জানুয়ারি ২৬, ২০১৮ ১৮:৪৭ Asia/Dhaka

বিশিষ্ট ইরানি সুফি-সাধক ও হাদিস-বিশারদ আবু সায়িদ আবুল খাইরের জীবন এবং তাঁর কিছু অবদান সম্পর্কে আলোচনা করব।

ইরানের ইসলামী সুফিবাদ বিশ্ব-সভ্যতা ও সংস্কৃতির এক অন্যতম গৌরবময় অধ্যায়। ইরানের আধ্যাত্মিক সুফি-সাধকদের অবদান এক্ষেত্রে বিশ্ব-বিশ্রুত। ইরানি আরেফ ও সুফিবৃন্দ ইসলামের আধ্যাত্মিক এই ধারার উন্নয়ন এবং বিকাশে অনন্য অবদান রেখেছেন। এমনকি ফার্সি সাহিত্যও ইরানি সুফিবাদীদের কাছে চিরঋণী। ফার্সি সাহিত্য থেকে সুফিবাদীদের অবদান বাদ দিলে তা হয়ে পড়বে খুবই সংকীর্ণ ও সীমাবদ্ধ। এরফানি ও সুফিবাদী ভাবধারার ফার্সি সাহিত্য এই ভাষার সাহিত্য অঙ্গনকে করেছে সুবিস্তৃত ও আধ্যাত্মিক চেতনায় সমৃদ্ধ।

 

আধ্যাত্মিকতার আকাশের কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ তারকার কথা স্মরণ করতে গেলেই স্মরণে আসবে ইরানি সুফি-তারকারদের নাম এবং তাঁদের নামকে এই ধারা থেকে বাদ দিতে গেলে তেমন উল্লেখযোগ্য নামই আর বাকি থাকবে না।  সুফি-জগতের শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন ইরানি তারকার নাম স্মরণ করতে গেলে মনসুর হাল্লাজ, শিবলি ও জুনাইদ এবং বায়েজিদ, খারাক্বানি ও আবু সায়িদ আবুল খাইরের নাম সবার আগেই মনে পড়বে। এই মহান সুফিদের মধ্যে প্রথম তিন জন বসবাস করতেন ইরাক অঞ্চলে। আর শেষোক্ত তিন জন বসবাস করতেন প্রাচীন ইরানের বৃহত্তর খোরাসান অঞ্চলে।

 

ইরানি সুফি-সাধক ও হাদিস-বিশারদ আবু সায়িদ আবুল খাইর (র) হিজরি পঞ্চম শতকের শুরুর দিকে বৃহত্তর খোরাসানে বসবাস করতেন। তাঁর জন্ম হয়েছিল হিজরি ৩৫৭ সাল মোতাবেক খ্রিস্টিয় ৯৬৭ সনে বৃহত্তর খোরাসানের মেইহানেহ নামক পল্লীতে। তিনি এখানেই মারা যান ৮১ বা মতান্তরে ৮৩ বছর বয়সে। অনেকের মতে সে সময়টা ছিল ৪৪০ হিজরি মোতাবেক এক হাজার ৪৮ খ্রিস্টাব্দ।

আবু সায়িদ আবুল খাইরের যৌবন কেটেছে বৃহত্তর খোরাসানেই। সে যুগে এ অঞ্চলটি ছিল গজনভী সুলতানদের শাসনাধীন। তুর্কি এই শাসকদের রাজধানী ছিল গজনি।

গজনির সুলতানদের সাম্রাজ্য পশ্চিম ইরান থেকে ভারতের পূর্বাঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল। আবু সায়িদ আবুল খাইরের জীবনের শেষের দিকে খোরাসান সালজুক তুর্কিদের শাসনাধীনে চলে আসে।  

 

আবু সায়িদ আবুল খাইরের বাবা ছিলেন সুগন্ধি দ্রব্যের ব্যবসায়ী এবং একজন সুফি-সাধক। সুফিদের সঙ্গেই ছিল তার চলাফেরা ও ওঠা-বসা। তাই শৈশবে ও কৈশরে সুফিদের মজলিসে উপস্থিত থাকার সুযোগ পেয়েছিলেন আবু সায়িদ। ফলে বাবা ও বন্ধুদের কাছ থেকে আধ্যাত্মিক পথ-পরিক্রমার ছাত্র হবার প্রাথমিক শিক্ষা পেয়েছিলেন তিনি। শৈশবেই আবু সায়িদ ছিলেন অসাধারণ মেধা ও অনুভূতির অধিকারী।

 

নিজ জন্মভূমিতেই প্রাথমিক শিক্ষা লাভের পর ধর্ম এবং আরবি ও  ফার্সি সাহিত্য বিষয়ে পড়াশুনার জন্য সারাখসে যান আবু সায়িদ। এখানে তিনি ইসলামী আইন, তাফসির ও হাদিস বিষয়েও বিশেষজ্ঞ হন। সে সময়ই তথা যৌবনেই বিখ্যাত শিক্ষক ও আধ্যাত্মিক রহস্য বিষয়ে বিশেষজ্ঞ তথা আরেফদের কাছে থেকে এক্ষেত্রে উপকৃত হন আবু সায়িদ। ইরফান বা ইসলামী আধ্যাত্মিক রহস্যের দিকে তাঁর ছিল পারিবারিক, ঐতিহ্যগত ও প্রকৃতিগত ধর্মীয় শিক্ষকদের উৎসাহে সৃষ্ট প্রবল ঝোঁক। ফলে আবু সায়িদ মাঝে-মধ্যে প্রচলিত পড়াশুনা ছেড়ে দিয়ে নির্জনে সুফি-সাধনায় মশগুল হতেন। আর এ যুগেই আবু সায়িদ ওয়াজ-নসিহত করেছেন এবং বহু ছাত্রকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন।

 

আবু সায়িদ আবুল খাইর তাঁর ধর্মীয় বক্তৃতা ও আলোচনায় নিজের এবং অতীতের কবিদের কবিতা ব্যবহার করতেন। ফলে তাঁর আলোচনা হয়ে উঠত আকর্ষণীয় ও প্রাণবন্ত। তিনি নিজে দেড় হাজারেরও বেশি কবিতার পংক্তি ব্যবহার করেছিলেন তাঁর আলোচনা-সভায়। এসব পংক্তির একটা বড় অংশই ছিল অতীতের কবিদের লেখা। চতুর্পদী কবিতা কিংবা লোক-গীতি থেকে নেয়া এসব পংক্তি তাঁর মুখস্ত ছিল। আবু সায়িদ তাঁর বক্তব্যের ব্যাখ্যায় ব্যবহার করতেন এইসব রসালো ও সুমিষ্ট পংক্তি।

 

গবেষক ও বিশেষজ্ঞদের মতে ইরানি আরেফদের মধ্যে প্রথম কবি ছিলেন আবু সায়িদ। অন্য কথায় তিনিই ছিলেন প্রথম ইরানি আরেফ বা ধর্মীয় রহস্যবিদ যিনি তাঁর চিন্তাধারাকে করেছিলেন কবিতার পোশাকে অলঙ্কৃত ও সুসজ্জিত। এদিক থেকে তিনি ছিলেন  বিশিষ্ট সুফি-সাধক ও মরমি কবি ফরিদউদ্দিন আত্তার এবং সানায়ি’র পূর্বসূরী।

আবু সায়িদ আবুল খাইরের নিজস্ব কবিতা চিহ্নিত করা বেশ দুঃসাধ্য। কারণ তাঁর রচিত কবিতার সংখ্যা খুবই কম বলে মনে করেন গবেষকরা।

 

কোনো কোনো গবেষক মনে করেন আবু সাঈদের লেখা কবিতাগুলোর বেশিরভাগই রুবাই বা চারপদী কবিতা। আর এদিক থেকেও তারা আবু সায়িদকে ইরানের অন্যতম বড় কবি বলে মনে করেন। তারা আবু সায়িদকে ফার্সি ভাষায় ইরফানি কবিতার জনক বলেও উল্লেখ করেন।  কেউ কেউ বলেন আবু সায়িদ যতটা না কবি তার চেয়েও বেশি মাত্রায় ছিলেন কবিতার প্রেমিক। তিনি যেন কবিতার সঙ্গেই জীবন যাপন করতেন। ৫ বছর বয়স থেকেই আবু সায়িদ ছিলেন কবিতা প্রেমিক। তার এই প্রেম মৃত্যু পর্যন্ত বজায় ছিল।

 

আবু সায়িদ আবুল খাইর বিশ্বনবী (সা.)'র পবিত্র আহলে বাইতের প্রবল অনুরাগী ছিলেন। তাঁর বক্তব্য, চিন্তাধারা ও জীবনী সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা পাওয়া যায় 'আসরার আততাওহিদ'বা একত্ববাদের রহস্য নামক গ্রন্থে। বইটি লিখেছেন আবু সাঈদের মৃত্যুর পর তাঁর নাতি মুহাম্মাদ ইবনে মুনাওয়ার।

আবু সায়িদের আধ্যাত্মিক জ্ঞান বা আধ্যাত্মিক পন্থায় অর্জিত জ্ঞান সম্পর্কে চমৎকার মন্তব্য করেছেন বিশ্বখ্যাত চিকিৎসা-বিজ্ঞানী,দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক সাধক ইবনে সিনা। তিনি আবু সাঈদ আবুল খাইরের সমসাময়িক ছিলেন।  

 

কথিত আছে আবু সায়িদ আবুল খাইর (র) ও ইবনে সিনা (র) তিন দিবা-রাত্রি একসঙ্গে ছিলেন। তাঁরা বিভিন্ন বিষয়ে মত বিনিময় করেন। এরপর তাঁরা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হলে ইবনে সিনাকে প্রশ্ন করা হলো, “আবু সাঈদকে কেমন দেখলেন?” উত্তর দিলেন, ‘‘যা আমরা জানি ও বুঝি উনি তা দেখেন।” আবু সাঈদকে প্রশ্ন করা হলো, “আবু আলীকে কেমন দেখলেন?” তিনি বললেন, “যেখানেই আমরা পৌঁছেছি, এ অন্ধও লাঠি নিয়ে আমাদের পেছনে পেছনে আসছে।”

 

সংযম-সাধক আবু সায়িদ অদৃশ্যের খবর জানতে পারতেন। তিনি নিজ ছাত্রদের প্রশিক্ষণ দেয়ার সময় তাদের মনের কথা ও চিন্তা বলে দিতেন।  খোদাপ্রেমের পথিকদের প্রাথমিক দিক-নির্দেশনার দশটি মূল নীতির কথা বলে গেছেন আবু সায়িদ। এগুলো বাছাই করা হয়েছে খোদা-প্রেমের সাধনার ১৮টি নীতিমালা থেকে যা তিনি যৌবনেই অনুসরণ করেছেন। এসবের মধ্যে রয়েছে দরিদ্র ও নিঃস্ব বা দূর্বলদের জন্য নিজ ঘরের দরজা খোলা রাখা, অবসর সময়ে ধর্মীয় বিধি-বিধান শেখা, জোহ্‌দ্‌ বা সংযম সাধনা ও জনসেবা ইত্যাদি। #

পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/ মো: আবু সাঈদ/২৬