অক্টোবর ২৪, ২০১৯ ১৭:৪৭ Asia/Dhaka

রংধনু আসরের শিশু-কিশোর বন্ধুরা,  তোমরা নিশ্চয়ই জানো যে, মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর কাছে সর্বপ্রথম যে বাণীটি পাঠিয়েছিলেন তা হচ্ছে ‘ইক্বরা’ অর্থাৎ ‘পড়ো’। শুধু কি তাই? হযরত আদম (আ.) কে সৃষ্টির পরপরই মহান আল্লাহ একটি প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিলেন। একদিকে সকল ফেরেশতা অপরদিকে হযরত আদম (আ.) একা। আল্লাহ ছিলেন সেই প্রতিযোগিতার বিচারক। প্রতিযোগিতায় বিষয়বস্তু ছিল ‘জ্ঞান’।

আমাদের আদি পিতা আদম (আ.) ওই প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন বলেই আমরা ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ খেতাব পেয়েছি। তার জ্ঞানের শহর হিসেবে পরিচিত রাসূল (সা.) জ্ঞান অর্জনের গুরুত্ব বুঝাতে গিয়ে বলেছেন, ‘তোমরা দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত জ্ঞানার্জন কর।’ এ হাদিস থেকে আমরা জানতে পারলাম, জ্ঞানার্জনের কোনো বয়স নেই। চেষ্টা-সাধনা আর পরিশ্রমের মাধ্যমে যেকোনো বয়সে জ্ঞানার্জন করা সম্ভব।  

জ্ঞানার্জনের কথা উঠলেই সবার আগে চলে আসে আমাদের প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর কথা। তারপর আসে আমিরুল মোমেনীন হযরত আলী (আ.) এর কথা। নবী করিম (সা.) বলেছেন, 'আমার পরে আমার উম্মতের মধ্যে সবচে বড় জ্ঞানী হলেন আলী ইবনে আবি তালিব।'

হাদিসে এসেছে, একদিন নবীজী উচ্চস্বরে বললেন, 'আমি হলাম জ্ঞান ও বিজ্ঞানের শহর আর আলী হলেন সেই শহরের দরোজা। তাই যে-ই জ্ঞান অর্জন করতে ইচ্ছুক সে যেন এই শহরের দরোজার কাছে যায়।'

সত্যি বলতে কী-হযরত আলী (আ.) এর জ্ঞান এবং প্রজ্ঞার কোনো তুলনা হয় না। তিনি ছিলেন আরবি ব্যাকরণের জনক। তাঁর মেধা, তাঁর জ্ঞানের কথা প্রবাদতুল্য। হযরত আলী ছিলেন রাজস্ব প্রথার উদ্ভাবক। তিনিই সর্বপ্রথম ভূমি রাজস্ব প্রথা প্রবর্তন করে ভূমির ওপর চাষীদের অধিকার নিশ্চিত করেন। 

ইবনে মাসউদ বলেন : মহানবী (সা.) আলীকে ডাকলেন এবং তাঁর সাথে একান্তে বসলেন। যখন আলী ফিরে আসলেন, তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম কী আলোচনা করছিলেনতিনি বললেন : মহানবী (সা.) জ্ঞানের সহস্রটি দ্বার আমার জন্য উন্মুক্ত করলেনপ্রত্যেকটি দ্বার থেকে আবার সহস্র দ্বার উন্মুক্ত হয়!

বন্ধুরা, হযরত আলী (আ.) কেমন জ্ঞানী ছিলেন- তোমরা তা উপলব্ধি করতে পারবে এই ঘটনাটি থেকে। একদিন হযরত আলী (আ.) মসজিদের মিম্বারে দাঁড়িয়ে বললেন: হে লোক সকল! আমাকে হারানোর পূর্বেইআমার কাছে জিজ্ঞাসা কর। আমার নিকট থেকে জেনে নাওকেননা পূর্ববর্তী ও উত্তরবর্তীদের জ্ঞান আমার নিকট বিদ্যমান। আল্লাহর শপথযদি বিচারের দায়িত্ব আমাকে দেয়া হয়ইহুদীদের জন্য তাদের কিতাব থেকেইঞ্জিলের অনুসারীদের জন্য সে কিতাব থেকেযবূরের অনুসারীদের জন্য তাদের কিতাব থেকেআর কুরআনের অনুসারীদের জন্য কুরআন থেকে তবে সেভাবেই বিচার করব... আল্লাহর শপথআমি কুরআন ও তার ব্যাখ্যায় সকলের চেয়ে জ্ঞানী।

এরপর তিনি বললেন: আমাকে হারানোর পূর্বেই আমাকে জিজ্ঞাসা কর। কুরআনের যেকোনো আয়াত সম্পর্কে আমাকে জিজ্ঞাসা করআমি তার জবাব দিববলতে পারব তার অবতীর্ণ হওয়ার সময় সম্পর্কেকার উদ্দেশ্যে অবতীর্ণ হয়েছেনাসেখ ও মানসূখ সম্পর্কেআর বলতে পারব সাধারণ ও বিশেষ আয়াত সম্পর্কেমোহকাম ও মোতাশাবিহ আয়াত সম্পর্কেমাক্কী ও মাদানী আয়াতসমূহ সম্পর্কে...।

বন্ধুরা, তোমরা নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছো যে, ইমাম আলী (আ.) কেমন জ্ঞানী ও বিচক্ষণ ছিলেন! রাসূলে খোদা (সা.) ও তাঁর বংশের ইমামগণ মুর্খতাকে অপছন্দ করতেন বলেই আজীবন জ্ঞান বিতরণ করেছেন এবং সবখানে শিক্ষার আলো জ্বালানোর চেষ্টা করেছেন।

একবার রাসূলেখোদা মসজিদে নববীতে গেলেন। সেখানে গিয়ে দেখলেন দুদল লোক গোল হয়ে বসে কোনো কাজে ব্যস্ত আছে। একদল আল্লাহর যিকির-আযকার ও ইবাদত-বন্দেগী করছে আরেকদল জ্ঞানচর্চার কাজে মশগুল। রাসূলুল্লাহ (সা.) দুদলকে দেখেই খুশী হলেন এবং তাঁর সাথের লোকদেরকে বললেন, এ দুদল লোকই ভালো কাজে ব্যস্ত আছে এবং এরা সবাই উত্তম ও পূণ্যবান। কিন্তু আমাকে পাঠানো হয়েছে লোকজনকে শিক্ষা দিয়ে জ্ঞানী করে গড়ে তোলার জন্য।

এ কথা বলেই তিনি সেই দলের দিকে এগিয়ে গেলেন যারা শিক্ষা দান ও গ্রহণের কাজে ব্যস্ত ছিলেন। সেখানে গিয়ে তিনিও তাদের সঙ্গে বসলেন এবং শিক্ষাদানের কাজে লেগে গেলেন।

এ ঘটনা থেকে আমরা জ্ঞানার্জনের গুরুত্ব সম্পর্কে জানতে পারলাম।  আজকের আসরে আমরা এ সম্পর্কেই আরও দুটি সত্য কাহিনী শোনাব। আর সবশেষে থাকবে একটি গান। আমাদের আজকের অনুষ্ঠানটিও তৈরি করেছেন সহকর্মী আশরাফুর রহমান।

জ্ঞানপাগল বুড়ো সাক্কাকী

এক দেশে সাক্কাকী নামে এক দক্ষ কারিগর ছিলেন। তিনি খুব সুন্দর সুন্দর জিনিস বানাতেন। একবার তিনি খুব চমতকার একটি দোয়াত তৈরি করলেন সেদেশের বাদশাহকে দেয়ার জন্য। তার আশা ছিল- বাদশাহ তার হাতের কাজ দেখে প্রশংসা করবেন এবং তাকে মূল্যবান পুরস্কার দেবেন।

দোয়াতটি নিয়ে একদিন তিনি বাদশাহ’র দরবারে গেলেন। বাদশাহ সেটি হাতে নিয়ে এর চমৎকার কারুকাজ দেখতে লাগলেন। তিনি সাক্কাকীকে কিছু বলতে যাবেন ঠিক এ সময় এক সৈন্য এসে খবর দিল যে, একজন বড় আলেম ও সাহিত্যিক এসেছেন বাদশাহর সঙ্গে দেখা করতে। এ কথা শুনে বাদশাহ দ্রুত তাকে দরবারে হাজির করার নির্দেশ দিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওই আলেমকে দরবারের হাজির করা হলো।

বাদশাহ তাকে স্বাগত জানানো ও তাঁর সাথে কথাবার্তায় এমনভাবে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন যে, সাক্কাকী ও তাঁর চমতকার দোয়াতের কথা ভুলে গেলেন। এ অবস্থায় সাক্কাকী মনে কষ্ট পেলেন এবং তার মধ্যে ব্যাপক পরিবর্তন দেখা দিল।

তিনি বুঝতে পারলেন যে, বাদশাহ যেভাবে আলেমকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন তাতে তার কাছ থেকে এ মুহূর্তে কোনো কিছু আশা করে লাভ নেই। এরপর একরাশ হতাশা নিয়ে রাজদরবার ত্যাগ করলেন সাক্কাকী। বাড়ি ফিরে যেতে যেতে ভাবলেন-যেভাবেই হোক তিনিও ওই আলেমের মত জ্ঞানার্জন ও সাহিত্য চর্চা করবেন। তাহলে বাদশাহর দরবারে সম্মান পাওয়া যাবে। কিন্তু এ কাজটি একেবারে সহজ ছিল না। সাক্কাকী তিনি একজন বয়স্ক মানুষ। তিনি তার জীবনের বেশির ভাগ সময়ই ব্যয় করেছেন অন্য কাজে। এখন ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের সাথে পড়াশোনা করা কি সম্ভব?

সাক্কাকীর মনে মনে এসব প্রশ্ন আসলেও তিনি তার সিদ্ধান্তে অটল থাকলেন। তিনি এক মাদ্রাসায় গিয়ে ভর্তি হলেন। প্রথম প্রথম বেশ সমস্যায় পড়লেন তিনি। কোন কিছুই ঠিকমত মনে থাকত না তার। এ সময় একটা বিব্রতকর ঘটনা ঘটল। ঘটনাটি এ রকম-

শাফেয়ী মাজহাবের এক ওস্তাদ তাকে একটি মাসআলা শেখালেন। মাসআলাটি হচ্ছে- “ওস্তাদের আকীদা-বিশ্বাস হচ্ছে যে, কুকুরের চামড়া পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও শুকানোর পর তা পবিত্র হয়ে যায়।”

সাক্কাকী এ বাক্যটি কমপক্ষে দশবার পড়ে মুখস্থ করলেন যাতে পরীক্ষা প্রশ্ন করা হলে সঠিকভাবে জবাব দিতে পারেন। কিন্তু পরীক্ষার সময় যখন তাকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তখন তিনি বললেন, “কুকুরের আকীদা-বিশ্বাস হচ্ছে যে, ওস্তাদের চামড়া পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও শুকানোর পর তা পাক হয়ে যায়।”

 এমন উল্টো উত্তর শুনে উপস্থিত সবাই হাসতে লাগলেন। তারা মনে মনে ভাবলেন- বৃদ্ধ লোকটার লেখাপড়া করার কোনো যোগ্যতা নেই। ওস্তাদদের হাসি-ঠাট্টা দেখে সাক্কাকী খুব লজ্জা পেলেন। তিনি তখনি মাদ্রাসা ছেড়ে চলে গেলেন এক জঙ্গলে। ঘটনাক্রমে তিনি এমন একটা পাহাড়ের কাছে গিয়ে হাজির হলেন যেখানে দেখতে পেলেন যে, একটি পাথরের ওপর ফোঁটা ফোঁটা করে ওপর থেকে পানি পড়ছে। আর এ ফোঁটা ফোঁটা পানির কারণে শক্ত পাথরটিতে একটা ছিদ্র সৃষ্টি হয়েছে।

সাক্কাকী বেশ কিছুক্ষণ বিষয়টি নিয়ে ভাবলেন। ব্যাপারটি তার অন্তরে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করল। তিনি বললেন, আমার মন যদিও লেখাপড়ার প্রতি তেমন আগ্রহী নয় কিন্তু সেটাতো আর পাথরের মত শক্ত নয়। তাই আমিও যদি ঠিকমত লেখাপড়া করি, কঠোর পরিশ্রম করি তাহলে আমারও পক্ষেও একদিন বড় আলেম ও সাহিত্যিক হওয়া সম্ভব।

যেই ভাবনা সেই কাজ। সাক্কাকী জঙ্গল থেকে ফিরে গেলেন মাদ্রাসায়। আবার নতুন উদ্যমে লেখাপড়া শুরু করলেন। এক সময় দেখা গেল তিনি সে সময়কার একজন নামকরা আলেম ও সাহিত্যিকে পরিণত হয়েছেন।

বিখ্যাত বক্তা দুমুস্তেন্স

বন্ধুরা, জ্ঞানপাগল বুড়ো সাক্কাকীর পর এবার আমরা গ্রিসের এক বিখ্যাত বক্তা ও রাজনীতিকের কথা বলব যিনি প্রথম জীবনে ঠিকমত বুঝিয়ে কথাও বলতে পারতেন না। দুমুস্তেন্স নামেও ওই ব্যক্তি ও প্রখ্যাত দার্শনিক এরিস্টোটল একই বছর জন্মগ্রহণ এবং একই বছর মৃত্যুবরণ করেন।

দুমুস্তেন্স যখন ছোট তখন তার বাবা মারা যান। মারা যাওয়ার আগে দুমুস্তেন্সের বাবার তার সম্পত্তি দেখাশোনা করার দায়িত্ব দেন এক লোককে। শর্ত ছিল দুমুস্তেন্স প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর সব সম্পত্তি তার হাতে তুলে দেবেন। কিন্তু প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর দুমুস্তেন্স যখন তার সম্পত্তি বুঝিয়ে চাইল তখন লোভী লোকটি তা ফেরত দিতে অস্বীকার করল।

এ নিয়ে দুমুস্তেন্স পড়লেন মহা চিন্তায়। তবে একেবারে ভেঙে না পড়ে লোভী লোকটির বিরুদ্ধে জনমত গঠনের চিন্তা করলেন তিনি। একদিন তিনি তার এলাকার গণ্যমান্য লোকদের একস্থানে ডাকলেন বিষয়টি জানাতে।

যথাসময়ে লোকজন এসে হাজির হলে দুমুস্তেন্স তার কথা শুরু করল। কিন্তু ঠিকমত গুছিয়ে কথা বলতে পারল না। লোকজনও তার বক্তৃতার খুঁত ধরতে লাগল। লোকদের কাছে নিজের সমস্যার কথা তুলে ধরতে না পারলেও হতাশ হলেন না তিনি। সিদ্ধান্ত নিলেন যেভাবেই হোক একজন ভালো বক্তা হতে হবে।

সিদ্ধান্ত অনুযায়ী একটি নির্জন জায়গা বেছে নিলেন তিনি। প্রতিদিন সেখানে গিয়ে অনুশীলন শুরু করলেন। উচ্চারণের ত্রুটি দূর করার জন্য মুখের ভেতর নুড়ি রেখে অত্যন্ত উচ্চস্বরে কবিতা আবৃত্তি করতে লাগলেন। শ্বাসকে দীর্ঘ ও শক্তিশালী করার জন্য বড় বড় কবিতাগুলো জোরে জোরে পড়তে শুরু করলেন। অধিকাংশ সময় আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বক্তৃতার অনুশীলন করতেন যাতে নিজেই নিজের বাচনভঙ্গী দূর করতে পারেন।

এভাবে কঠোর অনুশীলন ও চেষ্টা-সাধনার মাধ্যমে তিনি অল্প দিনের মধ্যেই গ্রিসের একজন বিখ্যাত বক্তায় পরিগণিত হলেন।#

পার্সটুডে/আশরাফুর রহমান/২৪

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

 

 

ট্যাগ