নভেম্বর ২২, ২০২৩ ২১:১২ Asia/Dhaka

গত আসরে আমরা আট বছরের পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধে আশুরা বিপ্লব কী প্রভাব রেখেছিল তা নিয়ে আলোচনা করেছি। আজ আমরা একই বিষয়ে আরো খানিকটা কথা বলার চেষ্টা করব। আশা করছি শেষ পর্যন্ত আপনাদের সঙ্গ পাবো।

কারবালার ময়দানে ইমাম হোসেইন (আ.) ও তাঁর প্রিয় সঙ্গীদের শাহাদাতের বীরত্বগাঁথা স্মরণ করার মাধ্যমে ইরানি যোদ্ধারা পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধে মানসিক শক্তি সঞ্চয় করতেন।  ইমাম হোসেইন (আ.) তাঁর ভাই ও দ্বিতীয় ইমাম হাসান (আ.) -এর শাহাদাতের পরপরই ইমামতের মূল্যবান দায়িত্বভার কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। ইমামতের দায়িত্ব গ্রহণ থেকে শুরু করে কারবালার ময়দানে শাহাদাতের সুধা পান করার আগ পর্যন্ত ইমাম হোসেইন (আ.) আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জনকে নিজের জীবনের একমাত্র ব্রতে পরিণত করেছিলেন। এক মুহূর্তের জন্যও তিনি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের আকাঙ্ক্ষা থেকে বিচ্যুত হননি। মহানবী (সা.)-এর প্রিয় দৌহিত্র যখন তাঁর বিপ্লব শুরু করার উদ্দেশ্যে মদীনা থেকে মক্কা অভিমুখে রওনা হন তখন তিনি নিজের ভাই মোহাম্মাদ হানাফিয়াকে উদ্দেশ করে এক চিঠিতে লেখেন:

“বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম। এটি হোসেইন বিন আলী বিন আবি তালিবের পক্ষ থেকে তার ভাই মোহাম্মাদকে উদ্দেশ করে লিখিত অসিয়ত। হোসেইন সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, এক আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো উপাস্য নেই, তাঁর কোনো শরিক নেই এবং মুহাম্মাদ (সা.) সত্যিকার অর্থে তাঁর বান্দা ও রাসূল। তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে সত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছেন।  জান্নাত ও জাহান্নাম সত্যি এবং তাতে বিন্দুমাত্র সংশয়ের অবকাশে নেই। অবশ্যম্ভাবীরূপে কিয়ামত সংঘটিত হবে এবং সেদিন মহান আল্লাহ মৃত ব্যক্তিদেরকে কবর থেকে জীবিত করে পুনরুত্থিত করবেন।” এই অসিয়তনামায় ইমাম হোসেইন (আ.)-এর আশুরা বিপ্লবের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য পরিষ্কারভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। ইমাম লিখেছেন:

“আমি নিছক বিদ্রোহ করার জন্য বিদ্রোহ করছি না কিংবা জমিনের বুকে ফাসাদ বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করাও আমার উদ্দেশ্য নয়। আমার নানার উম্মতকে সংশোধন করার উদ্দেশ্যেই আমার এ বিপ্লব। আমি মানুষকে সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ করার লক্ষ্য নিয়ে ময়দানে অবতীর্ণ হয়েছি। এ কাজে আমি আমার নানাজি রাসূলে আকরাম (সা.) ও আমার পিতা আলী (আ.)-এর আদর্শ অনুসরণ করব। যদি সকলে সত্য গ্রহণ করে তাহলে তারা মহান আল্লাহর ক্ষমা লাভের উপযুক্ত হবে কিন্তু যদি তারা সত্য গ্রহণ না করে তাহলে আমি ধৈর্যের চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করব এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে যেকোনো মীমাংসা মেনে নেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকব। হে আমার ভাই! এটি হচ্ছে আমার পক্ষ থেকে তোমার প্রতি অসিয়ত। আমি আল্লাহর কাছে তৌফিক কামনা করছি, তাঁর ওপর নির্ভর করছি এবং তার প্রতিই আমার প্রত্যাবর্তন।”

ইরানি যোদ্ধারা যেদিন আগ্রাসী ইরাকি বাহিনীর হাত থেকে খোররামশাহর মুক্ত করেন সেদিন ইসলামি বিপ্লবের মহান নেতা ইমাম খোমেনী (রহ.) বলেছিলেন, খোররামশাহরকে আল্লাহ মুক্ত করে দিয়েছেন।  তিনি ইরানি যোদ্ধাদেরকে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করাকে জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারণ করার আহ্বান জানিয়ে বলেন: একমাত্র তারাই শহীদদের সর্দার ইমাম হোসেইন (আ.)-এর প্রকৃত অনুসারী হতে পারবে যারা ইসলাম ও পবিত্র কুরআনের আদর্শ অনুযায়ী নিজেদের জীবন পরিচালিত করতে পারবে।  

ইরাকের বিরুদ্ধে আট বছরের পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধে ইরানি যোদ্ধারা তাদের প্রতিটি কাজ কারবালার কষ্টিপাথরে যাচাই করে নিতেন।  তারা সব সময় নিজেদের মধ্যে আলোচনায় আশুরা বিপ্লব নিয়ে কথা বলতেন এবং কে নিজেকে কতোটা বেশি ইমাম হোসেইনের অনুসারীতে পরিণত করতে পারবেন সে চেষ্টায় ব্যস্ত থাকতেন।  

ইরানের মাজান্দারান প্রদেশের সেনা কমান্ডার কর্নেল সাফারআলী বাকেরযাদে পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধে আশুরা বিপ্লবের প্রভাব বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন: ওয়ালফাজর-৮ অভিযানের সময় আমাকে একটি দীর্ঘ পথের ওপর বাঁধ নির্মাণের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এ সময় সদ্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একদল বুলডোজার চালক আমাদের সঙ্গে যুক্ত হন। এদের একজন ছিলেন শহীদ ঈসা আমুয়ি। সে আমাদের ওখানে পৌঁছার পর থেকেই সরাসরি অভিযানে অংশগ্রহণ করার জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। সে শুধু আমার চারপাশে ঘুরঘুর করত এবং প্রশ্ন করত, আমাকে কখন ফ্রন্টে পাঠাবেন? আমি তাকে বারবার একই কথা বলে যাচ্ছিলাম যে, তুমি এখানে নতুন এসেছো, আগে এলাকার সঙ্গে পরিচিত হও তারপর তোমাকে ফ্রন্টে পাঠানো হবে। কিন্তু আমুয়ি ছিল নাছোড়বান্দা।  একদিন সত্যি সত্যি তার ফ্রন্টে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হলো। সে এক লাফে বুলডোজারে চড়ে সবার আগে সেটি চালিয়ে দিল।

আমুয়ি বুলডোজার দিয়ে বাধ নির্মাণের কাজে মনোনিবেশ করে এবং এক সময় শত্রুদের গোলাবর্ষণের গতি বেড়ে যায়। প্রায় সব বুলডোজারের চালকেরা তাদের গাড়ি থেকে নেমে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যান যাতে গোলাগুলি বন্ধ হলে আবার কাজে নামতে পারেন। কিন্তু আমুয়ি তা না করে প্রচণ্ড গোলাগুলির মধ্যে নিজের মনে বাধ নির্মাণের কাজ করে যাচ্ছিল। ঠিক এ সময় একটি গুলি এসে তার ডান হাতে লাগে। তিনি বাম হাত দিয়ে তার কাজ চালিয়ে যান। অল্প সময় পর একটি গোলা এসে তার বুকে বিদ্ধ হয় এবং তিনি বুলডোজারের চালকের আসনে বসা অবস্থায় শাহাদাতে অমীয় সুধা পান করে খোদার সান্নিধ্যে চলে যান।

কারবালার ময়দানে অন্যান্যের মতো ইমাম হোসেইন (আ.) এর ভাই আবুলফজল আব্বাস শহীদ হয়েছিলেন। ইরাক-ইরান যুদ্ধে আবুলফজলের মতো করে শহীদ হওয়ার আরেকটি ঘটনা শোনা যাক: আলী রেজা সাদেকিয়ান নামের এক ইরানি যোদ্ধা বদর অভিযানে অংশ নিয়েছিলেন। অভিযানের শুরুর দিকে তার বাম হাতে গুলি লাগে এবং ফিল্ড হাসপাতালে তার হাতটি অপারেশন করে কেটে ফেলতে হয়। কিন্তু জখম কিছুটা ভালো হলে ডাক্তারদের পরামর্শ উপেক্ষা করে তিনি এই বলে আবার ফ্রন্টে চলে যান যে, আবুলফজল আব্বাস এক হাত দিয়ে যুদ্ধ করে শত্রু সেনাদের নাস্তানাবুদ করেছিলেন। আমিও সেভাবে এক হাত দিয়েই ইরাকি বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করব। সাদেকিয়ান এক হাত নিয়ে শত্রুসেনাদের বিরুদ্ধে গ্রেনেড নিক্ষেপ করতে করতে ইরাকি বাহিনীর গোলার আঘাতে শহীদ হয়ে যান।

তো শ্রোতাবন্ধুরা, ইরান-ইরাক যুদ্ধের ইতিহাস শীর্ষক ধারাবাহিকের আজকের সময়ও ফুরিয়ে এসেছে। আগামী আসরেও আপনাদের সঙ্গ পাওয়ার আশা রইল।#

পার্সটুডে/এমএমআই/ এমবিএ/  ২২

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ