মার্চ ১৪, ২০২০ ১৭:৪৫ Asia/Dhaka

গত পর্বের আলোচনায় আমরা মহানবী (সা) সম্পর্কে প্রখ্যাত ব্রিটিশ প্রাচ্যবিদ ও ইতিহাসবিদ এডওয়ার্ড গিবনের মন্তব্য ও বিশ্লেষণ তুলে ধরেছি।

গিবন মনে করতেন কুরআন ও ইসলামের শিক্ষাগুলো মহানবীর প্রতিভারই অর্জন বা সাফল্য। গিবন মহানবীর গোত্রকে আরবদের মধ্যে সবচেয়ে সভ্রান্ত গোত্র বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন, মুহাম্মাদ সবচেয়ে বিশুদ্ধ আরবি শিখেছিলেন। পড়াশুনা না করেও তিনি বাগ্মিতা অর্জন করেছিলেন। প্রকৃতির বই থেকে তিনি জ্ঞান অর্জন করতেন। সফরের সময় তিনি দর্শন ও রাজনীতির অনেক কিছুই লক্ষ্য করতেন। সংক্ষিপ্ত ও তাড়াহুড়োমূলক এইসব সফরের সময়ও তার প্রতিভাদীপ্ত চোখ এমন সব বিষয় দেখত যা তার সঙ্গে থাকা দূরদৃষ্টিহীন বা অবিচক্ষণ লোকেরা দেখতে পেত না

 খ্রিস্টিয় অষ্টাদশ শতকের ব্রিটিশ প্রাচ্যবিদ ও ইতিহাসবিদ এডওয়ার্ড গিবন মহানবী (সা) সম্পর্কে এমনভাবে মন্তব্য করেছেন যে তাতে মনে হয় তিনি মহানবীকে খুবই পছন্দ করতেন ও তাঁর ব্যক্তিত্বের অনুসারী ছিলেন! গিবন লিখেছেন:

মুহাম্মাদ বিপুল জনগণের মধ্যে কিংবা বিশেষ কোনো গোষ্ঠীর মধ্যে বক্তব্য দেয়ার আগেই শ্রোতাদেরকে নিজের সমর্থক বানিয়ে ফেলতেন। তাঁর প্রদীপ্ততা বা প্রজ্জ্বোলতা,মর্যাদাময় ও ভাবগম্ভীর উপস্থিতি এবং মহিয়ান বাহ্যিক রূপ বা ভঙ্গিমা, প্রখর দৃষ্টি ও কোমলতা বা দয়া-মিশ্রিত স্মিত হাসি, দীর্ঘ দাঁড়ি ও তাঁর সভ্রান্ত মুখ- এসবই তাঁর আত্মার স্নেহ-মাখা অনুভূতিগুলোর ছবি হয়ে ফুটে উঠত। তাঁর চলাফেরাও তাঁর হয়ে কথা বলত। শ্রোতারা তাঁর প্রশংসা না করে পারত না, তাঁকে বাহবা দিতে বাধ্য হত।....মুহাম্মাদ ছিলেন ইসলামের মহাবিপ্লবের সূচনাকারী একজন খোদাভীরু ব্যক্তি। তিনি মহান আল্লাহর সত্ত্বা নিয়ে এবং তাঁর ওপর অর্পিত ঐশী দায়িত্ব বা রেসালাত নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করতে হেরা পর্বতের গুহার নির্জনতাকে বেছে নিতেন। তিনি রাজত্ব বা রাজা-বাদশাহদের সংশ্লিষ্ট সব বিভাগের আভিজাত্যকে তুচ্ছ মনে করতেন এবং অভিজাতদের দৃষ্টিতে যা অতি সাধারণ বা নিম্ন পর্যায়ের শ্রমিকের কাজ সেসব কাজও নিজেই করতেন!

গিবন মনে করতেন, মুহাম্মাদের চিন্তাধারারই ফসল হচ্ছে ইসলাম ধর্ম। আর এটাই তিনি আরবের নিজ গোত্র ও বংশকে শিখিয়েছেন। একত্ববাদ বা তাওহিদ হচ্ছে এ ধর্মের চিরন্তন বাস্তবতা ও সর্বপ্রধান মূলনীতি। আর এ ধর্মের দ্বিতীয় প্রধান  মূলনীতি হল তাঁরই ঐশী রেসালাত। 

গিবন বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা) সম্পর্কে আরও লিখেছেন:

"তিনি  বিশ্বাসীদের মধ্যে দানশীনতা ও বন্ধুত্বের প্রেরণা জাগিয়ে তুলেছিলেন এবং তাদের মধ্যে সামাজিক নানা গুণ চর্চার ওপর জোর দেন আর প্রতিশোধের আগুন জ্বালানোর এবং বিধবা ও এতিমদের নিপীড়নের প্রথা দূর করেন।

নবীর (সা) যুগ থেকে পবিত্র কুরআনের  অবিকৃত থাকার অলৌকিক ঘটনা  সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে গিবন  বলেন: "এটা মুহাম্মাদের ধর্মের প্রচারণা নয়, বরং তাঁর ধর্মের স্থায়িত্বের নিদর্শন যা আমাদের বিস্মিত হতে বাধ্য করে যে, যা তিনি মক্কা ও মদীনায় লিপিবদ্ধ করিয়ে রেখেছিলেন তা ১২০০ বছর পরও পুরোপুরি  অবিকৃত রয়েছে  ভারতীয় ও  আফ্রিকান এবং তুরস্কের ধর্মান্তরিত মানুষের মাধ্যমে।

খ্রিস্টিয় অষ্টাদশ শতকের ব্রিটিশ প্রাচ্যবিদ ও ইতিহাসবিদ এডওয়ার্ড গিবন কেবল মহানবী (সা) সম্পর্কেই উচ্চ ধারণা ও প্রশংসা ব্যক্ত করে গেছেন তা নয়। তিনি জ্ঞান ও ন্যায়বিচারের জন্য ইসলামের ইতিহাসের প্রবাদপুরুষ ও বিশ্ববিশ্রুত মহানায়ক আমিরুল মু'মিনিন হযরত আলী (আ) সম্পর্কে লিখেছেন,'আলীর গুণ ও উদ্দীপনাকে ছাড়িয়ে যেতে পারেনি অন্য কোনো মুসলমান। তাঁর মধ্যে ছিল কবি, সৈনিক, সাধক বা দরবেশের সমন্বয়। তাঁর প্রজ্ঞা আজও নৈতিক ও ধর্মীয় উপদেশমালার বইয়ে অমর হয়ে আছে। কথার অথবা তরবারির যুদ্ধে প্রত্যেক শত্রু  তাঁর বাগ্মিতা ও বীরত্বের কাছে নতজানু হয়েছে। ইসলাম প্রচারের প্রথম ঘণ্টাটি থেকে রাসুলকে দাফনের শেষ পর্বটি সম্পন্ন করা পর্যন্ত  তিনি কখনও রাসুলের সঙ্গ পরিত্যাগ করেননি,আর এই মহানুভব বন্ধুকে নিজের ভাই,প্রতিনিধি বা উত্তরসূরি এবং তাঁকে মুসা নবীর ভাইয়ের মতই নিজের ক্ষেত্রেও আরেক হারুন বলে সম্বোধন করতে মহা-আনন্দ বা পুলক অনুভব করতেন রাসুল।'

কারবালার মহাবিপ্লবের মর্ম-বিদারী ঘটনায় মহানবীর নাতির শাহাদাতের প্রতি শোক প্রকাশ করে গিবন লিখেছেন,'সেই সুদূর অতীতের সেই পরিবেশে ইমাম হুসাইনের মৃত্যুর করুণ দৃশ্য পাষাণতম পাঠকের হৃদয়েও জাগিয়ে তোলে সহানুভূতি।' গিবন ছিলেন একজন বাস্তববাদী, যুক্তিবাদী ও সাহসী লেখক। তাই খ্রিস্ট ধর্মের সমালোচনা করে গিবন লিখেছেন,‘খ্রিস্ট ধর্ম যেমন পৌত্তলিকতাকে জয় করেছে, তেমনি এটাও সমান সত্য যে এ ধর্ম পথভ্রষ্ট হয়েছে পৌত্তলিকতার মাধ্যমে।

ইহুদিদের নৃশংসতা সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে সাহসী লেখক গিবন আরও খোলাখুলিভাবে লিখেছেন, ‘ইহুদিদের বীভৎস নৃশংসতার বিবরণ শুনে মানবতা মর্মাহত ও শোকাহত হয়। তারা মিশরে, সাইপ্রাসে এবং সাইরেনের শহরগুলোতে যেসব বর্বর আচরণ করেছে তা সেইসব নৃশংসতার অংশ। এইসব শহরে স্থানীয় নিরপরাধ অধিবাসীদের সঙ্গে বন্ধুত্বের ভান করেই তারা বসবাস করত।'

খ্রিস্টিয় অষ্টাদশ শতকের ব্রিটিশ প্রাচ্যবিদ ও ইতিহাসবিদ এডওয়ার্ড গিবন ইহুদিদের পরিচালিত গণহত্যা সম্পর্কে আরও  লিখেছেন,‘সাইরিনে ইহুদিরা হত্যা করেছিল দুই লাখ গ্রিককে। সাইপ্রাসে ইহুদিরা হত্যা করেছিল দুই লাখ ৪০ হাজার ব্যক্তিকে। মিশরেও তারা হত্যা করেছিল বিপুল সংখ্যক মানুষকে। বিজয়-মদমত্ত ইহুদিরা খেয়েছে মানুষের মাংস,চুষেছে রক্ত এবং মানুষের নাড়িভুঁড়িকে মালার মত করে শরীরে ঝুলিয়েছে।#

পার্সটুডে/আমির হুসাইন/আবু সাঈদ/ ১৪

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।