নভেম্বর ১০, ২০২৩ ১৭:২৮ Asia/Dhaka

রংধনু আসরের কাছের ও দূরের শিশু-কিশোর বন্ধুরা, কেমন আছো তোমরা? আশাকরি ভালো ও সুস্থ আছো। বরাবরের মতোই আজকের আসরে তোমাদের সঙ্গে আছি আমি গাজী আব্দুর রশীদ এবং আমি আকতার জাহান।

বন্ধুরা, আজকের আসরের শুরুতেই থাকছে আড়াই হাজার বছরের পুরোনা গ্রন্থ কালিলা ও দিম্‌না থেকে নেওয়া একটি গল্প। গল্পের পর থাকবে একটি গান। আমাদের আজকের অনুষ্ঠানটিও তৈরি করেছেন আশরাফুর রহমান। তো প্রথমেই প্রথমেই শুরু হচ্ছে আমাদের আজকের গল্প 'কবুতর ও আবু তিমার'।

আবু তিমার একটি বকের নাম। বকটি ছিল খুব সাবধানী ও খুঁতখুঁতে স্বভাবের। তবে সে ছিল ধর্মপরায়ণ বক। সে কয়েকদিন ক্ষুধা ও তৃষ্ণায় কাটিয়ে দিতো। একেবারে দুর্বল না হয়ে পড়লে খেতো না, পানি পান করতো না ও মাছ ধরতো না। একান্ত প্রয়োজন হলে সামান্য দু'ফোটা পানি পান করতো এবং ছোট্ট একটি মাছ ধরে খেতো।

পাখীরা আবু তিমারের কাছে আসা-যাওয়া করতো এবং বিভিন্ন কাজ ও সমস্যায় তার সাথে পরামর্শ করতো ও তার মতামত নিয়ে চলতো। আবু তিমারও তার অপূর্ণ বুদ্ধি বিবেচনা মোতাবেক পরামর্শ দিতে কৃপণতা করতো না। আবু তিমারের সুন্দর আদর্শ ও চিন্তাদর্শনের প্রশংসা করে তাকে 'জনদরদী' খেতাব দিল তারা।

এভাবে আবু তিমারের দিনকাল কেটে যেতে লাগল। একবার এক কবুতর এক আজব বিপদে পড়ল। কবুতরটির বাসা ছিল একটি বড় গাছের খোপে। তার ছিল বেশ কয়েকটি শিশু সন্তান।

ওই জঙ্গলেই ছিল একটি শিয়াল। শিয়াল কবুতরের বাচ্চাদের খবর জানতো। কিন্তু সে গাছে উঠতে পারতো না। তাই সে ভাবলো কবুতরকে ভয় দেখিয়ে একেক করে বাচ্চাদের হাত করতে হবে। একদিন সে গাছের নিচে এস কবুতরের উদ্দেশ্যে হাঁকডাক শুরু করল এবং বলল: এ গাছ আমার, তুই কেন অনুমতি না নিয়ে এখানে বাসা বাঁধলি?

কবুতর বলল: আমি জানতাম না যে, এ গাছ তোমার। এখন আমার বাচ্চারা খুব ছোট। উড়তে পারছে না। ক'দিন পর এরা বড় হলে এখান থেকে চলে যাবো।

শিয়াল : না, মোটেও না। এখুনি গাছ খালি করে চলে যাও।

কবুতর বলল: আমি কোথায় যাবো এ বাচ্চাদের নিয়ে? আশপাশে কোন সুবিধাজনক জায়গা নেই যে, বাচ্চাদের রাখতে পারব। ওরাও এখন যেতে পারবে না।

শিয়াল : আমি এসব বুঝিসুঝি না। হয় গাছ ছাড়, নইলে উপরে উঠে তোমার বাচ্চাদের সব খেয়ে ফেলব।

কবুতর ভয় পেয়ে গেল এবং বলল : আমাকে ক'টা দিন সময় দাও।

শিয়াল: তোমার একটি বাচ্চা যদি আমার কাছে বন্ধক রাখো তাহলে একদিনের সুযোগ দেবো।

কবুতর নাচার হয়ে একটি বাচ্চাকে শিয়ালের জিম্মায় ছেড়ে দিয়ে বলল: ওকে সাবধানে রেখো যেন কষ্ট না পায়।

শিয়াল: যদি আগামীকালের ভেতর চলে যাও তাহলে বাচ্চা ঠিক মতো পাবে। নাহলে বাচ্চার মুখ দেখবে না।

শিয়াল কবুতরের বাচ্চা নিয়ে গেল তার বাসায় এবং সেখানে ওকে খেয়ে ফেললো। পরদিন সকালে এসে আবার ভয়ঙ্কর শোরগোল বাধিয়ে দিল। উপায়হীন কবুতর আরেকটি বাচ্চা দিলে শিয়াল তা নিয়ে চলে গেল এবং পথেই ওকে খেয়ে ফেলল।

সেদিন দুপুরেই আবু তিমার যাচ্ছিল ওই পথ নিয়ে। এসময় সে দেখতে পেল কবুতর অত্যন্ত বিমর্ষ ও বিষণ্ন মনে বসে বসে কী যেন ভাবছে। আবু তিমার কবুতরের কাছে এর কারণ জানতে চাইলে কবুতর সব ঘটনা খুলে বলল।  

আবু তিমার বলল:  তোমার এ মুশকিলের আসান আছে। আমি এই যাচ্ছি, এখুনি চলে আসব। তুমি কোন চিন্তা করো না। ফিরে এসে বলবো কী করতে হবে।

আবু তিমার উড়ে গেল নদীতে এবং একটি ছোট মাছ ধরে তার পেট ছিদ্র করল। এরপর মাছের পেটে ঢুকিয়ে দিল সাপের বিষ। তারপর মাছ নিয়ে উড়ে এলো কবুতরের কাছে এবং বলল : 'তুমি এ মাছটা রেখে দাও। এ মাছের পেট সাপের বিয়ে ভরা। কাল যখন শিয়াল আসবে এবং শোরগোল বাধাবে তখন ওকে বলো : আমি এখান থেকে যাব না,  যা ইচ্ছে কর গিয়ে। তখন দেখবে শিয়াল মোটেও গাছে উঠতে পারবে না। সে নিরাশ হয়ে চলে যাবে। আর যদি দেখো সত্যি সত্যি সে গাছে উঠে আসছে তখন বলবে না, থামো। আমি তো শুধু ঠাট্টা করছিলাম। অতঃপর শিয়াল যদি বন্ধক চায় তখন বাচ্চার বদলে এ মাছটি দিয়ে দেবে। শিয়াল বিষাক্ত মাছ খেলে মারা যাবে।

কবুতর জনদরদী আবু তিমারের জন্য দোয়া করে মাছটা নিয়ে সাবধানে রেখে দিল। এরপর চুপ করে গর্তের ভেতর লুকিয়ে রইল। এসময় শিয়াল এসে হাঁকডাক ছেড়ে বলল: হয় একটি বাচ্চা ছুড়ে ফেল, নয়তো উপরে উঠে এসে সবগুলো খেয়ে ফেলব।

কবুতর বলল: আমি কী অস্বীকার করেছি নাকি? এই নাও একটি বাচ্চা।

এই বলে কবুতর মাছ ছুড়ে মারলো শিয়ালের সামনে। শিয়াল কবুতরের চোখের সামনেই মাছটা খেয়ে ফেলল এবং বলল : 'এটা আবার কীসের বাচ্চা!?"

কবুতর: আমার বাচ্চা! তোমার ভয়ে এ রকম হয়ে গেছে। তুমি জানো না, অতিরিক্ত শব্দে লোকেরা অসুস্থ হয়ে পড়ে?

শিয়াল বলল: না, আমি এসব মানিনে। এ ধরনের বাচ্চাও আমি চাই না। আমাকে আরেকটি বাচ্চা দাও।

কবুতর ভীষণ মন খারাপ করে বলল: আর কোন বাচ্চা নেই। যা করতে পারিস কর দেখি। আমি জানি যে, তুই গাছে উঠতে পারিস না। মিথ্যা আস্ফালন দেখাস। তোর বাহাদুরী বুঝে গেছি।

শিয়াল এ কথা শুনে বুঝল যে, তার চালাকি ধরা পড়ে গেছে। তারপর বলল: ঠিকই বলেছিস, আমি গাছে উঠতে জানি না। আর গাছে উঠতে পারলেও উঠতাম না। কারণ তুই সত্যি খুব ভালো পাখী। এখন থেকে তুই আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। কিন্তু বল্‌ দেখি কীভাবে বুঝলি আমি গাছে উঠতে পারি না?

কবুতর: এমন লোকের কাছ থেকে এ কথা শিখেছি যার কাছে তোকে সত্তর বছর পড়াশোনা করতে হবে। সবার দুঃখে সে দুঃখী। সব নদীনালা তার অধিকারে। তাকে সবাই ডাকে জনদরদী বলে।

শিয়াল বলল: বেশ ভালো কথা। জনদরদীকে চিনি। তার আসল নাম আবু তিমার। আমি আর এখানে আসবো না। তবে আবু তিমারও এখানে আর কোনদিন আসবে না। যাই, তার কাম শেষ করিগে।

কবুতর বলল: আবু তিমার আমার মতো দুর্বল নয়। সে তার ঠোঁট দিয়ে তোর চোখ বের করে নেবে। সে কখনো তার কাজে ভুল করে না।

শিয়াল: সে চিন্তা আমি করবো। তবে তার খবরও তোর কাছে পৌঁছে যাবে। তখন বুঝবি জনদরদী, গরীবের বন্ধুর কী অবস্থা হয়েছে।

শিয়াল সোজা চলে এলো নদীর পাড়ে। এসেই দেখলো আবু তিমার হাঁটু পানিতে এক পা দাঁড়িয়ে চিন্তামগ্ন। শিয়ালের আগমন টের পেয়েই আবু তিমার ফিরে দাঁড়ালো এবং সামনাসামনি মুখ করে তার সাথে লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিল। তারপর জিজ্ঞেস করল: কী প্রয়োজনে এসেছো?

শিয়াল বলল: শুনলাম আপনি নাকি অনেক অনেক অভিজ্ঞতা রাখেন এবং সবাই আপনার কাছ থেকে শিক্ষাদীক্ষা নেয়। আমি আজ এক সমস্যায় পড়ে আপনার সাথে পরামর্শ করতে এলাম।

আবু তিমার নিজের প্রশংসা শুনে গলে গেল এবং বলল তোমার মনে যা চায় জিজ্ঞেস করতে পারো।

আমি শিয়াল বলল: আমার সমস্যাটি হলো আমি বাতাসকে ভীষণ ভয় পাই।  ভয় এ জন্যে যে, চোখে ধুলাবালি পড়তে পারে।

আবু তিমার : বেশ, যখন বাতাস বইবে তখন তোমার চোখ বন্ধ করে রেখো।

শিয়াল: কিন্তু আমার নাক কী করব, কান কী করব? আমি আপনার কাছে জানতে এসেছি যে, জোরে যখন বাতাস বয় তখন আপনি কী করেন?

আবু তিমার :  কোন ব্যাপারই নয়, তখন আমরা মাথা গুঁজে রাখি পালকের ভেতর।

শিয়াল বলল : আপনি অত্যন্ত ভাগ্যবান পাখী। আপনাদের পাখা আছে, পালক আছে, কিন্তু আমি যে দুর্ভাগা। আমার পাখা পালক কিছুই নেই। এখন বলুন আমার কী উপায় হবে?

আবু তিমার: বেশ, তুমি চোখ বন্ধ করবে, ঘাড় নুইয়ে রাখবে, নিজের শরীরটাকে গুটিয়ে নেবে। মাথাটাকে দুই হাতের ফাঁকে গুঁজে দেবে আর হাঁটু দিয়ে কান ও নাক ঢেকে রাখবে। ব্যস!

শিয়াল : ঠিক সমাধান দিয়েছেন। কিন্তু আমার স্মরণশক্তি খুবই দুর্বল। কী যে বললেন তা মাথায় ঢুকছে না। আপনি কি দয়া করে একবার এ কাজটা চাক্ষুষভাবে আমাকে দেখাবেন যাতে আমি আপনার কাছ থেকে শিখে নিতে পারি।

আবু তিমার: 'এই যে, দেখিয়ে দিচ্ছি, এভাবে করবে ...এই বলে আবু তিমার নিজেকে গুটিয়ে নিলো এবং মাথা বুকের নিচে ঢুকিয়ে দুই পাখা দিয়ে সামনের ভাগ ঢেকে ফেলল।

শিয়াল মওকা বুঝে এক লাফে আবু তিমারের ঘাড় মুখে কামড়ে ধরে বলল: এতসব কথা তোকে ধরার জন্যেই বলেছি। আমি বাতাসকে ডরাই না, ডরাই তোর লম্বা ঠোঁটকে। এখন এমন শিক্ষা দেবো যাতে কবুতরদের গিয়ে জ্ঞানবুদ্ধি দিতে পারবি না।   

আবু তিমার বুঝতে পারল যে, শিয়ালের প্রশংসা ও গুণকীর্তনে নিজের জ্ঞানবুদ্ধি হারিয়ে ফেলেছিল। নিজেকে সামলে নিয়ে সে বলল: আমার একটা প্রশ্নের জবাব দাও, ঐ মাছটা কী খেয়েছো?

শিয়াল : অবশ্যই খেয়েছি। এখন তোকেও খাবো।

আবু তিমার: আমাকে খাওয়ার অধিকার তোমার আছে। কেননা আমি কবুতরের কাছে তোমার ছলচাতুরী ধরিয়ে দিয়েছি। তবে আমি তোমার একদিনের খোরাক মাত্র। আমাকে যদি ছেড়ে দাও- আমি তোমার জন্য প্রতিদিন দুটো বড় মাছ ধরে দেবো। এতে আমাকে হত্যার গুনাহও যেমন তোমার ঘাড়ে বর্তাবে না, তেমনি সব সময়ের জন্যে তোমার খাওয়া দাওয়ার চিন্তাও দূর হয়ে যাবে।

শিয়াল: ঠিক আছে মেনে নিলাম। কিন্তু কথা দিতে হবে ওয়াদা ভঙ্গ করবি না. ফাঁকি দিবি না।

আবু তিমার : তুমি যেভাবে চাও সেভাবেই জামানত দেবো। আমরা বকেরা কখনো ওয়াদা ভঙ্গ করি না। এ কথা তুমি নিজেও ভাল করে জানো।

এমন সময় শিয়ালের পেটে সাপের বিষ কাজ শুরু করে দিল। শিয়াল দেখল যে. তার মাথা ও কলিজায় ব্যথা শুরু হয়েছে। ব্যথার যন্ত্রণায় আবু তিমারকে ধরে রাখার শক্তি পাচ্ছে না। তাই সে আবু তিমারের কথায় রাজী হয়ে তাকে ছেড়ে দিল এবং সেখান থেকে চলে গেলো। কিন্তু আর কোন দিন সে নদীর পাড়ে ফিরে এলো না।

শ্রোতাবন্ধুরা, অনুষ্ঠানের এ পর্যায়ে রয়েছে একটি শিক্ষামূলক গান। 'যে গানে শেখার কিছু নেই' শিরোনামের গানটির গীতিকার: কবি মতিউর রহমান মল্লিক, সুরকার: জাফর সাদিক।  আর পরিবেশন করেছে লক্ষ্মীপুরের অনুপম শিল্পীগোষ্ঠীর শিশু শিল্পীরা।

তো বন্ধুরা, তোমরা গানটি শুনতে থাকো আর আমরা বিদায় নিচ্ছি রংধনুর আজকের আসর থেকে। কথা হবে আবারো আগামী সপ্তাহে।

পার্সটুডে/আশরাফুর রহমান/১০

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ