আগস্ট ১৯, ২০২৩ ১২:০৮ Asia/Dhaka

প্রিয় পাঠক ও শ্রোতাবন্ধুরা! সালাম ও শুভেচ্ছা নিন। আশা করি যে যেখানেই আছেন ভালো ও সুস্থ আছেন। আজ আমরা শুনবো প্রাচীন একটি প্রবাদের গল্প। প্রবাদটি হলো: আগে কুপ কাটো তারপর মিনার চুরি..। প্রবাদের পেছনের গল্পটি এরকম:

প্রাচীনকালে ছোট ছোট দুটি গ্রাম ছিল পাশাপাশি। দুই গ্রামের মাঝখানে একটি ছোট নদীর দূরত্ব ছিল না। একটি গ্রামের নাম উর্ধ্বরুদ গ্রাম অপরটির নাম নিম্নরুদ গ্রাম। ফার্সি ভাষায় রুদ শব্দের অর্থ নদী। নিম্নরুদ গ্রামের লোকজনের বেশিরভাগই ছিল অশিক্ষিত। কাজেই অভাব-অনটনেই কাটতো তাদের দিনকাল।

তাদের বাড়িঘরগুলো ছিল কাঁচা-ইটের তৈরি। গ্রামীণ ওইসব বাড়িঘর ছাড়া তেমন কোনো স্থাপনা সেখানে দেখা যেত না। অপরদিকে উর্ধ্বরুদ গ্রামের লোকজনের অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল তুলনামূলকভাবে ভালো। তারা চাষাবাদ করে মোটামুটি ভালোই উপার্জন করতো। সবকিছুর উর্ধ্বে যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ তা হলো উর্ধ্বরুদ গ্রামে একটা মিনার ছিল। ওই মিনারটি মূলত ইট পোড়ানোর কাজের সুবিধার্থে তৈরি করা একটি চিমনি। বুঝতেই পারা যাচ্ছে যে ওই গ্রামের লোকজন কৃষিকাজ ছাড়াও ইট তৈরির কাজও করতো। সুতরাং তাদের বাড়িঘরগুলো তুলনামূলকভাবে একটু ভালো এবং ডিজাইনের ছিল। নিম্নরুদ গ্রামের লোকজনের ইচ্ছে ছিল তাদের অবস্থার পরিবর্তন ঘটানোর। তারাও চাইতো তাদের ঘরগুলো পোড়া ইট দিয়ে সুন্দর করে বানাতে। কিন্তু তারা কিছুতেই আকাশচুম্বি চিমনি তৈরি করতে পারছিলো না। কীভাবে তাহলে ইট পোড়াবে?

নিম্নরুদ গ্রামের অধিবাসীরা সুযোগ পেলেই সমবেত হয়ে উর্ধ্বরুদ গ্রামের লোকজনের জীবনমান নিয়ে কথা বলতো। এভাবে আলাপ-আলোচনা করতে করতে একদিন তারা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলো: তারাও যদি ওরকম উঁচু একটা চিমনি তৈরি করতে পারতো তাহলে পোড়া ইটের বাড়ি তৈরি করতে পারতো। নিম্নরুদ গ্রামের মুরব্বিরা একমত হলো তারা ইট পোড়ানোর জন্য একটা চিমনি তৈরি করবে। সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলো অন্ধকার এক রাতে উর্ধ্বরুদ গ্রামে যাবে সবাই। সেখান থেকে তাদের ইট পোড়ানোর চিমনিটা চুরি করে নিজেদের গ্রামে নিয়ে আসবে। যেই কথা সেই কাজ। অমাবশ্যা রাতের ঘুটঘুটে আঁধার। নিম্নরুদ গ্রামের শক্তিশালী ও স্বাস্থ্যবান পঞ্চাশ যুবক বিশটি তরতাজা গাধা নিয়ে উধ্বরুদ গ্রামের দিকে যাত্রা করলো।

নদীর উপর দিয়ে তৈরি করা সেতু পার হতে হতে উঁচু সেই চিমনি পর্যন্ত পেঁছলো তারা। ওই উর্ধ্বরুদ গ্রামের লোকজন কেউই নিম্নরুদ গ্রামের লোকজনের চুরির পরিকল্পনা সম্পর্কে কিছুই জানতো না। কাজেই তারা নিজ নিজ ঘরে আরাম করে ঘুমাচ্ছিলো। নিম্নরুদ গ্রামের সেই চোরের দল যখন বুঝতে পারলো তাদেরকে কেউ দেখতে পায় নি তখন তারা দড়ি-কাছি বের করলো এবং মিনারে বৃত্তাকারে পেঁচালো। তারপর সবাই মিলে মিনারটাকে তার জায়গা থেকে সরানোর জন্য একসঙ্গে হ্যাঁচকা টান দিতে শুরু করলো। তার আগে তাদের গাধাগুলোকে সারিবদ্ধভাবে মিনার বরাবর দাঁড় করালো যাতে মিনার তাদের পিঠের ওপর লম্বালম্বি পড়ে।

চিমনি নিয়ে যখন টানাটানি করছিল নিম্নরুদ গ্রামের যুবকেরা ঘটনাচক্রে তাদের চেঁচামেচির শব্দ ইট তৈরির কারিগরের কানে গেল। ওই কারিগর এখানে চিমনির গোড়াতেই বসবাস করতো। ইটের কারিগর বৃদ্ধ মানুষ। বুঝে উঠতে পারছিলো না হচ্ছেটা কী! পা টিপে টিপে বাইরে এলো এবং যুবকদের কাছে গেল। কান পেতে তাদের কথা শুনে বুঝতে পারলো তারা কী করতে চায়। বুড়ো কারিগর যুবকদের মূর্খতা দেখে মনে মনে হাঁসতে হাঁসতে বললো: মিনার এভাবে চুরি করা যায় না। কীরকম গাধা এরা। ঠিক আছে, ওরা গায়ের জোরে যা করতে চায় করুক। মূর্খ যুবকেরা যতই চেষ্টা করলো চিমনি কোনোভাবেই নাড়াতেও পারলো না। ধীরে ধীরে হতাশ হয়ে পড়লো। কেউ কেউ চিন্তা করতে লাগলো আর কী উপায়ে মিনারটা তুলে নিয়ে যাওয়া যায়।

মূর্খদের হাল-অবস্থা দেখে বুড়োর মায়া হলো। একটা কাশি দিলো বুড়ো সবাইকে জানিয়ে দিলো তার উপস্থিতির কথা। বুড়ো তাদের সামনে এসে বললো: তোমাদের দেখে মনে হচ্ছে মিনারটা তুলে নিয়ে তোমাদের গ্রামে দাঁড় করাতে চাচ্ছো, তাই না? একজন বুড়ো মুখ বন্ধ করতে এগিয়ে গেল। বুড়ো হাঁসলো। বললো: আমার হাত-মুখ বাঁধার দরকার নেই। আমি ত্রিশ বছর ধরে এখানে ইট পোড়ানোর কাজ করছি। ক্লান্ত হয়ে গেছি। তোমরা এই চিমনি নিয়ে গেলে আমি কাউকে তো বলবোই না বরং খুশি হবো। যুবকেরা এবার তাদের দড়ি-কাছি টানার কাজে মনোযোগ দিলো। ঘণ্টাখানেক কসরৎ করেও লাভ হলো না। যুবকের দলও ক্লান্ত হয়ে পড়লো। কিন্তু মিনার একটু নাড়াতে পারলো না। সুতরাং তারা এক কোণে বসে বিশ্রাম নিতে নিতে ভাবছিল কী করা যায়।

বুড়োও তাদের কথায় যোগ দিলো। বুড়ো বললো: এই মিনারের অর্ধেকটা তো মাটির নীচে। বুঝতেই পারছো কত বড়ো মিনার। তোমরা যে চুরি করতে চাচ্ছো লুকাবে কোথায় ভেবেছো? একজন বললো: কী ভাববো? বুড়ো বললো: বারে! মিনার চুরি হলে সবাই খোঁজাখুঁজি করবে না? যদি দেখে তোমাদের গ্রামে মিনার, তখন? সুতরাং কিছুদিন মিনারটাকে লুকিয়ে রাখতে হবে। কোথায় লুকাবে? যুবকের দল বুঝলো বুড়ো মন্দ বলছে না। বুড়োকে বললো: তাহলে কী করে লুকানো যায়? বুড়ো বললো: প্রথমে গভীর একটা কুপ খনন করো! এই মিনারের যতটা দেখা যায় তার দ্বিগুণ গভীর।

যুবকের দল একে অপরের দিকে তাকিয়ে বললো: ঠিকই বলছে। আগে কুপ খনন করে তারপর মিনার চুরি করা উচিত। চলো আমরা ফিরে যাই। যুবকের দল ফিরে গেল এবং কুপ খননের কাজে লেগে গেল। কিন্তু অতো গভীর কুপ খনন করতে পারলো না তারা।

এই ঘটনার পর থেকে যখনই কেউ কাউকে তার প্রাথমিক কাজ আগে করার কথা বলতে চাইতো, তখনই বলতো: আগে কুপ কাটো তারপর মিনার চুরি করো।#

পার্সটুডে/এনএম/১৯/৮৩

মূল ফার্সি গল্পের রূপান্তর: নাসির মাহমুদ