ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা ইসরাইলের অর্থনীতিকে কীভাবে প্রভাবিত করেছে?
-
ইরানের সাথে যুদ্ধের পর ইসরাইলের অর্থনৈতিক সমস্যা তীব্রতর হচ্ছে
পার্সটুডে: ইহুদিবাদী শাসনযন্ত্রের অর্থনৈতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইরানের সাথে ১২ দিনের যুদ্ধে দখলদার ইসরাইলের অর্থনীতিতে সরাসরি ১২ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয়েছে। ইরানের সাথে এই যুদ্ধটি ইসরাইলের জন্য শুধু নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক ক্ষতিই বয়ে আনেনি, বরং অর্থনৈতিকভাবেও প্রচণ্ড আঘাত হেনেছে।
প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় প্রায় ৩৩ হাজার বাণিজ্যিক ও আবাসিক ভবন সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে ধ্বংস হয়েছে। এসব ভবন পুনর্নির্মাণে আনুমানিক ৬ বিলিয়ন ডলার খরচ হবে।
পার্সটুডের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসরাইলের অর্থ মন্ত্রণালয় ও কর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ক্ষতিগ্রস্ত অবকাঠামো মেরামত ও ব্যবসাগুলোকে ক্ষতিপূরণ দিতে প্রায় ১০ বিলিয়ন শেকেল (প্রায় ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার) প্রয়োজন। এছাড়া, ইসরাইলি স্টক এক্সচেঞ্জে ইরানের তীব্র ক্ষেপণাস্ত্র হামলা অবৈধ শাসনের মোট রপ্তানির ৮% বাজারকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। শেয়ারবাজারে আঘাত বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়েছে, যার ফলে ফিলিস্তিনি অধ্যুষিত এলাকায় ব্যাপক শেয়ার বিক্রি ও বাজারের পতন ত্বরান্বিত হয়েছে, যা ইসরাইলের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলেছে।
ইসরাইলি মিডিয়া ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ওয়াইজম্যান ইনস্টিটিউট ও হাইফা রিফাইনারিতে যে বিস্তৃত বিলিয়ন-ডলারের ক্ষতি হয়েছে- তা উল্লেখ করে জানিয়েছে, ইরানের হামলার ফলে ইসরাইলের ক্ষতির প্রকৃত মাত্রা ধীরে ধীরে প্রকাশ পাচ্ছে। ইসরাইলি সেনাবাহিনীর সাবেক অর্থনৈতিক বিভাগের প্রধান মেজর জেনারেল (অব.) রাম আমিনাচ বলেছেন, ইরানের সাথে যুদ্ধের খরচ ইসরাইলের যুদ্ধ বাজেটকে ২০০ বিলিয়ন শেকেল ছাড়িয়ে ফেলেছে, কারণ ইসরাইলকে এমন ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করতে হয়েছে যার প্রতিটির মূল্য ৩ মিলিয়ন ডলারের বেশি।
এদিকে, গাজা যুদ্ধের পর থেকে ইসরাইলের অর্থনৈতিক অবস্থা সংকটাপন্ন। প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, গাজা যুদ্ধের ফলে ইসরাইলে বিদেশি বিনিয়োগ ৬০%-এর বেশি কমে গেছে। এছাড়া, এই যুদ্ধের কারণে ৪৬ হাজারের বেশি কোম্পানি বন্ধ হয়ে গেছে। প্রযুক্তি খাতের ৪৯% কোম্পানি বা স্টার্টআপ তাদের বিনিয়োগ ইসরাইল থেকে প্রত্যাহার করেছে। এই পরিস্থিতিতে ইসরাইলের সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী আভিগডোর লিবারম্যান বলেছেন, নেতানিয়াহু শুধু সামরিকভাবে ব্যর্থই হননি, বরং ইসরাইলকে একটি নজিরবিহীন অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিয়েছেন।
১২ দিন পর, যুদ্ধ শেষ হলেও পরিস্থিতি আরও নাজুক হয়ে পড়েছে। যদিও ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ সঠিক ক্ষয়ক্ষতির পরিসংখ্যান গোপন রাখার চেষ্টা করছে, তবু বিশ্লেষকরা বলছেন, সরাসরি ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১২ বিলিয়ন ডলার এবং যুদ্ধ যদি দীর্ঘস্থায়ী হতো তবে ইসরায়েল সম্পূর্ণ অর্থনৈতিক পতনের মুখোমুখি হতে পারত।
অর্থনৈতিক সূচকগুলো দেখাচ্ছে যে, গাজা যুদ্ধের পর ইসরাইলের বাজেট ঘাটতি যা আগে বেড়েছিল, তা এখন প্রায় ৬%-এ পৌঁছেছে। একই সময়ে ইসরাইলের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও কমপক্ষে ০.২% কমবে, যা রাজস্ব আয়ে পতন ডেকে আনবে। এই প্রসঙ্গে ইসরাইলের অর্থ মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র ইদিওত আহরোনতকে বলেছে, যুদ্ধের খরচ মেটাতে এবং জরুরি প্রতিরক্ষা চাহিদা পূরণের জন্য ইসরাইল যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে আর্থিক সাহায্য বা ঋণের গ্যারান্টি চাইতে পারে।
ইসরাইলের বৃহত্তম শ্রম সংঘ হিস্টাড্রুটের অর্থনৈতিক উপ-প্রধান অ্যাডাম ব্লুমবার্গ বলেছেন, যুদ্ধের কারণে অর্থনৈতিক স্থবিরতা প্রতিদিন ইসরাইলের অর্থনীতিতে প্রায় ১.৫ বিলিয়ন শেকেল (২৯৪ মিলিয়ন ডলার) ক্ষতি করছে, এবং ১২ দিনে মোট ৩.৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি ক্ষতি হয়েছে।
বাজারগুলো এখন পূর্বাভাস দিচ্ছে যে, ইসরাইলের বাজেট ঘাটতি জিডিপির ৬% ছাড়িয়ে যেতে পারে, যেখানে অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্ধারিত সীমা ছিল ৪.৯%। এছাড়া, ইসরাইল ইরানের ব্যাপক ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা প্রতিরোধে আরও বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করেছে। এই হামলাগুলো ইসরাইলের জ্বালানি সরবরাহে বিঘ্ন ঘটিয়েছে এবং দেশটির পুঁজিবাজারেও বড় ধাক্কা দিয়েছে।
অন্যদিকে, যুদ্ধের সামাজিক খরচও ইসরাইলি নাগরিকদের উপর প্রভাব ফেলেছে। ইসরাইলের সামরিক বাজেট বৃদ্ধি এবং যুদ্ধজনিত নিরাপত্তাহীনতা—যার ফলে বহু বিদেশি বিনিয়োগকারী ও উদ্যোক্তা ইসরাইল ছেড়ে চলে গেছেন—এটি শুধু অর্থনৈতিকভাবেই ইসরাইলকে আঘাত করেনি, বরং সামাজিকভাবেও বিপরীত অভিবাসন, যা গত এক বছরে বেড়েছে, ইসরাইলি কর্তৃপক্ষের জন্য একটি বড় চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন ইরানের সাথে যুদ্ধের ফলে এই অভিবাসন আবারও বাড়ছে।
ইসরাইলি পত্রিকা ইসরাইল হায়োম এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, যুদ্ধের প্রথম সপ্তাহে ৫০ হাজারের বেশি ইহুদি দখলীকৃত ফিলিস্তিন অঞ্চল থেকে পালিয়ে গেছে, যা ২০০৬ সালের লেবানন যুদ্ধের পর সবচেয়ে বড় উল্টো অভিবাসন।
এই পরিস্থিতি ইসরাইলের রাজনৈতিক ও সামাজিক বিভক্তি আরও বাড়িয়ে দিয়েছে, যার প্রভাব নেতানিয়াহুর জনপ্রিয়তার ওপর পড়েছে।
ফ্রান্সেস্কো আনজেলোনি, ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের একটি গবেষণা সংস্থার সমন্বয়কারী বলেন, “ইসরািইল দীর্ঘদিন ধরে গাজায় যুদ্ধ চালাচ্ছে যা তাদের সম্পদ নিঃশেষ করে ফেলছে, আর ইরানের সঙ্গে সাম্প্রতিক যুদ্ধ শুধু ধ্বংস নয়, বরং নিরাপত্তাহীনতা ও নেতানিয়াহুর ব্যর্থতাও সামনে এনেছে।”#
পার্সটুডে/এমএআর/১