নভেম্বর ২২, ২০২৩ ১৭:০৯ Asia/Dhaka

গত আসরে আমরা পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধে ইরানি যোদ্ধাদের প্রতি ঐশী সাহায্য নিয়ে আলোচনা করেছি। আজও আমরা একই বিষয়ে কথা বলব এবং একথা তুলে ধরার চেষ্টা করব যে, অদৃশ্য মদদ নিয়ে ইরানি যোদ্ধারা কীভাবে ইরাকি বাহিনীর বিরুদ্ধে বিজয়ী হয়েছিলেন। আশা করছি শেষ পর্যন্ত আপনাদের সঙ্গ পাবো।

পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ইরানি যোদ্ধারা একজন অপরাধী স্বৈরশাসকের আগ্রাসন প্রতিহত করেন। তারা পবিত্র কুরআন ও রাসূলে আকরাম (সা.)-এর শিক্ষা অনুযায়ী, আগ্রাসী ইরাকি বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ঐশী সাহায্য পাওয়ার আশা রাখতেন। বাস্তবে তারা পেয়েছিলেনও তাই। প্রকৃতপক্ষে ওই যুদ্ধ শুরুর এক বছর আগে ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল ঐশী মদদেই। বিংশ শতাব্দিতে সারা বিশ্ব যখন ধর্মবিরোধিতায় ছেয়ে গিয়েছিল তখন কোনো রাজনীতিবিদ কিংবা রাজনৈতিক বিশ্লেষক একথা ঘুনাক্ষরেও কল্পনা করেননি যে, ধর্মের ভিত্তিতে কোনো দেশে একটি গণজাগরণ ও বিপ্লব হতে পারে।  

ইরানের ইসলামি বিপ্লব ছিল সত্যিকার অর্থে একটি ধর্মভিত্তিক বিপ্লব যাকে ঈমানদার মানুষেরা মহান আল্লাহর অলৌকিক নিদর্শন ও ঐশী পুরস্কার হিসেবে ভূষিত করেন এবং বিশ্বের বেশিরভাগ রাজনৈতিক বিশ্লেষক ওই বিপ্লব দেখে হতবুদ্ধি হয়ে যান। ইসলামি বিপ্লবের মহান নেতা ইমাম খোমেনী (রহ.) মনে করতেন, অদৃশ্য খোদায়ী সাহায্যকে বিবেচনায় না নিয়ে ইরানের ইসলামি বিপ্লব বিশ্লেষণ করতে গেলে তা হবে অসম্পূর্ণ বিশ্লেষণ। তাঁর মতে, ইরানের তৎকালীন স্বৈরাচারী শাহ সরকার ও তার পশ্চিমা দোসররা শুধুমাত্র বস্তুবাদী চিন্তাধারা দিয়ে ইরানের গণজাগরণকে বিবেচনায় নিয়েছিল বলে তারা শাহ সরকারের পতনের কথা চিন্তাও করেনি। বাহ্যিক ঘটনাপ্রবাহের বাইরেও অদৃশ্য শক্তি বলে যে কিছু আছে সেকথা কল্পনাই করতে পারেনি শাহ ও তার পৃষ্ঠপোষকেরা।

ইসলামি বিপ্লব যেমন ছিল মহান আল্লাহর অলৌকিক নিদর্শন তেমনি গোটা বিশ্বের বড় বড় শক্তির শত্রুতা মাথায় নিয়ে এই বিপ্লব থেকে সৃষ্ট শাসনব্যবস্থার টিকে থাকাও আরেক অলৌকিক ঘটনা। ইরানের ইসলামি শাসনব্যবস্থার পতন ঘটানোর জন্য ইরাকের সাদ্দামকে দিয়ে ইরানের ওপর আগ্রাসন চালানো হয় এবং ওই আগ্রাসনের ফলে ইসলামি বিপ্লবের ওপর সবচেয়ে বড় আঘাত হানা হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের পরাশক্তিগুলোর বিরুদ্ধে দীর্ঘ আট বছর যুদ্ধ করে টিকে থাকার ঘটনায় প্রমাণিত হয় যে, ইরানি যোদ্ধাদের প্রতি ঐশী বা খোদায়ী মদদ ছিল। ইসলামি বিপ্লবের শত্রুদের ধারনা ছিল, তাদের সামরিক শক্তি ইরানের তুলনায় অনেক বেশি হওয়ায় মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে তারা ইসলামি বিপ্লব নামক চারাগাছটিকে উপড়ে ফেলতে পারবে।

কিন্তু বাহ্যিক দৃষ্টিতে ইরাক সমরাস্ত্র ও আর্থিক সামর্থ্যসহ সব দিক দিয়ে এগিয়ে থাকা সত্ত্বেও আট বছরের যুদ্ধে জয়ী হতে পারেনি। এখান থেকে বোঝা যায়, ইসলামি বিপ্লবকে যেমন ঐশী মদদ বিবেচনায় নেওয়া ছাড়া বিশ্লেষণ করা সম্ভব নয় তেমনি ইরাকের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইরানের বিজয়েও খোদায়ী মদদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। কর্তব্যে একনিষ্ঠ ইরানি যোদ্ধারা আট বছরের পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধে ঐশী সাহায্যের সুমিষ্ট সুধা পান করতে সক্ষম হন। ইরানের সাবেক সেনাপ্রধান শহীদ লে. জেনারেল সাইয়্যাদ শিরাজি বায়তুল মুকাদ্দাস অভিযানের মাধ্যমে খোররামশাহর মুক্ত করার পর ঐশী সাহায্য সম্পর্কে বলেন: চাপিয়ে দেয়া আট বছরের যুদ্ধে এখন পর্যন্ত যতগুলো অভিযান পরিচালিত হয়েছে তার সবগুলোতে আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে সহযোগিতা করেছেন। আর খোদায়ী সাহায্যের এ বিষয়টি যুদ্ধ যত সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল তত বেশি আমাদের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠছিল।

১৯৮৫ সালে বদর অভিযানের পর ইরানি যোদ্ধাদের প্রশংসা করতে গিয়ে ইমাম খোমেনী বলেন, “আমাদের যোদ্ধারা দারুণ মনোবল অর্জন করেছে। তারা হঠাৎ করে শক্তিমত্তা প্রদর্শন করেছে যদিও এমন শক্তিমত্তা প্রদর্শনের জন্য বছরে পর বছর পরিশ্রম করতে হয়। কিন্তু এরা এত দ্রুততার সঙ্গে কীভাবে এমন শক্তি অর্জন করল? একমাত্র আল্লাহ তায়ালার বিশেষ অনুগ্রহ ছাড়া এটি সম্ভব নয়। আমাদের যোদ্ধারা আত্মত্যাগের জন্য প্রস্তুতি নেয়ার সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহ তায়ালার মদদ লাভ করে।”

আরেকবার ইরানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পরিচালনা কমিটির সদস্যদের এক সমাবেশে ভাষণ দিতে ইমাম বলেন: “এটি আল্লাহ তায়ালার বিশেষ অনুগ্রহ যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা যুদ্ধে যাচ্ছেন এবং শহীদ ও আহত হচ্ছেন।”

ইমামের মতে, আল্লাহ তায়ালা ইরানি যোদ্ধাদের এমন মানসিক শক্তি দান করেন যার ফলে শত্রু সেনারা তাদেরকে দেখে ভয়ে পালিয়ে যায়। যখন শক্তিশালী বাহিনীকে সশস্ত্র অবস্থায় দেখতে পেয়ে দুর্বল পক্ষ যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়ন করে তখন সেটিকে স্বাভাবিক বিষয় বলে মনে হয়। কিন্তু যখন সামান্য অস্ত্রসস্ত্র নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে আসা তুলনামূলক দুর্বল পক্ষকে দেখে অত্যাধুনিক অস্ত্রে বলীয়ান বাহিনী কাঁপতে কাঁপতে পালাতে থাকে তখন তাকে ঐশী মদদ ছাড়া আর কিছু বলা যায় না।  ১৯৮৩ সালের বসন্তে আগ্রাসী ইরাকি বাহিনীর হাত থেকে ইরানের খোররামশাহর মুক্ত করার ঘটনাকে ইমাম খোমেনী (রহ.) অস্বাভাবিক ঘটনা ও ঐশী মদদের সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ বলে মন্তব্য করেন।  তিনি বলেন, “খোররামশাহরের বিজয় কোনো স্বাভাবিক ঘটনা নয়। ১৫ থেকে ২০ হাজার শত্রুসেনার আত্মসমর্পণকে স্বাভাবিক বিষয় বলা যায় না।”

আটক ইরাকি সেনাদের জবানবন্দি থেকেও বিষয়টির আঁচ পাওয়া যায়। খোররামশাহর মুক্ত করার অভিযান সম্পর্কে একজন ইরাকি যুদ্ধবন্দি বলেন, “আমরা যখন পশ্চাদপসরণের প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম তখন কেউ একজন চিৎকার করে ওঠে: “ইরানিরা এসে গেছে।” এই বাক্যটি শোনার সঙ্গে সঙ্গে পিছু হটার জন্য আমাদের শরীরে যতটুকু শক্তি অবশিষ্ট ছিল তাও উবে যায়। আমরা নড়াচড়ার শক্তি হারিয়ে ফেলি। আমাদের ব্যাটেলিয়ানের কমান্ডার মেজর হোসেইনি বলেন: তোমরা এখানে থাকো। আমি অতিরিক্ত সেনা আনতে যাচ্ছি। একথা বলে তিনি তার জিপটি নিয়ে বেরিয়ে যান এবং আর ফিরে আসেননি। এরপর মাত্র দু’জন ইরানি স্বেচ্ছাসেবীর কাছে আমরা ৫৫০ জন আত্মসমর্পণ করি। ওই দুজনের একজন ছিল ১২ বছরের এক ইরানি শিশু এবং ৬৫ বছরের এক বৃদ্ধ। আমরা চোখের পলকে ওই দুজনকে হত্যা করার ক্ষমতা রাখতাম। কিন্তু তা আমরা করতে পারিনি। ভয় ও আতঙ্ক আমাদেরকে এমনভাবে ঘিরে ধরেছিল যে, আমরা ওই দুজনের কাছে আত্মসমর্পণ করা ছাড়া আর কিছুই করতে পারিনি।

তো শ্রোতাবন্ধুরা, ইরান-ইরাক যুদ্ধের ইতিহাস শীর্ষক ধারাবাহিকের আজকের সময়ও ফুরিয়ে এসেছে। আগামী আসরেও আপনাদের সঙ্গ পাওয়ার আশা রইল।#

পার্সটুডে/এমএমআই/ এমবিএ/  ২২

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ