পাকিস্তান, চীন ও আফগানিস্তানের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতা বিস্তারে ইরানের ভূমিকা- (পর্ব-৭)
'ইরান, পাকিস্তান, চীন ও আফগানিস্তানের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতা বিস্তারে তেহরানের ভূমিকা' শীর্ষক অনুষ্ঠানের গত পর্বের অনুষ্ঠানে আমরা ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড প্রকল্প এবং 'সাউথ-ইস্ট স্ট্রিং অফ পার্লস' বা ‘দক্ষিণ-পশ্চিম মুক্তোর ছড়া' নামে সমুদ্রপথে যোগাযোগ ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। আজকের অনুষ্ঠানে আমরা চারপক্ষীয় সহযোগিতা বাস্তবায়নে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, সামরিক ও নিরাপত্তা ক্ষেত্রে সহযোগিতার গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করবো।
চীন ও পাকিস্তানের মধ্যকার অর্থনৈতিক করিডোর 'সিপিইসি' এবং ইরান ও চীনের মধ্যকার ২৫ বছর মেয়াদি সহযোগিতা চুক্তি এসবই চীনের প্রস্তাবিত ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড পরিকল্পনারই অংশ যে পরিকল্পনার সাথে এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের অন্তত ৫৬টি দেশ যুক্ত হবে। এই পরিকল্পনা একবিংশ শতাব্দীতে চীন ও আমেরিকার মধ্যে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার ক্ষেত্র সৃষ্টি করতে পারে যার প্রভাব ভারত মহাসাগর ও পারস্য উপসাগরীয় এলাকার দেশগুলোর ওপরও পড়তে পারে। পারস্য উপসাগরীয় এলাকা প্রাকৃতিক জ্বালানির গুরুত্বপূর্ণ উৎস এবং হরমুজ প্রণালীর মাধ্যমে আরব সাগর ও ওমান সাগর অতিক্রম করে এসব জ্বালানি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বাজারে সরবরাহ করা হয়। আজকের অনুষ্ঠানে আমরা চীন ও আমেরিকার প্রতিদ্বন্দ্বিতার ক্ষেত্রে ইরান, পাকিস্তান, চীন ও আফগানিস্তানের মধ্যকার আঞ্চলিক সহযোগিতার প্রভাব নিয়ে আলোচনা করবো।
চীন ও পাকিস্তানের মধ্যকার অর্থনৈতিক করিডোর 'সিপিইসি' এবং ইরান ও চীনের মধ্যকার ২৫ বছর মেয়াদি সহযোগিতা চুক্তি ইরান, আফগানিস্তান, চীন ও পাকিস্তানের মধ্যে সর্বাত্মক সহযোগিতার ক্ষেত্র তৈরি করবে। অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষা ছাড়াও শিক্ষা, বিজ্ঞান, যোগাযোগ, প্রযুক্তি ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও পারস্পরিক সহযোগিতার নয়া অধ্যায়ের সূচনা করবে। প্রযুক্তিগত সহযোগিতা ছাড়া এ উন্নয়ন সম্ভব নয়। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সহযোগিতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অনেক বছর ধরেই পাকিস্তানের হাজার হাজার ছাত্র স্কলারশিপ নিয়ে চীনে পড়তে যায়। এশিয়া ও আফ্রিকার অন্যান্য দেশ থেকেই শিক্ষার্থীরা চীনে যায়। গত কয়েক বছরে ইরানেরও বহু ছাত্র স্কলারশিপ নিয়ে চীনের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে। তেহরানে চীনের রাষ্ট্রদূত জানিয়েছেন, অন্তত ৪০০ ইরানি ছাত্র চীনে পড়াশোনা করছে। অন্যদিকে চীনের অন্তত ৪০০ ছাত্র ইরানেও পড়াশোনা করছে।
বাস্তবতা হচ্ছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে চীন ও ইরানের মধ্যকার সহযোগিতা বেড়েই চলেছে। ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড প্রকল্পের আওতায় চীনা কর্তৃপক্ষ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয় সহযোগিতা সংস্থা আসিয়ানভুক্ত অঞ্চল, আরব অঞ্চল, মধ্যএশিয়া, মধ্য ইউরোপ ও পূর্ব ইউরোপীয় অঞ্চলের দেশগুলোতে প্রযুক্তি ক্ষেত্রে সহযোগিতা বিস্তারের প্রস্তাব তুলে ধরেছে। এরই অংশ হিসেবে চীন এ অঞ্চলের দেশগুলোর সাথে যোগাযোগ ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সম্পর্ক জোরদারের চেষ্টা করছে।
সিল্করোড প্রকল্প বাস্তবায়নে কেবল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ভূমিকা একমাত্র বিষয় নয়। ট্রানজিট রুটে নিরাপত্তাও এ ক্ষেত্রে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কেননা সন্ত্রাসবাদ, বিচ্ছিন্নতাবাদ, সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্র ও মাদক চোরাকারবারিরা আঞ্চলিক যোগাযোগের পথে প্রধান নিরাপত্তা হুমকি। তাই ইরান, পাকিস্তান ও চীনের মধ্যে নিরাপত্তা ক্ষেত্রে সহযোগিতা বিস্তারের বিষয়টিও গুরুত্ব পাচ্ছে কেননা এককভাবে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।
ইরান, চীন ও পাকিস্তানের মধ্যকার বৃহৎ অর্থনৈতিক প্রকল্প বাস্তবায়নে সবচেয়ে বড় বাধা হচ্ছে আঞ্চলিক সন্ত্রাসবাদ, উগ্রবাদ ও জাতিগত বিচ্ছিন্নতাবাদ। এমনকি চীনের শিনজিয়ান প্রদেশেও এ সংকট প্রবল। সেখানে বিচ্ছিন্নতাবাদ ও ধর্মীয় উগ্রবাদের সমস্যা রয়েছে। বিচ্ছিন্নতাবাদী উইঘোর প্রদেশের ধনী ব্যবসায়ী মিসেস গ্বাদির যিনি আমেরিকায় বসবাস করেন তিনি তথাকথিত পূর্ব তুর্কমেনিস্তানের ইসলামি আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন যারা কিনা উগ্র তাকফিরি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী দায়েশের আওতাধীনে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে। তারা চীনের উইঘোর অঞ্চলকে চীন থেকে বিচ্ছিন্ন করে স্বাধীন ইসলামি শাসন ব্যবস্থা চালু করার কথা বলে। অন্যদিকে, পাকিস্তানের গোয়াদর ও ম্যাকরন উপকূলীয় অঞ্চলে পাখতুন খোয়া ও বালুচ বিচ্ছিন্নতাবাদীরাও তৎপর রয়েছে। তারা ওই অঞ্চলে চীনের প্রভাব বিস্তারের তীব্র বিরোধী এবং চীন ও পাকিস্তানের মধ্যকার অর্থনৈতিক করিডোর 'সিপিইসি' বাস্তবায়নেরও বিরোধী। এ অবস্থায় আর্থ-রাজনৈতিক ও বাণিজ্য ক্ষেত্রে এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতা যত বাড়বে ততই নিরাপত্তা ব্যবস্থাকেও জোরদার করতে হবে।
এ কারণে অনেক বিশেষজ্ঞ দক্ষিণ এশিয়ায় ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রে চীন ও পাকিস্তানের মধ্যকার সহযোগিতাকে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব সৃষ্টিকারী বলে মনে করেন যাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হচ্ছে ভারত ও আমেরিকা। এ কারণ চীনকে নিরাপত্তার বিষয়টি ভাবতে হচ্ছে। কেননা একদিকে প্রতিদ্বন্দ্বী দেশের উপস্থিতি অন্যদিকে উইঘোর প্রদেশে সন্ত্রাসবাদ, বিচ্ছিন্নতাবাদ ও উগ্রবাদের মোকাবেলা করতে হচ্ছে চীনকে।
মোটকথা, আঞ্চলিক উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে গেলে শুধু প্রযুক্তি ও নিরাপত্তা ক্ষেত্রে সহযোগিতা বিস্তারই যথেষ্ট নয়। এর সাথে প্রয়োজন সামরিক ক্ষেত্রে সহযোগিতা। এ কারনে এই তিন দেশ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্যাপক সামরিক সহযোগিতা গড়ে তুলেছে।
ভূ-কৌশলগত অবস্থানের কারণে ইরানের কাস্পিয়ান সাগর ও পারস্য উপসাগরীয় জ্বালানি অঞ্চলে চীনের বিরাট স্বার্থ রয়েছে। জ্বালানি সমৃদ্ধ এই দুই সাগর এলাকা চীনের কাছে ইরানের গুরুত্বকে বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। তবে চীনের এই বৃহৎ পরিকল্পনা বাস্তবায়নকে কেন্দ্র করে একবিংশ শতাব্দীতে চীন ও আমেরিকার মধ্যে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার ক্ষেত্র তৈরি করতে পারে। বলা যায় এই দুই পরাশক্তির প্রতিযোগিতা ভারত মহাসাগর ও পারস্য উপসাগরীয় এলাকা পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করতে পারে। বিশেষ করে পারস্য উপসাগরীয় এলাকা জ্বালানি সম্পদে পরিপূর্ণ থাকায় এবং সেই জ্বালানি ওমান সাগর হয়ে আরব সাগরে প্রবেশ করে তা পূর্ব ও প্রাচ্যের বাজারে প্রবেশ করায় এ অঞ্চল চীন-মার্কিন প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র হয়ে উঠতে পারে। এ সংক্রান্ত আলোচনার আগামী পর্বের অনুষ্ঠানগুলোতে আমরা চীন-মার্কিন প্রতিযোগিতায় ইরান, পাকিস্তান, চীন ও আফগানিস্তানের ভূমিকার বিষয়টি পর্যালোচনা করবো। #
পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।