নভেম্বর ২২, ২০২৩ ২১:২১ Asia/Dhaka

গত আসরে আমরা আট বছরের পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধে আশুরা বিপ্লব কী প্রভাব রেখেছিল তা নিয়ে আলোচনা করেছি। আজ আমরা ওই যুদ্ধের বিরল কিছু বৈশিষ্ট্য নিয়ে খানিকটা কথা বলার চেষ্টা করব। আশা করছি শেষ পর্যন্ত আপনাদের সঙ্গ পাবো।

যুদ্ধে সহিংস ঘটনা ঘটে এবং ব্যাপক রক্তপাত হয় বলে কেউ যুদ্ধ পছন্দ করে না।  যুদ্ধ কখনও পবিত্র হতে পারে না; কিন্তু ইরানের ওপর ইরাকের চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধ এমন কিছু পবিত্র, আধ্যাত্মিক ও নূরানি বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল ছিল যে, ওই যুদ্ধের নামের পেছনে পবিত্র ছাড়া অন্য কোনো বিশেষণ যুক্ত করার উপায় ছিল না।  যে বৈশিষ্ট্যের কারণে আট বছরের প্রতিরক্ষা যুদ্ধ পবিত্র নাম ধারন করেছে তা হলো- যুদ্ধক্ষেত্রে ইরানি যোদ্ধা ও কমান্ডারদের ধর্মীয় কর্তব্য পালনে একনিষ্ঠা এবং তাদের মধ্যে আন্তরিক ও অনানুষ্ঠানিক সম্পর্ক। তাদের মধ্যে কে কমান্ডার আর কে সহযোদ্ধা তার কোনো শ্রেণিবিন্যাস ছিল না বরং ইরানি যোদ্ধাদের মধ্যে ‘ভাই’ শব্দটি বহুল ব্যবহৃত পরিভাষায় পরিণত হয়েছিল। একজন কমান্ডার যখন তার অধীনস্ত যোদ্ধাকে ভাই বলে সম্মোধন করতেন তখন তার ভেতর থেকে আত্মম্ভরিতা ও অহংকার দূর হয়ে যেত।

শহীদ জেনারেল কাসেম সোলায়মানি এ সম্পর্কে বলেন: “৩১ আশুরা ব্রিগেডের কমান্ডার শহীদ বাকেরি একবার একটি কাজের জন্য একজন অধীনস্ত যোদ্ধার কাছে যান। গিয়ে দেখেন ওই যোদ্ধা নিজের কাপড় ধোয়ার কাজ করছেন। শহীদ বাকেরি বলেন, ভাই আপনি এই কাজটি করে আসুন আমি আপনার কাপড় ধুয়ে দিচ্ছি। একথা শুনে ওই যোদ্ধা নিজের কাপড়গুলো শহীদ বাকেরির হাতে দিয়ে কাজটি করতে চলে যান। তিনি নিজের ব্রিগেড কমান্ডারকে চিনতে পারেননি। পরবর্তীতে যখন জানতে পারেন তার কমান্ডার তার কাপড় ধুয়ে দিয়েছে তখন তিনি লজ্জিত হন।”

মহান আল্লাহর প্রতি ঈমান ও নির্ভরতা এবং ঐশী মদদের প্রতি আশাবাদের অর্থ এই নয় যে, ইরানি কমান্ডার ও যোদ্ধারা একটি সর্বাত্মক যুদ্ধের হিসাব-নিকাশগুলো উপেক্ষা করতেন।  আট বছরের পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধে ইরান ছোট-বড় মোট ৫৬টি অভিযান চালিয়েছে এবং এসব অভিযানের প্রতিটির লক্ষ্য ছিল জানমালের ক্ষয়ক্ষতি যতটা সম্ভব কমিয়ে রেখে সর্বোচ্চ সাফল্য লাভ করা।  অর্থাৎ সামরিক দিক দিয়ে সব ধরনের সম্ভাবনা ও আশঙ্কাকে সামনে রেখে এসব অভিযানের পরিকল্পনা তৈরি করা হতো।  এমনকি সব ধরনের হিসাব-নিকাশ সূক্ষ্মভাবে করার পরই যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য ইমাম খোমেনী (রহ.) জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ৫৯৮ নম্বর প্রস্তাব গ্রহণ করেছিলেন।  ইমামের এই সিদ্ধান্ত ঘোষণা করার ফলে ইরাকের তৎকালীন শাসক সাদ্দাম আরেকবার ভুল করে বসে।

সাদ্দাম ইরানের বিরুদ্ধে আট বছরের যুদ্ধে তার প্রতি সব ধরনের পৃষ্ঠপোষকতা দানকারী দেশ কুয়েত দখল করে নেয়। এই সিদ্ধান্তের দীর্ঘমেয়াদি ফলস্বরূপ আমেরিকা ও তার ইউরোপীয় মিত্ররা পরবর্তীতে সাদ্দাম সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে। ইরানের বিরুদ্ধে ইরাকের আট বছরের যুদ্ধে শুধু যে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের দুই পরাশক্তি বাগদাদ সরকারকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে তাই নয় সেইসঙ্গে পারস্য উপসাগর তীরবর্তী চারটি দেশও ইরাকের সাদ্দাম সরকারকে সহযোগিতা করেছে। ইরাককে সমরাস্ত্র ও রসদ সরবরাহ করার দিক দিয়ে আমেরিকা, তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন, জার্মানি ও ফ্রান্সের মধ্যে একরকম প্রতেযোগিতা শুরু হয়ে যায়। এসব দেশের সরবরাহ করা সমরাস্ত্র ব্যবহার করে ইরাক ১৯৮৮ সালে নিজের সেনাবাহিনীকে ৫০ ডিভিশনে উন্নীত করে। অথচ ১৯৮৬ সালে ইরাকের সেনাবাহিনীর ডিভিশন সংখ্যা ছিল মাত্র ২৭টি।

এ সময় জার্মানি ইরাকের হাতে রাসায়নিক পদার্থ তুলে দেয় যা ব্যবহার করে বাগদাদ ইরানের বিরুদ্ধে ৬ হাজার টন রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগ করে। এসব হামলায় ইরানের পাশাপাশি ইরাকের কুর্দিস্তান অঞ্চলের শত শত মানুষ হতাহত হয়। মানবতাবিরোধী এই ভয়াবহ অপরাধে ইরাকের সঙ্গে জড়িত থাকার দায়িত্ব কখনোই মানবাধিকার রক্ষার দাবিদার পাশ্চাত্য গ্রহণ করেনি। পশ্চিমা দেশগুলো যখন ইরাকের হাতে এতসব সর্বাধুনিক প্রচলিত ও অপ্রচলিত সমরাস্ত্র তুলে দিয়েছে তখন তারা ইরানকে সামান্য কাঁটাতারে বেড়া পর্যন্ত দিতে রাজি হয়নি। কিন্তু তারপরও ইরানি জনগণ আল্লাহ তায়ালার ওপর ভরসা করে নিজেদের সীমিত সামর্থ্য নিয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে বীরোচিত লড়াই করেছেন এবং তারা শেষ পর্যন্ত ইরানের এক বিঘত সীমান্ত পর্যন্ত ইরাককে দখলে রাখতে দেননি।

ইরাক-ইরান যুদ্ধে কোন দেশ আগ্রাসী ভূমিকায় ছিল তা নির্ধারণ করতে হলে দু’দেশের তৎকালীন নেতৃত্বের প্রতি দৃষ্টিপাত করতে হবে। ওই যুদ্ধের এক পক্ষে ছিলেন ইসলামি বিপ্লবের মহান নেতা ইমাম খোমেনী (রহ.), যিনি ইরানের মাটি থেকে স্বৈরাচারী রাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা উৎখাত করেছিলেন।  আর অন্য পক্ষে ছিল সাদ্দামের মতো ভয়ঙ্কর অপরাধী যে তার অশুভ লক্ষ্য চারিতার্থ করার জন্য যেকোনো ধরনের অপরাধ করতে দ্বিধা করত না।

ইরাক-ইরান যুদ্ধের আরেকটি অনন্য বৈশিষ্ট্য ছিল এই যুদ্ধে ইরানের ব্রিগেড ও ডিভিশনগুলোর স্টারহীন জেনারেলদের ভূমিকা। এসব জেনারেল নিজেদেরকে এতটা ছোট মনে করতেন যে, অধীনস্ত সৈনিকেরা তাদেরকে ভাই নামে ডাকলে সবচেয়ে বেশি খুশি হতেন। কমান্ডার ও সৈনিকদের সম্পর্কে দূরত্ব ছিল না বললেই চলে। সেনাবাহিনীর স্বাভাবিক নিয়মে কমান্ডার তৈরি করার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রয়েছে এবং ওই ব্যবস্থায় একেকটি র‍্যাংক পাওয়ার জন্য একেকজন তরুণ অফিসারকে ৩ থেকে ৪ বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। এসব অফিসারের বয়স ৫০ বছর বা তার কাছাকাছি হলেই তারা থ্রি স্টার বা ফোর স্টার জেনারেল হতে পারেন। কিন্তু ইরাক-ইরান যুদ্ধে ইরানের পক্ষে এরকম কোনো প্রশিক্ষিত ও স্বাভাবিক নিয়মে উঠে আসা জেনারেল ছিলেন না।

এখানে ইরানের পক্ষে কমান্ডারের ভূমিকা পালন করেন ১৯ থেকে ২৮ বছর বয়সি তরুণেরা যাদের যুদ্ধ শুরুর আগে কোনো সামরিক অভিজ্ঞতাই ছিল না। তাদের কেউ ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, কেউ সাংবাদিক, কেউ শিক্ষক আবার কেউবা সরকারি চাকুরিজীবী। তারা তাদের সৃজনশীল প্রতিভা দিয়ে ও ইমাম খোমেনীর দিকনির্দেশনা অনুযায়ী যুদ্ধ করতে করতে দক্ষ জেনারেল ও রণকৌশলবিদে পরিণত হন। ওয়ালফাজর ও ফাও দখলের মতো বড় বড় অভিযান ইরানের এই তরুণ সেনা কর্মকর্তাদের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়।

তো শ্রোতাবন্ধুরা, আজকের এই আলোচনার মাধ্যমে আমরা শেষ করতে যাচ্ছি ইরাক-ইরান যুদ্ধের ইতিহাস শীধারাবাহিক আলোচনা। এই ধারাবাহিকে আমরা ‘বীরত্বের আট বছর’ নামক বই থেকে বাছাই করা কিছু অংশ তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। যতটুকু তুলে ধরেছি তা নিঃসন্দেহে ছিল আট বছরের পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধে ঘটে যাওয়া বিশাল ঘটনাবলীর ক্ষুদ্র একটি অংশ মাত্র। আশা করছি অনুষ্ঠানটি আপনাদের ভালো লেগেছে এবং তিন দশক আগের ওই যুদ্ধের ইতিহাস থেকে কিছুটা হলেও উপকৃত হয়েছেন। আপনাদের সঙ্গে আবারও কথা হবে পরবর্তী কোনো নতুন আসরে। ততক্ষণ সবাই ভালো ও সুস্থ থাকুন। #

 

পার্সটুডে/এমএমআই/ এমবিএ/ ২২

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ