স্বাস্থ্যকথা: আত্মহত্যা-পর্ব ৩
'মানুষ কেন আত্মহত্যা করে'
শ্রোতাবন্ধুরা! রেডিও তেহরানের সাপ্তাহিক স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বিষয়ক অনুষ্ঠান স্বাস্থ্যকথার আসরে সবাইকে স্বাগত জানাচ্ছি আমি গাজী আবদুর রশীদ। আমরা গত দু সপ্তাহে মনের বিশেষ রোগ সিজোফ্রেনিয়া নিয়ে আলোচনা করেছি। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ দিনাজপুরের প্রিয় শ্রোতাবন্ধু ও নিয়মিত পত্রলেখক দেবাশীষ গোপের অনুরোধে এ বিষয়ে আমরা দুই পর্বে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলামের সাক্ষাৎকার প্রচার করেছি।
আরও দুটি পর্ব প্রচারের ইচ্ছে ছিল কিন্তু বিশেষজ্ঞ এই চিকিৎসক ভীষণভাবে ব্যস্ত থাকায় আমরা এ সপ্তায় যোগাযোগ করতে ব্যর্থ হয়েছি। তবে মনের রোগ-আত্মহত্যা বিষয়ক আগে গৃহীত সাক্ষাৎকার আমরা এ সপ্তাহ থেকে প্রচার করব। পরবর্তীতে আবার ফিরে আসব সিজোফ্রেনিয়ায়। তো চলুন আত্মহত্যা বিষয়ক আলোচনায় যাওয়া যাক। এখানে একটু বলে রাখি আমাদের এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বাংলাদেশের জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সাবেক বিভাগীয় প্রধান ছিলেন।
অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলাম-রেডিও তেহরানের স্বাস্থ্যকথার আসরে আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছি।
রেডিও তেহরান: অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলাম, অধ্যাপক ডা, তাজুল ইসলাম, অনেকে মানসিক সংকট কাটাতে ব্যর্থ হয়ে আত্মহত্যা করছেন। বর্তমানে আত্মহত্যার পরিমাণ বাংলাদেশ ও ভারতে অনেক বেড়ে গেছে। যেকথা আমি শুরুতেই জানতে চাইব, এই যে মানুষ আত্মহত্যা করছেন-এই আত্মহত্যা করা বা এই প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়া- এটা কি রোগ?
অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলাম: ধন্যবাদ আপনাকে। সুন্দর প্রশ্ন করেছেন। গবেষণায় দেখা গেছে আত্মহত্যার যে পরিসংখ্যান দেয়া হয় তারচেয়ে অনেক বেশি মানুষ আত্মহত্যা করে এবং আত্মহত্যার চিন্তা করে থাকে। অনেকের মাথায় আত্মহত্যার চিন্তা আসে। কিন্তু ধর্মীয়সহ বিভিন্ন কারণে তারা আত্মহত্যা করে না।
হতাশার কারণে আত্মহত্যা করে থাকে অনেক মানুষ
আপনার প্রশ্ন ছিল আত্মহত্যা রোগ কি না? দেখুন, মানুষ মনের সুখে আত্মহত্যা করে না। মনের অসুখে মানুষ আত্মহত্যা করে কিংবা আত্মহত্যার করে থাকে। তবে উদাহরণ হিসেবে এটাকে জ্বরের সাথে তুলনা করা যায়। জ্বর যেমন শুধু একটা রোগ না। এটি অনেক রোগের উপসর্গ। ঠিক তেমনি আত্মহত্যাও বিভিন্ন রোগের উপসর্গ। অনেক কিছুর ফলে সৃষ্ট বিষয় সবশেষে এসে আত্মহত্যায় রূপ নেয়। ফলে এটাকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় বিভিন্ন রোগের উপসর্গ বলব।
শ্রোতাবন্ধুরা! স্বাথ্যকথার আসরে আত্মহত্যা নিয়ে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলামের সাক্ষাৎকার শুনছেন। ফিরছি শিগগিরিই আমাদের সাথেই থাকুন।
অধ্যাপক তাজুল ইসলাম, অনেকে আত্মহত্যাকে সামাজিক ব্যাধিও বলে থাকেন-একে সামাজিক ব্যাধি বলা যায় কি না?
অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলাম: এই প্রশ্নটিও চমৎকার। দেখুন, একে সামাজিক ব্যাধি বলা যায় কি না সে প্রসঙ্গে আত্মহত্যার কারণ কিন্তু সামনে আসে। বিখ্যাত সমাজতাত্ত্বিকরা আত্মহত্যার কারণ হিসেবে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিস্থিতিকেই বুঝিয়েছেন।
অর্থাৎ সমাজের ভেতর যখন বিশৃঙ্খলা এবং অসঙ্গতি দেখা দেয়, সমাজে যখন অদৃষ্টবাদিতা দেখা যায়। ভাগ্য বা নিয়তির উপর নিয়ন্ত্রণ নেই বলে সমাজে মনে করা হয় অথবা সামাজিক সমর্থন নেই বা হারিয়ে ফেলার চিন্তা করা হয় সেক্ষেত্রে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ে। এটি বিখ্যাত গবেষণার ফল। এক্ষেত্রে তারা সাংস্কৃতিক বিষয়টিকেও গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু বলে মনে করেন।
আত্মহত্যা
দারিদ্র্য, যৌতুক, বেকারত্ব,কাউকে হেয় করা,তুচ্ছ কারণে অপমাণিত হওয়ার মতো ঘটনায় আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা যায়। আর এ সবগুলোর মধ্যে সামাজিক এবং পারিবারিক প্রেক্ষাপট রয়েছে। ফলে আত্মহত্যাকে সামাজিকব্যাধি না বললেও এর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটের কথা অবশ্যই বলতে হবে।
রেডিও তেহরান: জ্বি, আপনি বলছিলেন, এটি সামাজিকব্যাধি না হলেও সামাজিক বিভিন্ন প্রেক্ষাপটের কথা বললেন-যেসব কারণে মানুষ আত্মহত্যা করে থাকেন।প্রচণ্ড মনস্তাত্ত্বিক চাপ সহ্য করতে না পেরে মানুষ এই পথ বেছে নেন। এমনও বলা হয়ে থাকে দুর্বল চিত্তের মানুষ-আত্মহত্যা করে থাকেন। একথাটা কি ঠিক?
অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলাম: দেখুন, একথাটাও ঠিক নয়। অনেক মনে করেন যে দুর্বলচিত্তের মানুষরাই কেবল আত্মহত্যা করে থাকেন। আমাদের সমাজের ভেতর থেকে এই ধারনাকে দূর করতে হবে। অত্যন্ত সবল ও দৃঢ়চিত্তের মানুষ,অত্যন্ত পরার্থপর এবং হৃদয়বান মানুষ, অত্যন্ত সমাজিক ও দয়াপ্রবণ মানুষও আত্মহত্যা করতে পারে। মানুষ যখন মানসিক সংকটে পড়েন- যেমন-হতাশা, উদ্বেগ। অন্যান্য রোগের কারণে মানসিক বড় ধরনের ক্ষত সৃষ্টি হওয়া থেকেও আত্মহত্যা করতে পারেন।
আবেগীয় সংকট থেকে আত্মহত্যা করতে পারে মানুষ
বিভিন্ন কারণ থেকে মানসিক রোগ হতে পারে হতে পারে মানসিক সমস্যা হতে অথবা মনোসামাজিক সমস্যা হতে পারে যেটাকে আমরা বায়ো সাইকো সোশ্যাল অ্যাসপেক্ট থেকে বিবেচনা করতে পারি। কারও মনের উপর যখন বড় ধরনের ভাঙন সৃষ্টি হয়। যখন তারঁ কাছে পৃথিবী/জগৎটাকে ভারবহ ও অসহনীয় মনে হয়। তাঁর কাছে যখন আশার আলো না থাকে এবং ভবিষ্যত তার কাছে অন্ধকার মনে হয়;সংকট সমাধানের যখন আর কোনো সম্ভাবনা দেখতে পান না তখনই কিন্তু তারা আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। অতএব যারা বাইরে থেকে মনে করেন স্বার্থপর লোকেরা কিংবা দুর্বল মনের লোকেরাই আত্মহত্যা করে থাকেন সেই ভাবনাটি ঠিক নয়। যাঁরা এ ধরনের কথা বলছেন তারাও যদি এরকম মন কিংবা আবেগীয় পরিস্থিতির মধ্যে পড়েন তখন তারা যতই সবল থাকুন না কেন তারাও কিন্তু আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে পারেন। একথা ঠিক নয় যে দুর্বল মনের মানুষ আত্মহত্যা করে।#
সাক্ষাৎকার গ্রহণ, গ্রন্থণা ও প্রযোজনা করেছেন গাজী আবদুর রশীদ।
পার্সটুডে/জিএআর/৩০