

২- আল্লাহর রাসূলের বিরুদ্ধাচরণের অর্থ খোদ আল্লাহর বিরুদ্ধাচরণ করা। আর যারা তা করবে তাদের জন্য অপমান ও যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি অপেক্ষা করছে।

৩- কিয়ামতের দিন অপরাধী ব্যক্তিদেরকে আগে তাদের অপরাধসমূহ জানিয়ে দেওয়া হবে যাতে তারা বুঝতে পারে কোন্‌ কোন্‌ অপরাধে তাদের কী কী শাস্তি হলো। এরপর তাদেরকে শাস্তি ভোগ করতে পাঠানো হবে।

 

তো শ্রোতাবন্ধুরা! এরইসঙ্গে শেষ করছি কুরআনের আলোর আজকের আয়োজন। আমাদের সঙ্গ দেয়ার জন্য আপনাদের অনেক ধন্যবাদ।  

পার্সটুডে/এমএমআই/ বাবুল আখতার/১২

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ