সেপ্টেম্বর ১৪, ২০১৭ ১৮:১০ Asia/Dhaka

গত ১২ ভাদ্র ছিল বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৪১তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৩৮৩ বঙ্গাব্দের ১২ ভাদ্র ঢাকায় তৎকালীন পিজি হাসপাতালে এই মহৎ প্রাণ কবি মহান প্রভূর ডাকে সাড়া দিয়ে পরপারে চলে যান। কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৪১তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আমরা একটি বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করেছি। এতে কবির জীবন ও তার শিশু সাহিত্যের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করব। সেইসঙ্গে শোনানো হবে কবি লেখা ছড়াগান ও কবিতা।

বন্ধুরা, তোমরা নিশ্চয়ই শুনেছো যে, কবি কাজী নজরুল ইসলাম ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তবে, তিনি ছিলেন বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের কবি। গ্রাম-বাংলার অসহায় মানুষ থেকে শুরু করে শহরের বড় বড় দালান কোঠার বাসিন্দারাও কবি নজরুলকে মনে প্রাণে ভালোবাসে। কবি ছিলেন সমাজের নির্যাতিত, নিপীড়িত ও অসহায় মানুষে মুখপাত্র। নিজে দুঃখ-কষ্টের মধ্যে বেড়ে উঠেছিলেন বলেই হয়তো মানুষের দুঃখ-দুর্দশা কবিকে দারুণভাবে আলোড়িত করতো। শৈশবে আর্থিক অনটনের কারণেই তিনি মাজারের খাদেম, মসজিদের ইমাম এবং রুটির দোকানের কর্মচারী হিসেবে কাজ করেছেন। শত দুঃখের মধ্যে বড় হলেও তিনি দুঃখ-কষ্টকে জয় করার স্বপ্ন দেখতেন। বর্ধমানের চুরুলিয়া, রাণীগঞ্জের শিয়ারসোল ও ময়মনসিংহের দরিরামপুর-যেখানেই তিনি কৈশোর কাটিয়েছেন সেখানেই তাঁর কৈশোর ছিল দুরন্তপনায় ভরা। মুক্ত আকাশের উদার হাতছানি তার দুঃখ-কষ্টকে ভোলার মন্ত্র শিখিয়েছিল।

দুরন্তমনা, চঞ্চল আর বাধঁনহারা মনোভাবের কারণে কবি নজরুল কোনোখানেই স্থায়ীভাবে বাস করতে পারেননি। তাই তো দরিরামপুর স্কুল থেকে পালিয়ে গিয়ে ভর্তি হন রাণীগঞ্জের সিয়ারসোল রাজ স্কুলে। সেখানে বন্ধু হিসেবে পান শৈলজানন্দকে। নজরুল তখন মাঝে মাঝে ছোট গল্প লিখতেন আর শৈলজানন্দ লিখতেন কবিতা। তারা একজন আরেকজনকে তাদের লেখা দেখাতেন। শৈলজানন্দের কবিতা শুনে নজরুল তাঁকে বাহবা দিতেন এবং নজরুলের গল্পে মুগ্ধ হতেন শৈলজা। একসময় শৈলজানন্দ কবিতা বাদ দিয়ে শুরু করলেন গল্প লেখা। আর নজরুল শুরু করলেন কবিতা লেখা। নজরুল প্রথম যে কবিতাটি লিখলেন তা বেশ হাসির। কবিতাটি এরকম-

এপার হতে মারলাম ছুরি লাগলো কলা গাছে

হাঁটু বেয়ে পড়ল রক্ত, চোখ গেলরে বাবা!

কবিতাটি লেখার পর নজরুল তা শৈলজানন্দকে শোনালেন। কবিতাটি শুনে শৈলজা হেসে কুটি কুটি। অবাক হয়ে বললেন, এ তোর কেমন কবিতা ? ছুরি মারলি কলা গাছে আর রক্ত বেরুল হাঁটু বেয়ে! এটা কেমন করে হয়? নজরুলের স্পষ্ট জবাব, কবিতা না হয় না হলো, হাঁটু বেয়ে রক্ত তো পড়ল। একথা বলার পর দু'বন্ধুই খুব করে হেসে উঠল।

কবি নজরুল ইসলাম শৈশবে যেমন হাস্যরসিক ছিলেন, তেমনি বড় হয়েও তিনি তার লেখায় ব্যাপক হাস্যরসের সৃষ্টি করেছেন। খাদু দাদু কবিতায় তিনি লিখেছেন-

ও মা! তোমার বাবার নাকে কে মেরেছে ল্যাং? 
খ্যাঁদা নাকে নাচছে ন্যাদা- নাক ড্যাঙ্গা-ড্যাং- ড্যাং! 
ওঁর নাকতাকে কে করল খ্যাঁদ্যা রাঁদা বুলিয়ে? 
চামচিকে- ছা ব'সে যেন ন্যাজুড় ঝুলিয়ে। 
বুড়ো গরুর টিকে যেন শুয়ে কোলা ব্যাং। 
অ মা! আমি হেসে মরি, ন্যাক ডেঙ্গাডেং ড্যাং।

ছোট্টবন্ধু হুমায়রা আফনান নাবা'র চমৎকার উচ্চারণে খাদু দাদু কবিতাটি শুনলে। আশা করি ভালো লেগেছে। সত্যি বলতে কী, হাস্যরসযুক্ত কবিতা রচনায় নজরুলের জুড়ি মেলা ভার। তিনি লিখেছেন,

'আমি যদি বাবা হতুম,

বাবা হ'ত খোকা,

না হলে তার নামতা পড়া,

মারতাম মাথায় টোকা।'

অন্য কবিতায় তিনি লিখেছেন,

'মা, খাবার কথা বলি যদি

ভাববি পেটুক ছেলে,

আমি ভাত না খেয়েও থাকতে পারি

পোলাও লুচি পেলে।'

কবি নজরুল তার লেখায় হাস্যরস সৃষ্টি করার পাশাপাশি আল্লাহ প্রেম ও রাসূলের প্রতি ভালোবাসা ঠাঁই পেয়েছিল তাঁর মনের গহীনে। তাইতো তিনি তার কবিতা ও গানের মাধ্যমে মানুষকে আল্লাহ-রাসূলের বাণী শুনিয়েছেন এবং কোরআন হাদিসের আলোকে মানবতার গান গেয়েছেন। আল্লাহর সৌন্দর্য সম্পর্কে তিনি বলেছেন,

হে চির-সুন্দর, বিশ্ব চরাচর

তোমার মনোহর রূপের ছায়া,

রবি শশী তারকায় তোমারই জ্যোতি ভায়

রূপে রূপে তব অরূপ কায়া।

তিনি কেবল আল্লাহর সৌন্দর্যই বর্ণনা করেননি, তাঁর উপর ভরসা রাখাও আহবান জানিয়েছেন। লিখেছেন-

ও মন, কারো ভরসা করিসনে তুই

এক আল্লাহর ভরসা কর,

আল্লাহ যদি সহায় থাকেন

ভাবনা কিসেব, কিসের ডর ?

কবি নজরুল আল্লাহর প্রতি শ্রদ্ধা ও প্রেম নিবেদনের পাশাপাশি রাসূলের প্রতি ভালোবাসা দেখিয়েছেন। কখনো তিনি তাঁর গানের মাধ্যমে নবীজীর রওযা জিয়ারতের আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেছেন, আবার কখনও নবীজী জন্ম, তাঁর জীবন দর্শন, তাঁর শিক্ষা ইত্যাদি বর্ণনা করেছেন। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, নবীজীকে নিয়ে তিনি নাত লিখেছেন একশ'র উপরে!

বন্ধুরা, কবি নজরুল আসলে তার লেখনির মধ্য দিয়ে নিজের বয়সকে অতিক্রম করতে পেরেছিলেন। বিদ্রোহী কবিতায় তিনি যে দাবি করেছিলেন অর্থাৎ 'আমি চির, শিশু চির কিশোর'- তা তিনি তাঁর কাব্য-সাহিত্যে প্রমাণ করেছেন। তিনি লিখেছেন-

খোকার মনের ঠিক মাঝখানটিতে

আমি যদি পারি বাসা নিতে।'

হ্যাঁ, শিশুর মনে বাসা বেঁধেছিলেন বলেই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, শিশুরা শারীরিকভাবে দুর্বল হলেও মানসিকভাবে তারা দুর্বল নয়। কবির ভাষায়-

তুমি নও শিশু দুর্বল

তুমি মহৎ মহীয়ান,

জাগো দুর্বার, বিপুল বিরাট

অমৃতের সন্তান।

কবি নজরুল শিশুদের সাধারণ শিক্ষা দিতে রাজি ছিলেন না। প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষিত হয়ে তারা পরাধীনতার অভিশাপ গ্রহণ করবে এটা তার কাম্য ছিল না। শিশুরা সঠিক শিক্ষা লাভ করে দেশকে স্বাধীন করবে, এ আশা পোষণ করে মুকুল ফৌজদের উদ্দেশ্য করে তিনি লিখেছেন,

তোমরা মুকুল, এই প্রার্থনা কর ফুটিবার আগে

তোমাদের পায়ে যেন গোলামের ছোঁয়া জীবনে না লাগে। 

গোলামীর চেয়ে শহীদী দর্জা অনেক উর্ধ্বে জেনো

 চাপরাশির ঐ তকমার চেয়ে তলোয়ার বড় যেনো। 

সমাজের অন্যায়, অনাচার, অবিচার বিদেশী শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে কবি ছিলেন একজন প্রতিবাদী মানুষ। আর তাই বিভিন্ন লেখার মাধ্যমে তিনি ওইসব অনিয়মের বিরুদ্ধে তিনি শিশুদের জাগিয়ে তুলতে চেয়েছেন। ভোরের সোনালী সূর্য জানালা দিয়ে উঁকি দেয়ার পরও শিশুরা ঘুমিয়ে থাকবে কবি তা মোটেও পছন্দ করতেন না। তাই তিনি লিখেছেন,

আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে,

তোমার ছেলে উঠলে গো মা রাত পোহাবে তবে। 

ছোট্টবন্ধুদের কণ্ঠে ছড়াগানটি শুনলে। নজরুল ছিলেন একজন বিজ্ঞানমনস্ক কবি।  ‘সংকল্প' কবিতায় তিনি শিশু–কিশোরদের অগ্রগামি হওয়ার, এগিয়ে যাবার, গবেষণা করার, সর্বোপরি বিজ্ঞানভিত্তিক জীবন গড়ার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। বদ্ধ ধারণাকে বিদায় দিয়ে মুক্ত আকাশের স্বপ্নে বিভোর শিশুদের যুক্তিবাদী করার সংকল্পও ব্যক্ত করেছেন কবিতাটিতে। 

গানের সুরে সংকল্প কবিতাটি শুনলে। বন্ধুরা, তোমরা নিশ্চয়ই জানো যে, কবি নজরুলের শিশু সাহিত্যের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ হচ্ছে ঝিঙে ফুল। ঝিঙে ফুল বইয়ের দ্বিতীয় কবিতাটি আমাদের অতিচেনা ক্ষুদ্রপাখি কাঠবেড়ালীর সঙ্গে এক ছোট্টখুকীর মান-অভিমান মাখা মিষ্টিমধুর আলাপনকে কেন্দ্র করে। অনুষ্ঠানের এ পর্যায়ে বিখ্যাত ওই কবিতাটি শুনব গানের সুরে। 

বন্ধুরা, খুকী ও কাঠবেড়ালিকে নিয়ে কবি নজরুলের কবিতাটি শুনলে। ছোটদের জন্য তিনি এ রকম অসংখ্য ছড়া, কবিতা ও গান লিখেছেন। আশা করি কবির সম্পর্কে জানতে তার লেখাগুলো বেশি বেশি পড়বে।

তো বন্ধুরা, কবি নজরুলের অবর্তমানে তোমাদের মনে একটি প্রশ্ন আসতেই পারে। আর তা হলো- কী করলে কবির প্রতি যথার্থ সম্মান জানানো হবে। এ বিষয়ে কবি নিজেই একটা নির্দেশনা দিয়ে গেছেন তার ভক্তদের উদ্দেশ্যে। তিনি বলেছেন, "যেদিন চলে যাবো সেদিন হয়তোবা বড় বড় সভা হবে, কত প্রশংসা, কত কবিতা বেরোবে আমার নামে, দেশপ্রেমিক, ত্যাগী, বীর বিদ্রোহী-বিশেষণের পর বিশেষণ। টেবিল ভেঙে ফেলবে থাপ্পর মেরে-বক্তার পর বক্তা। এই অসুন্দরের শ্রদ্ধা নিবেদনের দিনে তুমি যেন যেয়ো না-যদি পারো চুপটি করে বসে আমার অলিখিত জীবনের কোনো একটা কথা স্মরণ করো।"#

পার্সটুডে/আশরাফুর রহমান/১৪

ট্যাগ