নভেম্বর ২২, ২০২৩ ২০:৪২ Asia/Dhaka

গত আসরে আমরা পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধে ইরানি যোদ্ধাদের প্রতি ঐশী সাহায্য নিয়ে আলোচনা করেছি। আমরা দেখানোর চেষ্টা করেছি যে, অদৃশ্য মদদ নিয়ে ইরানি যোদ্ধারা কীভাবে ইরাকি বাহিনীর বিরুদ্ধে বিজয়ী হয়েছিলেন। আজকের আসরে আমরা আট বছরের যুদ্ধে আশুরা বিপ্লব কী ভূমিকা পালন করেছিল তা নিয়ে আলোচনা করব। আশা করছি শেষ পর্যন্ত আপনাদের সঙ্গ পাবো।

ইরানি যোদ্ধারা পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন, এই যুদ্ধে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতা লাভকারী ইরাকি শাসক সাদ্দাম অন্যায়ভাবে ইরানের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছেন। এজন্য আট বছরব্যাপী ওই যুদ্ধকে ইরানে ‘চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধও’ বলা হয়। ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামি বিপ্লব হওয়ার পর সদ্য প্রতিষ্ঠিত ইসলামি শাসনব্যবস্থা সকল প্রতিবেশী দেশ বিশেষ করে মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক শক্তিশালী করার কর্মসূচি হাতে নেয়। কিন্তু প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের তৎকালীন দুই পরাশক্তি তা মেনে নিতে পারেনি। তারা ইরানের ইসলামি শাসনব্যবস্থাকে উৎখাত করার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করে। ইরানের ওপর আগ্রাসন চালাতে ইরাক সরকারকে উস্কানি দেওয়া ছিল তাদের সুদূরপ্রসারি চক্রান্তের অংশ। পক্ষান্তরে ইরানি যোদ্ধারা জানতেন যে, তারা এই যুদ্ধে আগ্রাসনের শিকার হয়েছেন বলে মহান আল্লাহর সমর্থন তাদের পক্ষে রয়েছে। এ কারণে তারা এ যুদ্ধকে ‘পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধ’ বলে অভিহিত করেন।

ইরানি যোদ্ধারা ছিলেন ধর্মীয় ও নৈতিক চরিত্রের আধার। দিনের বেলা যুদ্ধের সময়টুকু বাদে বাকি প্রায় পুরোটা সময় ইরান শিবিরের যোদ্ধাদেরকে নামাজ, কুরআন তেলাওয়াত ও দোয়া-দরুদসহ আল্লাহর ইবাদতে মশগুল থাকতে দেখা যেত।  ইরানি যোদ্ধারা অন্যান্য ইবাদতের পাশাপাশি কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনার স্মরণে শোকানুষ্ঠান করতেন। সাধারণভাবে, যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটার পরবর্তী সময়ে কিছুদিন মানুষ ওই ঘটনাকে স্মরণ করে এবং এরপর আস্তে আস্তে ভুলে যায়। কিন্তু কারাবালায় ইমাম হোসেইন (আ.)-এর শাহাদাতের ঘটনা যতই দিন যায় ততই বিখ্যাত হয়ে ওঠে; ততই মানুষ সে ঘটনা নিয়ে আলোচনা ও শোকানুষ্ঠানের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। ইরানি যোদ্ধারা ইরাকিদের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কারবালার ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে নব উদ্যোমে যুদ্ধক্ষেত্রে ঝাঁপিয়ে পড়েন। 

যে সমাজ কারবালার সংস্কৃতির সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করে নিয়েছে  সে সমাজের সক্ষমতা ও সাহস কেউ কেড়ে নিতে পারে না। ইরানি জনগণ কারবালার প্রান্তরে ঘটে যাওয়া আশুরা বিপ্লবকে বুকে ধারন করেন বলে এই দেশকে যুগে যুগে কখনও কোনো পরাশক্তি পদানত করে রাখতে পারেনি। ইসলামি বিপ্লবের মহান নেতা ইমাম খোমেনি (রহ.) এ সম্পর্কে বলেন: যদি শহীদদের সর্দার ইমাম হোসেইন (আ.) না থাকতেন তাহলে ইরানে ইসলামি বিপ্লব হতে পারত না। ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী বলেন: “দেখুন, আশুরার দিনের অর্ধদিবসের ঘটনা আমাদের ইতিহাসকে বরকতময় করেছে। আজ পর্যন্ত ওই হৃদয়বিদারক ঘটনা আমাদের সমাজে জীবন্ত হয়ে রয়েছে। আমাদের বিপ্লব ও যুদ্ধসহ অতীত ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এ বিষয়টি সহজেই উপলব্ধি করা যায়।”

হয়তো একথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, ইসলামের ইতিহাসে ইরান বিপ্লব ও পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধের মতো এমন আর কোনো ঘটনা ঘটেনি যাকে আশুরা বিপ্লবের সঙ্গে তুলনা করা যায়। আশুরা বিপ্লব যেমন সংঘটিত হয়েছিল ইসলামের শত্রুর হাত থেকে ইসলামি মূল্যবোধ ও দ্বীন ইসলামকে রক্ষা করার স্বার্থে, তেমনি ইরান বিপ্লব ও পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধের উদ্দেশ্যও যেন ছিল সেই একই সূত্রে গাঁথা। ইমাম খোমেনীর মধ্যে যেমন ইমাম হোসেইন (আ.)-এর মতো নেতৃত্বের গুণ ও সাহস ছিল তেমনি ইরানি যোদ্ধারা ছিলেন যেন কারবালার ময়দানের এক একটি বীর সৈনিক। এ কারণে মহররম মাস শুরু হলেই যুদ্ধের ময়দানে ইরান শিবিরে কারবালার ময়দানের দৃশ্যপটের পুনরাবৃত্তি হতো।

ইরাকের বিরুদ্ধে আট বছরের পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধ ছিল নীতি নৈতিকতার আলোকে নিজেকে ঝালাই করে নেওয়ার জন্য যারা লড়াই করে তাদের যে কারো জন্য আদর্শ। ইরাক-ইরান যুদ্ধের ময়দানে প্রতিটি নৈতিক আচরণকে কারবালার বীর সৈনিকদের আচরণের সঙ্গে তুলনা করা হতো। এছাড়া, মহানবী (সা.) ও তাঁর সাহাবীরা ২৩ বছর ধরে বিশ্বের বুকে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করার জন্য যে আত্মত্যাগের চরম পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছিলেন তার সঙ্গেও পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধের তুলনা করা চলে। কারবালার ময়দানে যারা এজিদ বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত থেকে গিয়েছিলেন তাদের মতো পরিচ্ছন্ন ও বিশুদ্ধ ঈমান ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া যাবে না।

 এর কারণ হচ্ছে, আশুরার দিন কারবালায় যা ঘটতে যাচ্ছে তা সঠিকভাবে অনুমান করতে পেরে ইমাম হোসেইন (আ.) আগের রাতে তার সকল সঙ্গীসাথীকে তাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন।  কেউ যাতে চক্ষুলজ্জার ভয়ে থেকে না যায় সেজন্য তিনি শিবিরের বাতি নিভিয়ে দিয়েছিলেন। ওই অন্ধকারে ইমামের সঙ্গে আসা বহু মানুষ ইমামকে ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল। কাজেই নিশ্চিত শাহাদাত জেনেও যারা সেদিন ইমামের সঙ্গে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তাদের ঈমানের সঙ্গে আর কারো ঈমানের তুলনা চলে না।

ইসলাম এমন একটি ধর্ম যা প্রায় দেড় হাজার বছর আগে তার উন্নত মানবীয় গুণাবলী দিয়ে মানব জাতির চিন্তাচেতনাকে ওলটপালট করে দিয়েছিল। এই ঐশী ধর্ম মানবজাতিকে বস্তুগত জগতের বন্দিশালা থেকে মুক্তি দিয়ে আধ্যত্মিক জগতের স্বাদ আস্বাদন করিয়েছিল। এ কারণে, মুসলিম যোদ্ধারা কাফির-মুশরিকদের বিরুদ্ধে লড়াই করে শাহাদাতের অমীয় সুধা পান করাকে জীবনের সবচেয়ে বড় সাফল্য বলে মনে করতেন। ইসলাম নামক মুজিযা বা অলৌকিক ঘটনা বিশ্বনবীর ২৩ বছরের রিসালাতের সময় জুড়ে আসমান থেকে নেমে গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল। অন্যদিকে আশুরা ছিল এমন এক মুজিযা যা জমিন থেকে উৎসারিত হয়ে আসমানে মিলিয়ে গিয়েছিল। ইরানি যোদ্ধাদের দৈনন্দিন জীবন, যুদ্ধক্ষেত্র এবং ইরাকিদের বন্দি শিবিরে চরম অসহায়ত্বের মধ্যেও তাদের মানবিক আচরণ এই সত্যের প্রমাণ বহন করে।

আশুরা বিপ্লবের দিন কারবালা ময়দানে ইমাম শিবিরে অবস্থানকারী নারীরা তাদের এক সন্তান শহীদ হওয়ার পর আরেক সন্তানকে ময়দানে পাঠিয়ে দিয়েছেন। আবুল ফজল আব্বাস প্রথমে নিজের তিন ভাই আব্দুল্লাহ, জাফর ও ওসমানকে এক এক করে ময়দানে পাঠান। তাদের তিনজনই এজিদ বাহিনীর বিরুদ্ধে অকুতোভয় লড়াই করতে করতে শহীদ হওয়ার পর সবশেষে আবুল ফজল  আব্বাস ময়দানে যান এবং বহু  শত্রুসেনাকে খতম করার পর নিজের শাহাদাতের অমীয় সুধা পান করেন। 

তো শ্রোতাবন্ধুরা, ইরান-ইরাক যুদ্ধের ইতিহাস শীর্ষক ধারাবাহিকের আজকের সময়ও ফুরিয়ে এসেছে। আগামী আসরেও আপনাদের সঙ্গ পাওয়ার আশা রইল।#

 

ট্যাগ