ইসরাইলের বিরুদ্ধে হামাসের আল আকসা তুফান অভিযানের ফলাফল-(পর্ব-২)
পশ্চিম এশিয়া অঞ্চলের রাজনৈতিক ইতিহাসে ৭ই অক্টোবর চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। এই দিনে, গাজার প্রতিরোধ যোদ্ধারা দখলদার ইসরাইলের অভ্যন্তরে সফল হামলা চালায় যা ইসরাইলের ৭৫ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় পরাজয়ের ঘটনা। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী এই পরাজয়কে 'অপূরণীয় পরাজয়' বলে অভিহিত করেছেন। এ প্রসঙ্গে আমরা গত পর্বের আলোচনায় ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাতের ইতিহাস নিয়ে কথা বলেছি। আজ আমরা হামাসের সাম্প্রতিক আল আকসা তুফান অভিযান ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইসরাইলের ব্যর্থতার নানা দিক সম্পর্কে আলোচনা করবো।
গত পর্বের আলোচনায় আমরা ইসরাইলের বিরুদ্ধে হামাস ও ইসলামি জিহাদ আন্দোলনের আল-আকসা তুফান অভিযানে ইসরাইলের সামরিক ব্যর্থতার কিছু দিক তুলে ধরেছিলাম। আজ আমরা এ ঘটনায় ইসরাইলের রাজনৈতিকসহ আরো বেশ কিছু ক্ষেত্রে ব্যর্থতা নিয়ে কথা বলবো। এই অভিযানের ফলে ইসরাইলের যে রাজনৈতিক ক্ষতি হয়েছে তা অভ্যন্তরীণ, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে হবে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ইসরাইলের ক্ষতির তিনটি গুরুত্বপূর্ণ দিক রয়েছে। প্রথমত, গাজার যুদ্ধকে কেবল হামাস ও ইসরাইলের মধ্যকার যুদ্ধ হিসেবে দেখা উচিত নয় বরং ইরানের সর্বোচ্চ নেতার ব্যাখ্যা অনুযায়ী একে ইসলাম ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তির মধ্যকার লড়াই এবং হক ও বাতিলের মধ্যকার লড়াই হিসাবে দেখতে হবে। দ্বিতীয় বিষয় হল আল-আকসা তুফান অভিযান মার্কিন শক্তির পতনের আরেকটি সূচক প্রকাশ করেছে। কারণ আমেরিকা নিজেকে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর দেশ বলে মনে করে, কিন্তু সম্প্রতি গাজা যুদ্ধে তারা সরাসরি ইসরাইলকে সর্বাত্মক সাহায্য সমর্থন দিয়েও নিজেদের ইচ্ছে অনুযায়ী এই সংঘাতের অবসান ঘটাতে পারেনি।
গাজা যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ইসরাইলের তৃতীয় ক্ষতির দিকটি হচ্ছে, বিশ্ববাসী যখন ফিলিস্তিন প্রসঙ্গ প্রায় ভুলে যেতে বসেছিল ঠিক তখন গাজা যুদ্ধ আবারো ফিলিস্তিনিদের প্রতি সারা বিশ্বের মনোযোগ আকৃষ্ট করেছে। ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরাইলি সেনাদের বর্বরতার বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী ব্যাপক প্রতিবাদ বিক্ষোভ আমরা প্রত্যক্ষ করেছি, এমনকি আমেরিকার অভ্যন্তরেও যে বিশাল বিক্ষোভ হয়েছে তা গত ৭৫ বছরে ছিল নজিরবিহীন।
আঞ্চলিক পর্যায়ে, ইসরাইলের মারাত্মক ক্ষতির দিকটি হচ্ছে, সৌদি আরবের সাথে তাদের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল তা মুখ থুবড়ে পড়েছে। ইসরাইলের বিরুদ্ধে আল-আকসা তুফান অভিযানের ফলে একদিকে আরব দেশগুলোর সাথে ইসরাইলের সম্পর্ক স্থাপনের প্রক্রিয়া যেমন থেমে গেছে তেমনি এই অঞ্চলের জনগণ বুঝতে পেরেছে যে তাদের প্রধান শত্রু এবং প্রধান হুমকি হচ্ছে দখলদার ইসরাইল। আর অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে ইসরাইলের সামরিক শক্তির দুর্বলতা ও গোয়েন্দা ব্যর্থতা প্রমাণিত হয়েছে যা কিনা ইসরাইলের বৈধতা, নিরাপত্তা ও জনসংখ্যার কাঠামোর ওপর মারাত্মক আঘাত।
গাজা যুদ্ধে আন্তর্জাতিক, আঞ্চলিক ও অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে ইসরাইল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ছাড়াও সামাজিক অঙ্গনেও তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে আমরা ইসরাইলের অপরাধযজ্ঞ ও ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধ সংগ্রামের প্রভাবের কথা উল্লেখ করতে পারি। গত ৭ অক্টোবর হামাসের হামলা প্রতিহত করতে ব্যর্থ হওয়ার পর ইসরাইল পাল্টা প্রতিশোধ হিসাবে নিজের ব্যর্থতা ঢাকার জন্য গাজার ফিলিস্তিনিদের ওপর ব্যাপক গণহত্যা শুরু করে এবং এমন কোনো অপরাধযজ্ঞ নেই যা তারা করেনি। এসব অপরাধযজ্ঞ ইসরাইলের আসল চেহারা বিশ্বের সামনে উন্মোচিত করেছে। ইসরাইলের বিরুদ্ধে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের জনগণের বিক্ষোভ থেকে ইসরাইল বিরোধী মনোভাব ফুটে উঠেছে। দ্বিতীয়ত, ইসরাইল ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ ও গণহত্যা চালালেও ফিলিস্তিনিদের মনোবলকে ধ্বংস করতে পারেনি বরং ফিলিস্তিনিদের ঈমান ও চেতনা আরো সুদৃঢ় হয়েছে। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা এ প্রসঙ্গে বলেছেন, 'গাজার মানুষকে বিশ্ববাসী একদিকে মজলুম হিসাবে চিনেছে অন্যদিকে গাজা শয়তানী শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধের প্রতীকে পরিণত হয়েছে। এ ছাড়া, গাজার জনগণের মধ্যে ধৈর্য ও আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস সুদৃঢ় হয়েছে।'
এখন বিশেষজ্ঞ মহলে প্রশ্ন উঠেছে, এই অনৈতিক যুদ্ধ কে আগে শুরু করেছে? ইসরাইলের বিরুদ্ধে আল-আকসা তুফান অভিযানের পর হতভম্ব ইসরাইল ও তাদের সমর্থকরা হামাসের এ পদক্ষেপের বৈধতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা চালিয়েছে। এমনকি তারা সবাইকে এটা বোঝানোর চেষ্টা করছে যে, হামাসের হামলার কারণেই ইসরাইলিরা গাজার জনগণের ওপর হত্যাযজ্ঞ শুরু করেছে এবং হামাস ইসরাইলি বন্দীদের সাথেও দুর্ব্যবহার করেছে। যদিও তাদের এ দুটি দাবিই মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। বন্দীদের বিরুদ্ধে হামাস দুর্ব্যবহার করেছে বলে খবর প্রকাশের পর বেশ কয়েকজন সাংবাদিক বলেছেন, এ ধরনের দাবি মোটেও সত্য নয়। এ ছাড়া মুক্তিপ্রাপ্ত কিছু ইসরাইলি বন্দীও জানিয়েছে, বন্দী থাকার সময় হামাসের সদস্যরা তাদের সাথে কোনো ধরনের সহিংস বা কুরুচিপূর্ণ আচরণ করেনি।
প্রকৃতপক্ষে, ইসরাইলের বিরুদ্ধে হামাসের এ সামরিক পদক্ষেপ ছিল গত ৭৫ বছর ধরে চলে আসা ইসরাইলি জুলুম নির্যাতন ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া মাত্র এবং গত ১৭ বছর গাজা সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ অবস্থায় রয়েছে। এমনকি ফিলিস্তিনি জনগণ নিজ ভূমিতে ফিরে আসার দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল করলেও ইসরাইল সেখানে হামলা চালাচ্ছে এবং এ পর্যন্ত শত শত ফিলিস্তিনি শহিদ হয়েছে। এ ছাড়া, প্রতি বছর ইসরাইলি সৈন্য এবং ইহুদি বসতি স্থাপনকারীদের হাতেও বিপুল সংখ্যক ফিলিস্তিনি নারী ও শিশু হতাহত হয়।
বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, ইসরাইল দশকের পর দশক ধরে ফিলিস্তিনিদের জায়গা জমি দখল করে তাদের ওপর জুলুম নির্যাতন চালিয়ে গেলেও ইসরাইলের এ অনৈতিক আচরণ নিয়ে কোনো প্রশ্ন উত্থাপিত হয় না। আর এ কারণে ইসরাইল সমালোচনা কিংবা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছে। এ অবস্থায় ইসরাইলি অন্যায়ের প্রতিক্রিয়া হিসাবে গাজার প্রতিরোধ যোদ্ধাদের সামরিক অভিযান কতটুকু লাভজনক হবে তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। এ প্রসঙ্গে কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করতে হবে।
প্রথম কথা হলো, হামাসের বিরোধীরা ইসরাইলি গণহত্যার নিন্দা না করে উল্টো তারা বলার চেষ্টা করছে ইসরাইলের এ পদক্ষেপ হামাসের সামরিক অভিযানেরই ফল। এমনকি ইসরাইলের শক্তির তুলনায় তারা হামাসকে খাটো করে দেখানোরও চেষ্টা করছে। অথচ কারবালায়ও ইমাম হোসাইন (আ.) জানতেন যে তাঁর সঙ্গীদের সংখ্যা শত্রুর তুলনায় অনেক কম। কিন্তু তিনি তারপরও অপমানের কাছে নতি স্বীকার না করে সসম্মানে যুদ্ধ করেন এবং সবাই শহীদ হন। তাই হামাসের সামরিক অভিযান একেবারে ব্যর্থ হয়নি এবং বহু ক্ষেত্রে তাদের অর্জন অভাবনীয়।#
পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন/
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।