মে ১৭, ২০১৯ ১৬:৫৫ Asia/Dhaka

আজ যারা প্রাপ্তবয়স্ক, এক সময় তারাও শিশু ছিলেন। প্রতিটি মানুষই শিশুকাল পেরিয়ে এসেছে। কাজেই আজকের অভিভাবক বা বাবা-মায়েরা শিশুদের সমস্যা ও সংকট সম্পর্কে কম-বেশি অবহিত। এরপরও বেশিরভাগ অভিভাবকের মাঝেই একটি বিষয়ে এখনও দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কাজ করে আর তাহলো, শিশুদের শাস্তি দেওয়া উচিত কিনা।

কারণ শিশুরা কখনো কখনো নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে। কোনোভাবেই থামানো যায় না। এ অবস্থায় কী করা উচিত?

সন্তান লালন-পালনে পুরস্কার ও শাস্তির ভূমিকা অনস্বীকার্য। কিন্তু পুরস্কার বা শাস্তির ধরণ কেমন হবে তা নিয়েই রয়েছে বিতর্ক। শিশুদের শাস্তির কথা উঠলেই প্রথমেই যে শাস্তির কথা মনে পড়ে তাহলো শারীরিক শাস্তি। তবে বেশিরভাগ মনোবিজ্ঞানীই শিশুকে শারীরিক শাস্তি দেওয়ার বিপক্ষে। তাদের মতে, এ ধরণের শাস্তি সাময়িক সমাধান হতে পারে। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে এর নেতিবাচক প্রভাব থেকে যায়। অনেকেই শিশু লালন-পালনের ক্ষেত্রে একেবারে মুক্ত ও স্বাধীন রাখার কথা বলেছেন। ফরাসি দার্শনিক জ্যাঁ জ্যাক রুসো মনে করতেন মুক্ত পরিবেশেই কেবল শিশুর সহজাত  সুপ্ত গুণাবলির বিকাশ সম্ভবপর। তার সংক্রান্ত একটি বইয়ের নাম হচ্ছে-এমিল তিনি তার এই বইয়ে লিখেছেন, শিশুকে যদি কঠিন শাস্তি দেওয়া হয় তাহলে তার মনে ভয়-ভীতি জন্ম নেয় এবং তার ব্যক্তিত্ব গঠনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এর ফলে তার মধ্যে ক্রোধ জন্ম নেয় ও সে মনোকষ্টে ভোগে।

শুধু মনোবিজ্ঞানী বা দার্শনিকরাই নন, যারা শিশুদের নিয়ে কাজ করেন তারাও মনে করেন, শিশুদের জন্য শারীরিক শাস্তি, শিশুর উপকার না করে বরং ক্ষতি করে। তাদের মতে,  নিরুপায় না হলে শারীরিক শাস্তির পথ বেছে নেওয়া ঠিক নয়। তাদের মতে, ভিন্ন কোনো উপায় না থাকলে কেবল সে ক্ষেত্রেই খুবই স্বল্প মাত্রায় শারীরিক শাস্তি দেওয়া যেতে পারে। ইসলামি নির্দেশনাতেও শিশুকে মারধর করতে নিষেধ করা হয়েছে। একবার এক ব্যক্তি হজরত ইমাম কাজেম (আ.)'র কাছে গেলেন এবং তার কাছে নিজের সন্তানের বিরুদ্ধে অভিযোগ করলেন। সব শুনে ইমাম কাজেম (আ.) বললেন, তোমার সন্তানকে মেরো না। তাকে ঠিক করার জন্য তার সঙ্গে একটু রাগ করতে পারো। তবে খেয়াল রেখো তোমার রাগ যাতে দীর্ঘ মেয়াদের না হয়। যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব আবার তার সঙ্গে মিল হয়ে যেও।

এ ক্ষেত্রে আরো একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। রাসূল (সা.)'র সাহাবি আনাস বিন মালেক তার শৈশব কাটিয়েছেন রাসূলে খোদার সান্নিধ্যে। তিনি বলেছেন, আমি অনেক বছর রাসূলের সেবায় নিযুক্ত ছিলাম। কিন্তু রাসূল কখনোই আমাকে গালি দেন নি বা মারধর করেন নি। উম্মে সালমার উদাহরণও এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। তিনি রাসূলের বাড়িতে কাজ করতেন। রাসূল(সা.) একবার একটি কাজের নির্দেশ দেওয়ার পর উম্মে সালমা তা পালন করতে দেরি করেছিলেন। এর জবাবে রাসূল(স.) বলেছেন, যদি কিসাসকে ভয় না পেতাম তাহলে কাঠের মেসওয়াক দিয়ে তোমাকে শাস্তি দিতাম। এখানে কিসাস বলতে সম্ভবত বিচার দিবসের কিসাসকে বোঝানো হয়েছে।

কোনো কোনো চিন্তাবিদ শারীরিক শাস্তিকে অনুমতি দিলেও সেটার মাত্রা খুবই কম। তাদের মতে, শারীরিক নির্যাতন এমন পর্যায়ে যাওয়া যাবে না যে, তাতে চামড়া লাল হয়ে যায়। শিশু অধিকার সনদের ১৯ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, সব দেশের আইনকে এমনভাবে সাজাতে হবে যাতে শিশুর ওপর কোনো ধরনের হিংস্রতা দেখানোর সুযোগ না থাকে।  পরিবার ও স্কুলের পাশাপাশি কোনো প্রতিষ্ঠানেও শারীরিক শাস্তির ব্যবস্থা রাখা যাবে না। কারণ এ ধরণের আচরণ শিশু অধিকার সনদের বিরোধী।  

এবার আমরা আরেকটি প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করব। বাবা-মায়ের ধর্মীয় দায়িত্বগুলোর একটি হচ্ছে, শিশুদেরকে ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়া। এর আগের অনুষ্ঠানেও আমরা বলেছি, শিশুর শিক্ষা ও ব্যক্তিত্ব গঠনের বিষয়টি শিশুর জন্মের আগে থেকেই শুরু হয়ে যায়। স্বামী বা স্ত্রী নির্বাচনের পাশাপাশি গর্ভধারণের সময়টিতে সতর্কতা এ ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

ইসলাম ধর্মে হালাল উপার্জনের ওপর অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বাবা-মায়ের হালাল খাবার বিশেষকরে গর্ভাবস্থায় মা যদি হালাল খাবার গ্রহণ করেন তাহলে তা শিশুর ভবিষ্যৎ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এছাড়া মায়ের বুকের দুধেরও একটা প্রভাব সৎ সন্তান গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে। শিশুকে ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট করে তোলার ক্ষেত্রে বাবা-মায়ের দায়িত্ব অনেক।

চার বছর বয়স থেকে শিশুদের মধ্যে মাজহাবগত অনুভূতি জাগতে শুরু করে। বিশেষকরে আল্লাহর অস্তিত্ব এবং বিশ্ব সৃষ্টির রহস্য সম্পর্কে জানার আগ্রহ এ বয়সে তৈরি হয়। বিভিন্ন হাদিসেও এ সংক্রান্ত বক্তব্য এসেছে। ইমাম সাদেক (আ.) বলেছেন, শিশুর বয়স যখন তিন বছর তখনি তাকে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ শেখান। এটুকুই যথেষ্ট। এর সাত মাস পর তাকে মোহাম্মাদ রাসুলুল্লাহ শেখান। এরপর যখন তার বয়স চার বছর পূর্ণ হবে তখন তাকে সালাওয়াত পড়া শেখান। বয়স পাঁচ বছর হলে শিশুকে ডান ও বাম দিক সম্পর্কে জ্ঞান দিন এবং কেবলামুখী হয়ে সেজদা করতে বলুন। এরপর থেকে তার সামনে নামাজ পড়ুন এবং রুকু-সেজদা শেখান। এভাবে সাত বছর শেষ হলে তাকে ওজুর নিয়ম শেখান এবং তাকে নামাজ পড়তে বলুন। নয় বছর হওয়ার পর তাকে ভালো মতো ওজু ও নামাজ শেখান। এভাবে শিশুকে ওজু ও নামাজ শেখানোর পর বাবা-মা আল্লাহর কাছে পুরস্কার পাবেন।

মনোবিজ্ঞানীদের মতে, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শিশুদের মধ্যে তিন ধরনের ধর্মীয় অনুভূতি জাগে। প্রথম পর্যায়ে মাজহাবগত অনুভূতি বাড়তে থাকে। এরপরে ধর্মীয় শিক্ষার বিষয়ে তাদের সন্দেহ ও দ্বিধা-দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়। তৃতীয় পর্যায়ে গিয়ে তাদের মধ্যে এসব সন্দেহ থেকে নানা প্রশ্ন জাগে। তাদের স্বভাবগত ও যৌক্তিক এসব প্রশ্নের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অনেক সময় তাদের প্রশ্নের বিষয়ে বাবা-মা ও অভিভাবকরা নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখায়। এ ধরনের প্রতিক্রিয়া তাদেরকে ধর্ম থেকে দূরে ঠেলে দেয়। এমনটি হলে এটি ধর্মীয় শিক্ষার জন্য একটি বড় ক্ষতি।

ইসলামি দিক-নির্দেশনা থেকে এটা স্পষ্ট শিশুকে শিক্ষা-প্রশিক্ষণের চূড়ান্ত রূপ হতে হবে আল্লাহর প্রতি অনুগত করে গড়ে তোলা। আমিরুল মুমিনিন হজরত আলী (আ.) বলেছেন, আমি আল্লাহর কাছে সুন্দর ও সুঠামদেহী সন্তানের জন্য দোয়া করি নি। আমি দোয়া করেছি যাতে আল্লাহর প্রতি অনুগত হয় এমন সন্তান আমাকে দান করা হয়। যে সন্তান আল্লাহকে ভয় পাবে। আল্লাহকে মেনে চলবে।#  

পার্সটুডে/সোহেল আহম্মেদ/মো.আবুসাঈদ/ ১৭

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।