নভেম্বর ২৫, ২০২৩ ১৫:০৫ Asia/Dhaka
  • গানের পাখির বিশ্ব ভ্রমণ
    গানের পাখির বিশ্ব ভ্রমণ

প্রিয় পাঠক ও শ্রোতাবন্ধুরা! সালাম ও শুভেচ্ছা নিন। আশা করি যে যেখানেই আছেন ভালো ও সুস্থ আছেন। আজ আমরা শুনবো ইরানের প্রাচীন একটি প্রবাদের গল্প। গল্পটি হলো কবুতরকে নিয়ে। 

প্রত্যন্ত মরু অঞ্চলে একটা খাল ছিল জনপদ থেকে বেশ দূরে। ওই খালের দুই পাড়ের গর্তের ভেতর বাসা বানিয়েছিল বুনো কবুতরের দল। কবুতরগুলো একসাথেই থাকতো। এদের মধ্য থেকে দুটো কবুতরের মাঝে বেশ বন্ধুত্ব গড়ে উঠলো। তারা দু'জন প্রতিরাতেই খোশগল্প করতো। দিনের বেলায় পরস্পরকে গান শোনাতো এবং দিনভর একসাথে শস্যদানা খেতো।

তাদের একজনের নাম ছিল কণ্ঠশিল্পী আরেকজনের নাম যন্ত্রশিল্পী। একদিন তারা দুজন যখন মরুপ্রান্তরের দিকে উড়ে উড়ে যাচ্ছিলো সঙ্গীতশিল্পী দূরের সবুজ পাহাড় দেখে যন্ত্রশিল্পীকে দেখালো। বললো: চলো দেখি আসি ওখানকার অবস্থা। যন্ত্রশিল্পী প্রতিবাদ করে বললো: নাহ, অনেক দূর। এতো দূরে যাওয়াটা ঠিক হবে না। যেখানেই যাই না কেন এখন আমরা যেখানে থাকি সেখান থেকে ভালো এবং শান্তিপূর্ণ কোনো জায়গা পাবো না। তাছাড়া সেখানে আমাদের শিকার করার জন্য কোনো শিকারীও তো ওঁৎ পেতে বসে থাকতে পারে কিংবা অন্য কোনো বিপদও তো থাকতে পারে। 

যন্ত্রশিল্পী বিরক্ত হয়ে বন্ধুকে বললো: তুমি তো দেখছি ভীষণরকমের ভীতু! আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি পৃথিবীর দূর-দূরান্তে সফর করবো, একঘেঁয়ে জীবন আর ভাল্লাগে না। আমি ঘুরে ঘুরে বেড়াতে চাই। সঙ্গীতশিল্পী সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলো: প্রিয় বন্ধু আমার! পৃথিবীর সব জায়গাই প্রায় এক রকম। সফর করা বিচিত্র বিপদের পাশাপাশি অনেক কষ্টেরও। খামোখা কেন আমাদের জীবনকে বিপদের মুখে ঠেলে দেবো! যন্ত্রশিল্পী চীৎকার করে বললো: না না, আমি তো শুনলাম সফর করার মাঝে অনেক কল্যাণ রয়েছে। ব্যক্তিগত জীবনে অভিজ্ঞতাও সঞ্চিত হয়। পানি যদি স্থির স্রোতোহীন থাকে, ময়লা হয়ে যায়। মনীষীরা সবসময় সফর করতে এবং বিচিত্র স্থান দেখতে উৎসাহিত করেছেন।

সঙ্গীতশিল্পী বললো: প্রত্যেকেই তার জীবনে নিজ নিজ পথে যায়। বাজপাখি কিংবা ঘোড়সওয়ারের জন্য সফর করা ঠিক আছে, একটা কবুতর কিংবা একটা পোষা মুরগির পক্ষে যৌক্তিক নয়। যারাই নিজেদের বাপ-দাদার ভূমি ছেড়ে গেছে বিদেশে, অচেনা জায়গায় তারা বিপদে পড়েছে এমনকি মারা গেছে। তোমার জানা উচিত আমাদের মতো জীবনের জন্য অনেকেই আক্ষেপ করে। যারা নিজেদের জীবনকে ভালোভাবে জানে না কিংবা অচেনা বস্তুর লোভে নিজেদের চিরচেনা ঘর ত্যাগ করে অতি দ্রুতই তারা নিজেদের কাজের জন্য অনুশোচনা করে। আমি আমার বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে জীবনযাপন করাকে উপভোগ করি। পরিবার-পরিজন থেকে দূর থাকা যে কতো কষ্টের সেটা আমি জানি। 

যন্ত্রশিল্পী বললো: তোমার এসব কথায় আমি কান দেবো না। পৃথিবী অনেক বড়, যেখানেই যাবে সেখানেই তুমি বন্ধু-বান্ধব তৈরি করে নিতে পারবে। আমি সফরের কষ্টে ভীত নই কেননা অভ্যাস আছে। কষ্ট হলেও বিশ্ব ভ্রমণ করা, ঘুরে ঘুরে দেখার একটা মূল্য, আনন্দ তো আছেই। কণ্ঠশিল্পী এবার বললো: তোমার এসব কথায় ভেবো না আমার দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন হবে। তবে হ্যাঁ! সফরে যদি কোনোরকম বিপদাপদের মুখে পড়ো তাহলে পুরোনো বন্ধুর কাছে ফিরে আসতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করো না, আমি তোমাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়ে গ্রহণ করবো। এই বলে দুই বন্ধু কোলাকুলি করলো। যন্ত্রশিল্পী ফিরে গেল তার নীড়ে আর কণ্ঠশিল্পী সবুজ গাছ-গাছালির সৌন্দর্য দেখতে দেখতে উড়ে গেল পার্বত্য বনাঞ্চলের দিকে।

যেতে যেতে একটা সবুজ ক্ষেতে গিয়ে পৌঁছলো। উপত্যকার কোল ঘেঁষে বিচিত্র রঙের ফুলের সমাহার ছিল। আবহাওয়াও ছিল উপভোগ্য। শিল্পী মনে মনে বললো: এরকম একটা জায়গায় যদি বাসা হতো তাহলে কতই না ভালো হতো। গাছের মগডালে বসে বসে সুন্দর বাগিচা আর ঝরনাধারা দেখতে পারতাম, রাতে আকাশের উজ্জ্বল তারা দেখতাম। সূর্যটা অস্তমিত হবার পথে ছিল। পাখিও ক্লান্ত ছিল। হঠাৎ করেই আকাশ কালো মেঘে ঢেকে গিয়ে ঝড় শুরু হয়ে গেল। বজ্রপাত শেষে ভীষণ বৃষ্টি এলো। বিশ্রামের জন্য নির্বাচিত ডালটিকে তার আর উপযুক্ত মনে হলো না। ঝড়ের গতিবেগ এতো বাড়লো যে আশ্রয় নেয়ার মতো স্থান খুঁজে বের করতে পারলো না। 

গানের পাখিটি ঠাণ্ডায় কাঁপছিল। একটা ঝোপ-ঝাড়ের ভেতর কোনোরকম লুকিয়ে রাতটা পার করে দেবে বলে ভাবলো। মনে মনে বললো: বড় ভুল করে ফেলেছি মনে হয়। একাকি এই অপরিচিত জায়গায় এসেছি। কেন যে বন্ধুর কথা শুনলাম না! পরক্ষণেই নিজেকে নিজেই জবাব দিলো: আবহাওয়া তো আর সবসময় এরকম থাকবে না। এতো দ্রুত মন ভাঙলে চলবে কেন! কোথাও যাবো না, পরিস্থিতি শান্ত হোক, আমিও শান্ত হই, দৃঢ় মনোবল হই। শেষ পর্যন্ত গানের পাখি ওই ঝোপঝাড়েই ঝড়-ঝঞ্ঝার ভেতর কষ্টে-শিষ্টে রাতটা কাটিয়ে দিলো। সকালে যখন আকাশের মেঘ কেটে গেল এবং নতুন সূর্য উঠে চারদিক আলোকিত করে দিলো কণ্ঠশিল্পী পাখি আবারও ঝোপঝাড় থেকে বেরিয়ে গাছের সেই মগডালে গিয়ে বসলো। সেখানে একটা বিষয় সে খেয়াল করলো: অন্যান্য যে পাখিরা উড়ে যাচ্ছে, শব্দ করছে, তাদেরকে সে চেনেও না, ভাষাও বোঝে না।

সুতরাং একটু নি:সঙ্গ বোধ করলো সে। চমৎকার ওই পরিবেশে তার খুব গান গাইতে ইচ্ছে করলো কিন্তু মন সায় দিচ্ছিলো না। মনে মনে বললো: ফিরে যাওয়াই কি ভালো না? আবার জবাব দিলো: নাহ, বিশ্ব-ভ্রমণে বেরি হয়েছি, সফর চালিয়ে যাবো এবং শেষ করবো। তারপর ফিরবো বাসায়। এমন সময় সে দেখলো একটা বাজপাখি নখরের পাঞ্জা তাক করে তার দিকে ধেয়ে আসছে। গানের পাখি স্বাভাবিকভাবেই ভয় পেয়ে গেল। তার বুক ধড়ফড় করতে লাগলো। মনে মনে বললো: এই শত্রুর হাত থেকে রক্ষা পেলে ঘরে ফিরে যাবো। ঠিক সে সময় আরেকটা ঈগল তীক্ষ্ণধার পাঞ্জা খুলে অন্যদিক থেকে উদয় হলো। গানের পাখি এবার কাঁপতে কাঁপতে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেল।#  (পরবর্তী পর্বে সমাপ্য)

পার্সটুডে/এনএম/২৫/১১৬

মূল ফার্সি গল্পের রূপান্তর: নাসির মাহমুদ

ট্যাগ