ডিসেম্বর ৩০, ২০২৩ ১৬:৫৬ Asia/Dhaka

প্রিয় পাঠক ও শ্রোতাবন্ধুরা! সালাম ও শুভেচ্ছা নিন। আশা করি যে যেখানেই আছেন ভালো ও সুস্থ আছেন। আজকের আসরে আমরা শুনবো ইরানের প্রাচীন একটি প্রবাদের গল্প। প্রবাদটি হলো:

অন্যের লাগানো গাছের ফল খেলাম আমরা 
এবার আমরা লাগাবো গাছ, খাবে অন্যরা।

কোত্থেকে এলো এই প্রবাদটি। আমরা সেই গল্পটি শুনবো। গল্পটি এরকম: একজন বাদশাহ ছিলেন আনুশিরওয়ান নামে। তিনি একদিন শিকার করতে বের হলেন। তাঁর সঙ্গে ছিল তাঁর এক জ্ঞানী-গুণী, বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ মন্ত্রী। মন্ত্রীর নাম বোজোর্গ-মেহর। শহর থেকে বেরিয়ে পড়লেন তাঁরা।

যেতে যেতে দু'জনই শিকারের জায়গার কাছাকাছি পৌঁছে গেলেন। এমন সময় তাঁদের নজর পড়লো এক বৃদ্ধের ওপর। শ্বেত শূভ্র চুলের ওই বৃদ্ধ মাটিতে বসে একটি লতা-গুল্ম লাগানোর জন্য গর্ত খুঁড়ছিলেন। তাঁর বয়স আনুমানিক আমি বছরের মতো হবে। আনুশিরওয়ান বৃদ্ধকে দেখে এবং তাঁর লতা-গুল্ম লাগানোর চেষ্টা দেখে অবাক হয়ে গেল। বুজুর্গমেহর বললো: এই বৃদ্ধ এখানে কী করে দেখে আসা যাক। ঘোড়ার লাগাম ঘুরিয়ে বৃদ্ধের কাছে গেল তারা। বৃদ্ধকে সালাম দিলো, খোজ-খবর নিলো, কুশল বিনিময় করলো। আনুশিরওয়ান বৃদ্ধের দিকে ফিরে বললো: কী করছেন আপনি! বৃদ্ধ হেসে দিয়ে বললো: কিছু না। আখরোট গাছ লাগানোর চেষ্টা করছি। আনুশিরওয়ান অবাক হয়ে বললো: আখরোট গাছ! সত্যি বলতে কী, আপনার মতো একজন বুড়ো মানুষ বিশ্রাম না নিয়ে এরকমভাবে কাজ করছেন দেখে খুবই অবাক হয়েছি। এই যে আপনি বললেন আখরোট গাছ লাগাচ্ছেন একথা শুনে তো আরও বেশি আশ্চর্য হয়ে গেলাম। বৃদ্ধ বলেলো: কৃষিকাজ করা আমার অভ্যাস। আলহামদুলিল্লাহ আমার শরীরে এখানে যা শক্তি আছে খারাপ না, কাজ করতে পারি। কাজেই কাজ করা, লতা-গুল্ম লাগানো ইত্যাদি কাজ করতে অবাক হবার কিছু নেই। কিন্তু বুঝতে পারলাম না আখরোট গাছের চারা রোপন করার কথা শুনে এতোটা অবাক হবার কী আছে?

আনুশিরওয়ান বললো: আপনি তো জানেন যে আখরোটের চারা বড় হতে অনেক সময় লাগে। অন্তত সাত-আট বছর সময় তো শুধু সবুজ হয়ে উঠতেই লাগবে, তারপর আখরোট কবে ধরকে কে জানে! আমার অবাক হবার কারণটা হলো আপনি আশাবাদী যে আরও সাত-আট বছর আপনি বেঁচে থাকবেন এবং নিজের হাতে লাগানো গাছের আখরোটের স্বাদ গ্রহণ করবেন। আনুশিরওয়ানের কথায় মনের ভেতর মৃত্যুর স্মরণ হবে এবং বুড়ো একটু ঘাবড়ে যাবেন-এটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু না, বুড়ো এ কথা শুনে খুব স্বাভাবিকভাবেই বললেন: আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন এ এলাকায় শত শত আখরোট গাছ ছিল, আমরা আখরোট গাছের উপরে উঠে আখরোট পেড়ে খেতে পারতাম। 

বুড়ো আরও বললেন: আমরা যেসব গাছে উঠে আখরোট খেতাম জানতেও পারিনি কোনোদিন কে ওই গাছগুলো লাগিয়েছিল। একইভাবে আমি যদি নাও থাকি অবশ্যই কেউ না কেউ এ গাছের আখরোট পেড়ে খাবে। অন্যরা লাগিয়েছে আমরা খেয়েছি, আমরা লাগাবো অন্যরা খাবে। এটাই তো জগতের নিয়ম। আনুশিরওয়ান বৃদ্ধের যথাযথ কথায় খুব খুশি হয়ে গেল। বললো: বাহ, সাবাশ। বাদশাহর মুখে সাবাশ শব্দ শুনে বুজোর্গমেহর ঘোড়ার জিন থেকে একটা টাকার থলি এনে বৃদ্ধ কৃষকের হাতে দিলো। এটা বাদশাহর রীতি। আনুশিরওয়ান যদি দুইবার সাবাশ সাবাশ বলতো তাহলে দুই থলি টাকা পুরস্কার দিতো।
বৃদ্ধ থলির মুখ খুললেন এবং থলির ভেতরের মুদ্রার দিকে তাকিয়ে বাদশাহ আনুশিরওয়ানকে বললেন: দেখলে তো আমার লাগানো আখরোট গাছ সাত আট না যেতেই ফল দিতে শুরু করেছে! আমি তো এই মুদ্রাগুলো আখরোটের চারা রোপন করার কারণেই উপার্জন করেছি। আনুশিরওয়ান এবার খুশি হয়ে বললো: সাবাশ, সাবাশ! বুজোর্গমেহর এবার বৃদ্ধকে দুই থলি স্বর্ণ উপহার দিলো। বৃদ্ধ কৃষক এবার ভীষণ খুশি হয়ে বললেন: বিশ্রাম নেন দয়া করে। আনুশিরওয়ানের খুব ইচ্ছে করছিল ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে অভিজ্ঞ ওই বুড়োর পাশে বসে তার কথা শুনতে কিন্তু বুজোর্গমেহর বললো: আমাদের কিন্তু অনেক কাজ বাকি, অনেক দূরেও যেতে হবে। সুতরাং বিশ্রাম না করাটাই মনে হয় ভালো হবে। 

আনুশিরওয়ান বুজোর্গমেহরের কথার অর্থ বুঝতে না পেরে বললো: না না, ঘণ্টাখানেক এখানে অভিজ্ঞ বৃদ্ধের কাছে বসে গেলে কোনো ক্ষতি নেই। বুজোর্গমেহর বললো: না, তেমন ক্ষতি নেই। তবে আমি ভয় পাচ্ছি এই বৃদ্ধ তার সুন্দর কথায় আপনাকে একের পর এক অভিভূত না করে আর আপনি বারবার সাবাশ বলে ওঠেন কিনা; আমার তো তাহলে এই ঝুলির ভেতর যা কিছু আছে সব বৃদ্ধকেই খালি করে দিয়ে যেতে হবে। আমাদের তো এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে টাকা-পয়সা ছাড়াই। এ কারণেই আমি এখান থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখান থেকে চলে যেতে বলছি। অনুশির্বণ আর বৃদ্ধ দুজনেই হেসে উঠল।

ওই ঘটনার পর থেকে যারা এমন কোনো কাজে হাত দেয় যার সুবিধা এবং ফলাফল দেখতে বছরের পর বছর ধৈর্যের প্রয়োজন হয়, তারা অন্যের তিরস্কার এড়াতে, এই প্রবাদটি ব্যবহার করতে শুরু করে: অন্যরা রোপণ করেছে আমরা খেয়েছি, আমরা অন্যদের খাওয়ার জন্য বপন করেছি।#

পার্সটুডে/এনএম/৩০/১২১

মূল ফার্সি গল্পের রূপান্তর: নাসির মাহমুদ

ট্যাগ