সেপ্টেম্বর ১৯, ২০২৩ ১৫:১৫ Asia/Dhaka

প্রিয় পাঠক ও শ্রোতাবন্ধুরা! সালাম ও শুভেচ্ছা নিন। আশা করি যে যেখানেই আছেন ভালো ও সুস্থ আছেন। আজ আমরা শুনবো প্রাচীন একটি  ইরানি প্রবাদের গল্প। প্রবাদেটি হলো: ভেতরে মেরেছে নিজেদেরকে আর বাইরে জনগণকে। এই প্রবাদের নেপথ্যে যে গল্পটি আছে সেটি এরকম:

এক লোকের বেশ বড়োসড়ো একটা ফল বাগান ছিল। ওই বাগানে প্রায় সব রকমের ফলই ছিল। বাগানের পরিচর্যা ভালোভাবে করার জন্য বাগানের মালিক একটা ঘর বানালো ফলবাগানে। সেখানেই সে বেশিরভাগ সময় থাকতো।

তার ছিল শতাধিক কর্মচারী। তারা মালিককে বাগানের কাজে সাহায্য করতো। দূর থেকে যে-ই বাগান কিংবা বাগানের শ্রমিকদের দেখতো সে-ই আনমনে বলতো: বাহ্ কী চমৎকার জায়গায় লোকটি বসবাস করছে। নিশ্চয়ই বহু টাকা-পয়সার মালিক। বাগান মালিকের বন্ধুরা এবং ফলের পাইকারি ক্রেতারা নওরোজের ছুটিতে কিংবা অন্যান্য ছুটিতে তার সঙ্গে  দেখা করতে আসতো। যখনই তারা ওই বাগানে আসতো তখনই তারা বাগানের সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হতো। একেকটা ফলের গাছে এতো পরিমাণ ফল ধরতো যে প্রতি ডালেই প্রায় এক বস্তা ফল হয়ে যেত। তারা দুই একটা রাত ওই বাগানে কাটাতো। বাগানের বিস্তারিত স্মৃতি নিয়ে তারা ফিরে যেত শহরে। বাগানের মালিকেরা বন্ধুরা তাকে সবসময় বলতো: তোমার সৌভাগ্য যে ঘুম থেকে উঠে চোখ মেলেই তুমি ফুল-ফল আর সবুজ প্রকৃতি দেখতে পাও! শহরের বায়ু দূষণ তোমাকে আক্রান্ত করে না কিংবা তোমাকে বিরক্তও হতে হয় না। বাগানের মালিক গাছ-গাছালির যত্ন নেয়া যে কতো কষ্ট সে কথা বলছিল: একদিন যদি দেরিতে বৃষ্টি হয় কিংবা বেশি বৃষ্টি হয় কিংবা শীত-গ্রীষ্ম ঋতুর আসা-যাওয়ায় যদি একটু দেরি বা দ্রুত হয় তাহলে ভীষণ সমস্যায় পড়ে যেতে হয়। তার এসব কথা বন্ধুরা বুঝতে পারতো না। সমুদ্রে হাবুডুবু না খেলে যেমন কেউ ঝড়-তুফানে পানিতে পড়ার কষ্ট বুঝতে পারে না তেমনি যারা শুধু ফুটন্ত ফুল আর বাগানের সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয় তারা মালির কাজের কষ্টের ব্যাপারটা বোঝে না। এ কারণে সে আশেপাশের কারো সঙ্গে খুব একটা মিশতো না।     

এক বছর শীতকাল এসেই দ্রুত চলে গিয়েছিল। সে কারণে বসন্তের আগেভাগেই বাগানের গাছগুলো ফুলে ফুলে সুশোভিত হয়ে উঠলো। কিন্তু বসন্তের প্রথম মাস অতিবাহিত হতে না হতেই আবার ঠাণ্ডা ফিরে এলো। বৃষ্টি বাদলের সঙ্গে নেমে এলো শিলাঝড়। গাছের ফুল-কলিগুলো সবেমাত্র শীতের ঘুম থেকে জেগে উঠেছিল সেগুলো ঠাণ্ডায় আবার ঘুমিয়ে পড়লো। স্বল্পকালীন এই শীতের পর গাছগুলো পত্র-পল্লবহীন, পুষ্পহীন হয়ে পড়লো। আর যে গাছে ফুল হয় না সে গাছে ফলও হয় না। সুতরাং সে বছর তার ফল কেনার জন্য বন্ধুদের পরিচিত ক্রেতারা বাগান মালিকের অপেক্ষায় আর থাকলো না।

বলছিলাম বন্ধুরা দেখলো ক্রেতারা তাদের বন্ধু ফল বাগানের মালিকের কাছ থেকে ফল না কিনে অন্যদের কাছ থেকে কিনছে। তারা তাই নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতে লাগলো-বাগানের মালিক বন্ধুটার কোনো বিপদ হয় নি তো! বন্ধুকে দেখতে তারা রওনা হলো বাগানের দিকে। বাগানে পৌঁছে তো তাদের চোখ ছানাবড়া। কী অবস্থা বাগানের! শিলাবৃষ্টিতে গাছে না আছে পাতা না আছে ফুল। তাদের মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছিলো না। বাগানের শ্রমিকেরা বিষন্ন মনে গাছের নীচে বসে ছিল। বাগানের মালিকও এক কোণে বসে বসে চিন্তা করছিল: শ্রমিকদের এ মাসের বেতন দেবে কীভাবে! বাগানের মালিকের বন্ধুরা বিষন্ন মনে তার সামনে গেল এবং জিজ্ঞেস করলো: কী হয়েছে? এতো মনমরা হয়ে বসে আছো কেন? তোমার বাগানের এই হাল হলো কী করে? 

বন্ধুদের এক গাদা প্রশ্নের জবাবে বাগানের মালিক পুরো ঘটনা তাদের খুলে বললো। তারপর বললো: বাগানের পেছনে প্রচুর শ্রম দিয়েছি। কোনোরকমে শরত আর শীতকালটা পেরিয়ে যেতে পারলেই হতো। কতো রাত জেগে জেগে কাটিয়েছি! সকাল পর্যন্ত বাগানের কাজ করেছি। অথচ মাত্র দুই তিন দিন আবহাওয়া একটু শীতার্ত হলো আর আমার সকল শ্রম এবং অর্থ সব বরবাদ হয়ে গেল। দেখো! আমাদের বাগানগুলো বাইরে থেকে যারা দেখে তারা হিংসায় কিংবা ঈর্ষায় জ্বলে-পুড়ে মরে। আর ভেতরে মারে আমাদের নিজেদেরকে। বাইরে থেকে দেখে সবাই চায় আমাদের বাগানের মতো তাদেরও যেন বাগান হয়। এমনকি অনেকে হিংসাও করে।

বাইরে থেকে যারাই বাগান দেখতে পায় তাদের অনেকেই মনে মনে বলে: ওর কেন এরকম বাগান থাকবে। ধ্বংস হয়ে যাক বাগান। অথচ ভেতরের অবস্থাটা কীরকম দেখো! কী কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে আছি আমরা। এরকম পরিস্থিতিতে আমাদেরকে প্রায়ই পড়তে হয়। এই ঘটনার পর থেকে যে বা যারা যখনই বাহ্যিকভাবে দর্শনীয় কিংবা ভালো লাগার মতো চমৎকার কোনো জিনিস কিংবা পরিস্থিতিতে অন্যকে হিংসা করে তখনই এই প্রবাদটি বলতে শুরু করে। তারা কখনোই আমাদের এই অবস্থায় পৌঁছতে যে কতো কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে, কী পরিমাণ শ্রম আর অর্থ ব্যয় করতে হয়েছে সেইসব চিন্তাই করে না। বরং চিন্তা-ভাবনা ছাড়াই তারা হিংসা করতে শুরু করে দেয়। তারা তো আর জানে না ওই বাগান: 'ভেতরে মেরেছে নিজেদেরকে আর বাইরে জনগণকে'।

পার্সটুডে/এনএম/১৯/৯৭
মূল ফার্সি গল্পের রূপান্তর: নাসির মাহমুদ
 

ট্যাগ