সেপ্টেম্বর ১৮, ২০২৩ ১৪:১৪ Asia/Dhaka

পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ইরানি যোদ্ধাদের এই বিশ্বাস ছিল যে, আল্লাহর প্রতি ঈমান তাদেরকে সাহসী, প্রতিরোধকামী ও গৌরবময় মানুষে পরিণত করেছে। একজন শহীদ তার ওসিয়নামায় বিষয়টিকে এভাবে বর্ণনা করেন: “আমরা ইরানি যোদ্ধারা আল্লাহর প্রতি ঈমানের শক্তিতে বলীয়ান হয়ে, তাঁর অদৃশ্য সহযোগিতায় এবং খোদাপ্রেমিক ইরানি জনগণের দোয়ার বরকতে রাত-দিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছি।

কিন্তু আমরা কোনোদিন প্রাচ্য বা পাশ্চাত্যের কাছে হাত পাতবো না এবং আমাদের চলার পথে যত বাধা আসুক তা অতিক্রম করে যাবো। ”

যুদ্ধের সময় ইরাকি বাহিনীর হাতে বন্দি হন ইয়াকুব মোরাদি নামের একজন ইরানি যোদ্ধা।  ইরাকের কারাগারে তার সঙ্গে কথা হয় রেডক্রসের একজন কর্মীর। ওই কর্মীকে মোরাদি জিজ্ঞাসা করেন, মানুষের শরীর বেশি শক্ত নাকি লোহা বেশি শক্ত?

রেডক্রসের কর্মী জবাব দেন- লোহা। তখন মোরাদি বলেন, তাহলে আমি এখানে থাকা অবস্থায় এখানকার লোহার বেরিগুলোতে কতবার জং ধরে যেতে দেখলাম কিন্তু কৈ, আমি তো এখনও সতেজ এবং দৃঢ় মনোবল নিয়ে বেঁচে আছি? এরপর তিনি নিজে থেকেই আবার বলেন, একমাত্র ঈমানি বলে বলীয়ান হয়ে আমরা এভাবে সতেজ ও দৃঢ় আছি।

ইরাকিদের হাতে বন্দি হয়েছিলেন ইরানি পাইলট হুশাং শারভিন। তিনি ইরাকি কারাগারে বন্দি থাকার দিনগুলো সম্পর্কে ‘একাকী বছরগুলো’ শিরোনামে একটি বই লিখেছেন। ওই বইয়ের একাংশে লেখা হয়েছে, “আল্লাহর সঙ্গে এতটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন করেছিলাম যে, কারাগারের কঠিন প্রতিকূল ও পীড়াদায়ক পরিস্থিতিও আমাকে কষ্ট দিত না। ফলে ওই বন্দিজীবন যদি একশ বছরও লম্বা হতো তারপরও আমি দুর্বল হয়ে যেতাম না বা ভেঙে পড়তাম না।”

ইরানের বিমান বাহিনীর কর্মকর্তা হুশাং শারভিন তার বইয়ের আরেক জায়গায় বলেন, “কারাগারের নির্জন সেলে বসে আমি এই সুন্দর সত্য উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম যে, সুখ ও শান্তি কেবলমাত্র আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন বা আধ্যত্মিক শক্তি বৃদ্ধির মাধ্যমে সম্ভব হতে পারে। অন্য কোনো উপায়ে সুখ বা শান্তি লাভ করা সম্ভব নয়। যার আধ্যাত্মিক শক্তি যত বেশি বৃদ্ধি পাবে এই জগতে তার তত বেশি সুখলাভ হবে।”

ইরানের বিমান বাহিনীর তৎকালীন উপ প্রধান এই বাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের সদস্য ও পাইলটদের কর্মকাণ্ডে ঈমানের প্রভাব সম্পর্কে বলেন, পাইলটরা ইরানের অন্যান্য যোদ্ধার মতো মুমিন ও পরোপকারী মানুষ বলে তারা অভিযান চালাতে গিয়ে তুলনামূলক কম সমস্যার সম্মুখীন হন।

তিনি উদাহরণ দিতে গিয়ে বলেন, “যুদ্ধের শুরু থেকেই বিমানবাহিনী নানা ধরনের সীমাবদ্ধতার সম্মুখীন ছিল। একারণে যুদ্ধ শুরু করার পর নতুন কোনো হেলিকপ্টার বা যুদ্ধবিমান কেনা সম্ভব হয়নি। কিন্তু তারপরও আমাদের গোটা বাহিনী বিশেষ করে পাইলটদের দৃঢ় ঈমান ও অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল হিসেবে আমরা আগ্রাসী ইরাকি বাহিনীর সঙ্গে সমানে সমানে টক্কর দিচ্ছি।  আমি এ বিষয়ে নিশ্চিত যে, প্রয়োজন হলে আমাদের পাইলটরা আরো হাজার হাজার বার অভিযানে অংশ নেবেন এবং শত্রুকে আত্মসমর্পনে বাধ্য করবেন।”

পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধে সমরাস্ত্রের দিক দিয়ে অত্যন্ত সংকটে থাকা সত্ত্বেও কেবলমাত্র আল্লাহর ওপর ভরসা করার কারণে ইরানি যোদ্ধারা শত্রুসেনাদের পরাজিত করতে এবং যুদ্ধের মোড় ইরানের পক্ষে ঘুরিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছেন। 

ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী বা আইআরজিসির অন্যতম কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আহমাদ কাজেমি ইরানি যোদ্ধাদের আল্লাহর ওপর নির্ভরতা সম্পর্কে বলেন: যুদ্ধের শুরুর দিকে আমি আহওয়াজ-খোররামশাহর মহাসড়কে অবস্থিত হামিদ ঘাঁটিতে ছিলাম। হঠাৎ শত্রুসেনাদের আক্রমণে প্রথমে আমরা ভড়কে যাই। ইরাকি সেনারা তাদের বিমান বাহিনীর ছত্রছায়ায় বহু ট্যাংক ও সাঁজোয়া যান নিয়ে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছিল।  আমি সেদিন আল্লাহর শক্তি ও আল্লাহর ওপর নির্ভরতার ফল অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করেছিলাম।  আমরা মাত্র ১৯ জন যোদ্ধা একদল বিশাল প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনীর মোকাবিলায় দাঁড়িয়ে যাই এবং তাদেরকে পশ্চাদপসরণে বাধ্য করি। সেদিন শত্রুদের বেশ কয়েকটি ট্যাংক ও সাঁজোয়া যান ধ্বংস হয় এবং আমরা কয়েকজন শত্রুসেনাকে আটক করতে সক্ষম হই।

ইরানের সেনাবাহিনীর অন্যতম কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আহমাদ দাদবিন ইরাকি বাহিনীর হাতে দখল হয়ে যাওয়া খোরররামশাহর শহর পুনরুদ্ধার করার অভিযান সম্পর্কে বলেন: শাহাদাতপিয়াসী অন্তর, সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারের প্রস্তুতি, ইরানি যোদ্ধাদের রাতভর দোয়া-মুনাজাত এবং দখল হয়ে যাওয়া মাতৃভূমি পুনরুদ্ধারের অদম্য বাসনার কারণে বায়তুল মুকাদ্দাস অভিযানে জয়লাভ করে খোররামশাহর পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে।

ইরানের সেনাবাহিনীর ৮৮ খোরাসান ডিভিশনের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আমির মোহাম্মাদিফার যোদ্ধাদের শক্তিবৃদ্ধিতে আল্লাহর ওপর ভরসা করার প্রভাব সম্পর্কে বলেন, “আমরা পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধে নিজেদেরকে আল্লাহর নিকটবর্তী করতে সক্ষম হয়েছিলাম। সকল শয়তানি শক্তির জাল ছিন্ন করার পাশাপাশি আমরা নিজেদের নাফসে আম্মারার সঙ্গে লড়াই করেও বিজয়ী হতে পেরেছিলাম। এখন আমরা আর কাউকে ভয় পাই না বরং একমাত্র আল্লাহকে ভয় পাই ও তার ওপর পূর্ণ নির্ভর করি।”

ইরানি যোদ্ধাদের এই ঈমানি চেতনার কথা এমনকি শত্রুসেনারাও স্বীকার করেছে। ইরানের হাতে আটক ইরাকি সেনারা মুক্ত হওয়ার পর ইরানি যোদ্ধাদের প্রশংসা করতে বাধ্য হয়েছে। ইরাকি কর্নেল ইহসান আল-মিকদাদি ইরানি যোদ্ধাদের প্রশংসা করে বলেন, “একবার এক অভিযানে আমাদের কমান্ডাররা এতটা অগ্রসর হয়েছিলেন যে, তারা বিজয়ের ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে যান। কারণ, তারা দেখতে পান ইরাকি ট্যাংকগুলো ঘর-বাড়ি ভেঙেচুড়ে এগিয়ে যাচ্ছে এবং ইরাকি কামানের গোলায় ইরানের প্রতিরক্ষা শিবিরে আগুন ধরে গেছে। ফলে আমরা নিশ্চিত ছিলাম যে, আজ একজন ইরানিও প্রাণ নিয়ে ফিরে যেতে পারবে না।  কিন্তু আমাদের এ ধারনা ব্যর্থ প্রমাণ করে ইরানিরা ওই যুদ্ধে বিজয় হয়। আমাদের সামনে তারা এমন শক্তিমত্তার সঙ্গে লড়াই করে যে, তারা আমাদেরকে পরাজয়ের স্বাদ আস্বাদন করায়।”

তো শ্রোতাবন্ধুরা! দেখতে দেখতে আজকের আসরে সময়ও ফুরিয়ে এসেছে।  আগামী আসরে আমরা পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধ সম্পর্কে আরো কথা বলার চেষ্টা করব।   সে আসরেও আপনাদের সঙ্গ পাওয়ার আশা রাখছি। #

পার্সটুডে/এমএমআই/বাবুল আখতার/১৮

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

 

ট্যাগ