নভেম্বর ০৭, ২০২৩ ১৬:৫২ Asia/Dhaka

গত দুই আসরে আমরা পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধে ইরানি যোদ্ধাদের সাহসিকতা নিয়ে আলোচনা করেছি। আজকের আসরে আমরা পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ইরানি কমান্ডার শহীদ মোহাম্মাদ ইব্রাহিম হেম্মাতের অবদান নিয়ে খানিকটা কথা বলার চেষ্টা করব। আশা করছি শেষ পর্যন্ত আপনাদের সঙ্গ পাবো।

পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধে ইরানের অন্যতম সাহসী কমান্ডার ছিলেন ২৭ মোহাম্মাদ রাসূলুল্লাহ ব্রিগেডের কমান্ডার শহীদ মোহাম্মাদ ইব্রাহিম হেম্মাত। জীবনে আল্লাহকে সন্তুষ্ট করা ছাড়া তার অন্য কোনো লক্ষ্য ছিল না এবং তার সকল চেষ্টা-প্রচেষ্টা এই লক্ষ্যে পরিচালিত হতো। তিনি জটিলতম সামরিক দায়িত্ব খুশিমনে, আগ্রহের সঙ্গে এবং স্থিরচিত্তে গ্রহণ করতেন। ইরান-ইরাক যুদ্ধে শহীদ হয়ে যাওয়ার সময় এই সাহসী কমান্ডারের বয়স ছিল মাত্র ২৮ বছর।  মোহাম্মাদ ইব্রাহিম হেম্মাতের পিতা তাঁর জন্ম থেকে নিয়ে শাহাদাত পর্যন্ত নিজের ছেলের ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে বলেন:

“১০ বছর বয়স থেকে শুরু করে শাহাদাতের আগ পর্যন্ত জীবনে যত কঠিন সময়ই আসুক না কেন মোহাম্মাদ ইব্রাহিমের নামাজ কখনও ছুটে যায়নি। একদিন হেম্মাত দীর্ঘ সফর শেষে প্রচুর ক্লান্তি নিয়ে বাসায় ফেরে। বিকেলে হাল্কা বিশ্রাম নেয়। রাতের বেলা সে জায়নামাজে বসে যায় এবং সারারাত ইবাদত-বন্দেগিতে কাটিয়ে দেয়। ভোররাতের দিকে তার মা তাকে বলেন যে, বাবা এখন একটু ঘুমিয়ে নে, আর কতো রাত জাগবি। তখন মোহাম্মাদ ইব্রাহিম বলে: মা আমি এক বিস্ময়কর জগতে ছিলাম।  যদি তুমি আমাকে না ডাকতে তাহলে আমি আরো কিছুক্ষণ সেই জগতটা উপভোগ করতে পারতাম!”

মোহাম্মাদ ইব্রাহিম হেম্মাত ১৯৫৫ সালে ইরানের ঐতিহাসিক ইস্পাহান শহরের নিকটবর্তী ‘শাহরে রেজা’ শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা তার শিশুকাল সম্পর্কে বলেন: “ক্লাসে সব সময় প্রথম হতো মোহাম্মাদ ইব্রাহিম এবং সর্বোচ্চ নম্বর নিয়ে সে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়। পড়াশুনায় সে যেমন মেধাবী ছিল তেমনি তার কথাবার্তা ও আচার-আচরণও ছিল মনোমুগ্ধকর।  সারাদিনের পেশাগত ক্লান্তি নিয়ে বাড়িতে ফিরে মোহাম্মাদ ইব্রাহিমকে দেখামাত্র আমার ক্লান্তি দূর হয়ে যেত এবং কোনোরাতে বাড়ি ফিরে যদি তাকে দেখতে না পেতাম তাহলে আমরা মনটা বিষন্নতায় ভরে যেত। ” পবিত্র কুরআন তেলাওয়াতের প্রতি শহীদ হেম্মাতের ছিল প্রচণ্ড আগ্রহ। এ সম্পর্কে তার পিতা বলেন: “মোহাম্মাদ ইব্রাহিম প্রায়ই তার মায়ের কাছে আবদার করতে তিনি যেন তাকে কুরআন পড়া শিখিয়ে দেন এবং কুরআনের সূরাগুলো হেফজ করতে তাকে সাহায্য করেন।  এই প্রচণ্ড আগ্রহের কারণে উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হওয়ার আগেই মোহাম্মাদ ইব্রাহিম সম্পূর্ণ কুরআনের হাফেজ হয়ে যায়।”

মোহাম্মাদ ইব্রাহিম ১৯৭৩ সালে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে উচ্চমাধ্যমিক পাস করার পর ইস্পাহানের টিচার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে ভর্তি হন। এ সময়টি ইরানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছিল তৎকালীন স্বৈরাচারী শাহ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে উত্তাল। ইসলামি বিপ্লবের মহান নেতা ইমাম খোমেনীর জন্য তিনি ছিলেন পাগলপ্রায়। ইমাম নির্বাসিত জীবনে বসেই ইরানের আপামর জনসাধারণের জন্য বিভিন্ন বার্তা পাঠাতেন এবং ইরানি জনগণ সে বার্তার দিকনির্দেশনা অক্ষরে অক্ষরে পালন করত। ইমামের বার্তাগুলো লিফলেট আকারে এবং ক্যাসেটে করে ইরানে প্রবেশ করত। এসব বার্তা অসংখ্য কপি করে তা জনসাধারণের মধ্যে বিলি করার কাজ করতেন মোহাম্মাদ ইব্রাহিম হেম্মাত। তিনি নিজেও তার জ্বালাময়ী ভাষণ দিয়ে জনতাকে শাহ সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ করে তুলতেন। এর ফলে শাহ সরকারের পেটোয়া বাহিনী সাভাকের নজরে পড়ে যান হেম্মাত। তাকে হত্যা করার নির্দেশও জারি হয়। কিন্তু সাভাক তাকে গ্রেফতার করতে পারেনি।

ইসলামি বিপ্লবের পর দেশগঠনে আত্মনিয়োগ করেন হেম্মাত। ইমাম খোমেনী (রহ.) ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী বা আইআরজিসি গঠনের নির্দেশ দিলে হেম্মাত তার দুই ভাই ও তিন বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে ‘শাহরে রেজা’য় এই বাহিনীর শাখা গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

১৯৮০ সালে ইরানের কুর্দিস্তান অঞ্চলে বিপ্লব-বিরোধী ও বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলো মাথাচারা দিয়ে উঠলে ওইসব গোষ্ঠীকে দমনের উদ্দেশ্যে মোহাম্মাদ ইব্রাহিম হেম্মাতকে কুর্দিস্তানে পাঠানো হয়। ওই সময় ইরাকের সাদ্দাম সরকারের পাশাপাশি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের কিছু শক্তির পৃষ্ঠপোষকতা বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলো কুর্দিস্তানের বেশ কিছু এলাকা দখল করে নিয়েছিল। এ সময় মোহাম্মাদ বোরুজেরদি, আহমাদ মুতাওয়াসসেলিয়ান ও ড. মোস্তফা চামরানের মতো আরো কয়েকজন প্রখ্যাত সেনা কমান্ডারকে সঙ্গে নিয়ে হেম্মাত বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কবল থেকে কুর্দিস্তানকে মুক্ত করেন।

ইরাকি বাহিনী ইরানে আগ্রাসন চালানোর এক বছর পর অর্থাৎ ১৯৮০ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত শহীদ হেম্মাত কুর্দিস্তানেই ছিলেন। তিনি কুর্দিস্তানে নিজের দায়িত্ব পালনের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে নিজের ডায়েরিতে লিখেছেন: আমরা শুধু বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে লড়াই ই করিনি সেইসঙ্গে তাদেরকে রাষ্ট্রদ্রোহী তৎপরতা থেকে ফিরিয়ে আনারও চেষ্টা করি। আমরা ‘পাভে বার্তা’ নামে একটি ম্যাগাজিন প্রকাশ করে এবং তাতে বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতা ছেড়ে দেশপ্রেমী আচরণ করতে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সদস্যদের প্রতি আহ্বান জানাই। এর ফলে এক বছরে শত্রুদের প্রতারণার শিকার ৩৬২ জন বিচ্ছিন্নতাবাদী তাদের ভারী অস্ত্রসস্ত্র ও গোলাবারুদসহ আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। তাদের সবার প্রতি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হয়।  ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী বা আইআরজিসি’র অভিযানের মুখে রাষ্ট্রদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সদস্যরা হয় দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায় অথবা আত্মসমর্পণ করে। ফলে অচিরেই কুর্দিস্তান থেকে এসব গোষ্ঠী নির্মূল হয়ে যায় এবং প্রদেশটিতে পরিপূর্ণ শান্তি ও নিরাপত্তা ফিরে আসে।

মূলত ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামি বিপ্লব হওয়ার পরপরই কুর্দিস্তানে রাষ্ট্রদ্রোহী তৎপরতা শুরু হয়। বিপ্লব বিরোধী আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক চিহ্নিত শত্রুদের উসকানিতে বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলো বিপ্লবী সরকারের পতন ঘটানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করে। প্রথমদিকে তারা কুর্দি জনগোষ্ঠীর অধিকার রক্ষার স্লোগান তুলে সাধারণ মানুষের মধ্যে জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং এ সময় অনেক তরুণ ও যুবক প্রতারিত হয়ে এসব গোষ্ঠীতে যোগ দেয়। বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলো কুর্দিস্তানের বিভিন্ন স্থানে ভয়াবহ অপরাধযজ্ঞ চালায়। তারা প্রদেশের পাভে শহর অবরোধ করে সেখানে ভয়াবহ গণহত্যা চালায়। তাদের হাতে শহরটি অবরুদ্ধে থাকার সময় নারী ও শিশুরা ঘরের বাইরে বের হওয়ার সাহস করত না। শহরের পুরুষরা আইআরজিসি’র সহযোগিতায় বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলোকে মোকাবিলা করতে নেমে পড়েছিলেন। বিচ্ছিন্নতাবাদীরা এসব পুরুষ ও আইআরজিসির সদস্যদের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালায়। ১৯৭৮ সালে ১৪ জুলাই কুর্দিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদীরা প্রদেশটির মারিভান শহরে হানা দিয়ে সেখানে মোতায়েন থাকা আইআরজিসি’র প্রায় অর্ধেক সদস্যকে হত্যা করে।

তো শ্রোতাবন্ধুরা, দেখতে দেখতে ইরান-ইরাক যুদ্ধের ইতিহাস শীর্ষক ধারাবাহিকের আজকের সময়ও ফুরিয়ে এসেছে। আগামী আসরে আমরা শহীদ হেম্মাত সম্পর্কে আরো কিছু কথা বলব। সে আসরেও আপনাদের সঙ্গ পাওয়ার আশা#

পার্সটুডে/ মুজাহিদুল ইসলাম/৭

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ