সেপ্টেম্বর ২৩, ২০২৩ ২০:৪৬ Asia/Dhaka

হাজি আহমাদ মুতাওয়াসসেলিয়ান কুর্দিস্তান অঞ্চলে বিদ্রোহ দমন করে ইরানের দক্ষিণাঞ্চলে আগ্রাসী ইরাকি বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযানে নামেন। ততদিনে ইরানের ওপর ইরাকের চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধের এক বছর পেরিয়ে গেছে। ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী বা আইআরজিসি’র তৎকালীন কমান্ডারের আহ্বানে সাড়া দিয়ে তিনি মোহাম্মাদ রাসূলুল্লাহ (সা.) নামের একটি ব্রিগেড গঠন করেন। ব্রিগেডটি পরবর্তী সময়ে ডিভিশনে রূপ নেয়।

দখলদার ইরাকি বাহিনীর কবল থেকে খোররামশাহর মুক্ত করার অভিযানে অংশ নেয় মুতাওয়াসসেলিয়ানের নেতৃত্বাধীন ব্রিগেড। পাঁচটি ধাপে টানা ২৫ দিন ধরে সাদ্দাম বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে শহরটি মুক্ত করা হয়। বায়তুল মুকাদ্দাস নামের ওই অভিযানে আহমাদ মুতাওয়াসসেলিয়ানের ভূমিকা সম্পর্কে একজন ইরানি কমান্ডার বলেন:

বায়তুল মুকাদ্দাস অভিযানের প্রথম দিন বিকেলে আহওয়াজ-খোররামশাহর মহাসড়কে যদি হাজি আহমাদের নেতৃত্বে সঠিক সময়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলা না হতো তাহলে ওই অভিযান বড় ধরনের বিপদের সম্মুখীন হতে পারত। তিনি সেখানে নিজের কালাশিঙ্কভ রাইফেলটি কাঁধে তুলে নেন এবং মৃত্যুর দুয়ার পর্যন্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। তার সহযোদ্ধারাও তার সঙ্গে সমান তালে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন যার ফলে আহওয়াজ-খোররামশাহর মহাসড়ক দখলে নেয়ার ইরাকি পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। মহাসড়করটির ওপর ইরানি যোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণ অক্ষুণ্ন থাকে। ওই যুদ্ধে আহমাদ মুতাওয়াসসেলিয়ানের উরুতে গুলি লাগে এবং তিনি আহত হন। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি রণক্ষেত্র ত্যাগ করেননি বরং বীর বিক্রমে আগ্রাসী বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যান।

হাজি আহমাদ মুতাওয়াসসেলিয়ান রণক্ষেত্রে সব সময় সামনে থেকে তার বাহিনীকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি যেকোনো অভিযান পরিচালনার আগে গোয়েন্দা টিমের সঙ্গে শত্রুসেনাদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতে চলে যেতেন। যেসব কমান্ডার অপারেশন্স হেডকোয়ার্টারে বসে সৈন্যদের নির্দেশ দেন তিনি তাদের মতো ছিলেন না। যুদ্ধের ময়দানে তিনি তার নেতৃত্বাধীন যোদ্ধাদের অগ্রভাগে থাকতেন।

বায়তুল মুকাদ্দাস অভিযানের দ্বিতীয় পর্যায়ে ইরানি যোদ্ধাদের আহওয়াজ-খোররামশাহর মহাসড়ক অতিক্রম করে সীমান্তের দিকে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু অভিযানের এই অংশটি ছিল অত্যন্ত কঠিন। মুখোমুখি সংঘর্ষের এক পর্যায়ে হাজ আহমাদের কাছেই শত্রু সেনাদের একটি গোলা এসে আঘাত হানে এবং গোলাটি বিস্ফোরিত হলে সেটির একটি স্প্লিন্টার তার  উরুতে বিদ্ধ হয়। আহমাদ মুতাওয়াসসেলিয়ান মারাত্মক আহত হন।

তাকে আহওয়াজ-খোররামশাহর মহাসড়কের পাশে স্থাপিত একটি জরুরি চিকিৎসা কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানকার ডাক্তার তাকে যুদ্ধক্ষেত্রে থেকে বের করে আহওয়াজ শহরের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু এই বীর সেনা কমান্ডার সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে সেখানেই তাৎক্ষণিকভাবে অপারেশন করে স্প্লিন্টারটি বের করে ফেলার নির্দেশ দেন। চিকিৎসকরা তার আহ্বানে সাড়া দেন। তাকে বেহুঁশ করার জন্য ফুল এনেস্থেশিয়া দিতে গেলে তিনি বিরোধিতা করে লোকাল এনেস্থেশিয়া দিয়ে অপারেশন করতে বলেন। তার মাথায় আসলে ছিল দ্রুত সুস্থ হয়ে আবার যুদ্ধক্ষেত্রে যাওয়ার চিন্তা। চিকিৎসকরা এবারও তার কথা রাখেন এবং এর ফলে প্রচণ্ড ব্যথা ও কষ্টসহ অপারেশনটি সম্পন্ন হয় এবং তার উরু থেকে স্প্লিন্টারটি বের করে ফেলা হয়।  খোররামশাহর মুক্ত হওয়ার পর ওই শহরে ইরানি যোদ্ধারা অনেক ছবি তোলেন। এরকম একটি গ্রুপ ছবিতে আহমাদ মুতাওয়াসসেলিয়ানকে পায়ে প্লাস্টার করা অবস্থায় হাতে ওয়াকিং স্টিকসহ দেখা যায়।

বায়তুল মুকাদ্দাস অভিযানে অংশগ্রহণকারী ইরানি কমান্ডার শহীদ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আহমাদ গোলামি বলেন: “খোররামশাহর মুক্ত করার অভিযানে আহমাদ মুতাওয়াসসেলিয়ান আহত ও পায়ে প্লাস্টার বাধা অবস্থায় ফ্রন্টে চলে আসতেন। তিনি জিপে করে আসতেন এবং চলে যেতেন। সবাই ফ্রন্টে উপস্থিত ছিলেন এবং কোনো না কোনোভাবে অভিযানকে সফলতার দিকে এগিয়ে নিতে অবদান রেখেছেন। অভিযানটিতে ইরানের মান-সম্মানের প্রশ্ন জড়িত ছিল। আহমাদ মুতাওয়াসসেলিয়ান সত্যিই ওই অভিযানে বড় ভূমিকা রেখেছিলেন। আইআরজিসির তৎকালীন প্রধান কমান্ডার মোহসেন রেজায়ী বারবারই একটি কথা বলেন আর তা হলো: যদি মুতাওয়াসসেলিয়ান না থাকত তাহলে হয়তো খোররামশাহর মুক্ত করতে কয়েক বছর সময় লাগত।”

বায়তুল মুকাদ্দাস অভিযানের প্রথম ও দ্বিতীয় পর্বের উদ্দেশ্য ছিল ইরানি যোদ্ধারা খোররামশাহরে প্রবেশ করে দখলদার সেনাদের হটিয়ে দেবেন। কিন্তু প্রায় ২০ দিন হয়ে গেলেও তেমন কোনো সাফল্য না আসায় যোদ্ধারা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। এরকম একটি অবস্থায় ইরানি সৈন্যদের উজ্জ্বীবিত করার জন্য এমন একজন মানুষের ভাষণের প্রয়োজন ছিল যিনি তার আগুন ঝরানো বক্তব্য দিয়ে যোদ্ধাদের মধ্যে অভিযানে সফল হওয়ার তীব্র প্রেরণা সৃষ্টি করবেন। হাজি আহমাদ মুতাওয়াসসেলিয়ান আহত অবস্থায় যোদ্ধাদের মাঝে হাজির হন এবং প্রাণস্পর্শী ভাষণ প্রদান করেন। তিনি বলেন: “ভাইয়েরা আমার! এখন পর্যন্ত আমাদের কমান্ড সেন্টার থেকে কয়েকবার নির্দেশ দেয়া হয়েছে আমরা যেন পশ্চাদপসরণ করি। কিন্তু আমরা তা করিনি। কারণ, আমি দেখেছি আপনাদের মনোবল চাঙ্গা রয়েছে এবং যেকোনো মুহূর্তে ইরাকি বাহিনীর হাতে ধরাশায়ী হওয়ার আশঙ্কা থাকা সত্ত্বেও আপনারা লড়াই করে যাচ্ছেন। আপনাদের এই দৃঢ়চেতা মানসিকতার কারণে শত্রু  এক কদম সামনে এগুনোরও সুযোগ পায়নি।”

এতটুকু বলার পর আহমাদ মুতাওয়াসসেলিয়ান অশ্রসজল চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে দুহাত তুলে ফরিয়াদ করেন: “হে আল্লাহ!আমাকে জীবিত অবস্থায় যেন এ দৃশ্য দেখতে না হয় যে, আমাদের সম্মান, আমাদের খোরররামশাহর শত্রুদের কব্জায় রয়েছে। যদি খোররামশাহর শত্রুর হাতেই থাকা তোমার সিদ্ধান্ত হয় তাহলে আমাকে তুমি তোমার কাছে নিয়ে যাও।”

যোদ্ধাদের সামনে এ ধরনের বক্তব্য দেওয়ার আগে মুতাওয়াসসেলিয়ান কমান্ডারদের এক বৈঠকে অংশ নিয়ে বলেন: “আমাদেরকে কিন্তু কোনো অবস্থায় অভিযান বন্ধ করা যাবে না। এমনকি একজন যোদ্ধার দেহে প্রাণ থাকা পর্যন্ত অভিযান বন্ধ হবে না। অভিযান সেদিনই বন্ধ হবে যেদিন খোররামশাহর মুক্ত হবে।” তার এই বক্তব্যে প্রমাণিত হয় খোররামশাহর মুক্ত করার মতো কঠিন অভিযানে আহমাদ মুতাওয়াসসেলিয়ানকে কেন বাছাই করেছিলেন আইআরজিসির কমান্ডার মোহসেন রেজায়ি।

কমান্ডার রেজায়ির মুখ থেকেই শুনুন তার কারণ। তিনি বলেন: “যখন বায়তুল মুকাদ্দাস অভিযানের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করি তখন বুঝতে পারি আমরা ইরাকিদের ওপর হামলা চালাতে চালাতে যতই খোররামশাহরের দিকে অগ্রসর হবো ততই ইরাকিরা আমাদের ওপর আক্রমণের মাত্রা বাড়িয়ে দেবে। তাই আমাদের এমন একজন কমান্ডারের প্রয়োজন ছিল যিনি তার যোদ্ধাদের নিয়ে সর্বোচ্চ প্রতিরোধ চালাবেন। কারণ, মাঝপথে অভিযান বন্ধ করে দিতে বাধ্য হলে গোটা অভিযানটি ব্যর্থ হবে এবং পরবর্তী ২০ বছরেও খোররামশাহর মুক্ত করা সম্ভব হবে না। অভিযানের সময় আমার ধারণা সঠিক প্রমাণিত হয় এবং শহর মুক্ত করার অভিযানে আহমাদ মুতাওয়াসসেলিয়ানের ব্রিগেড সবচেয়ে সাহসী ভূমিকা পালন করে।#

 

পার্সটুডে/এমএমআই/বাবুল আখতার/২৩

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ