ইরানের পণ্যসামগ্রী: হেল্থ ট্যুরিজম
গত আসরে আমরা বলেছিলাম বর্তমানে ইরানি ওষুধের মান অনেক বেশি এবং সে কারণে বিদেশি ওষুধের তুলনায় রোগিরা ইরানি ওষুধ ব্যাপকহারে বেছে নিচ্ছে।
সাম্প্রতিক দশকে বৈজ্ঞানিক এবং প্রযুক্তিগত অগ্রগতির কারণে ইরান ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্পে বিশ্বের শীর্ষ দশটি দেশের মধ্যে নিজেদের অন্তর্ভুক্ত করতে সক্ষম হয়েছে।
ইরানি বিশেষজ্ঞদের কিছু অর্জনের মধ্যে রয়েছে এমএস রোগীদের জন্য সিনোভক্স "উত্পাদন,পোড়া রোগীদের জন্য" আলভোক্সিন "উত্পাদন, এইডস নিয়ন্ত্রণের ওষুধ উত্পাদন,ক্যান্সার রোগীদের জন্য "রিটক্সিম "ড্রাগ,বি এবং সি ভ্যাকসিন উত্পাদন,অ্যান্টি-টাইফয়েড এবং কলেরার ভ্যাকসিনসহ আরও বহু ওষুধ। বর্তমানে নিউক্লিয়ার আইসোটপও উৎপাদনে অগ্রসরমান ইরান। ইরানে উত্পাদিত এসব ওষুধ আঞ্চলিক দেশগুলোতেও রফতানি করা হয়। ওষুধ এবং ওষুধের কাঁচামালও বর্তমানে আফগানিস্তান,ইরাকসহ মধ্য এশিয়ার কয়েকটি দেশে রফতানি করা হচ্ছে। ওষুধ উৎপাদন এবং চিকিৎসা সেবার দিক থেকে ইরানের এই অগ্রসরতার কারণে হেল্থ ট্যুরিজমের মতো একটি চমৎকার যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে ইরানের সঙ্গে অন্যান্য অনেক দেশের। হেল্থ ট্যুরিজমটা অনেকটা ভ্রমণ বা পর্যটনের মতোই- স্বাস্থ্য পর্যটন। তবে এই পর্যটন স্বাস্থ্যোন্নয়ন কিংবা মনোদৈহিক সুস্থতা নবায়নের জন্য হয়ে থাকে।

সুদূর প্রাচীনকাল থেকেই মানবজীবনে ভ্রমণ এবং পর্যটন সবসময় প্রচলিত ছিল। অতীতে ভ্রমণের মূল উদ্দেশ্য ছিল বাণিজ্য ও জিয়ারত। দীর্ঘ সময় পর্যন্ত কোনো কোনো সমাজে ভ্রমণ বিষয়টা ছিল বিলাসিতার অংশ। কেবল ধনী লোকেরাই দীর্ঘ ভ্রমণে বেড়াতে যেত। ইউরোপে শিল্প বিপ্লবের মধ্য দিয়ে পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও বিকাশসহ মানব জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অগ্রগতির সূচনা হয়। এর ফলে ধীরে ধীরে সফর বা পর্যটনও বিশ্বব্যাপী সার্বজনীন ও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বর্তমানে পর্যটনকে বিশ্ব অর্থনীতির অন্যতম বৃহত্তম এবং সবচেয়ে লাভজনক শিল্প হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বলা হয়ে থাকে যে তেল ও গাড়ি নির্মাণ শিল্পের পরে পর্যটন হলো বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম শিল্প। পর্যটন শিল্পের মাধ্যমে কাজের সুযোগ সৃষ্টি করা,উপার্জন করা, দারিদ্র্য হ্রাস করা এবং সামাজিক ন্যায়ের বিস্তারসহ সমাজে কল্যাণ প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হয়।
ট্যুরিজম বা পর্যটনের বহু প্রকার বা শাখা রয়েছে। যেমন ঐতিহাসিক পর্যটন, প্রকৃতি পর্যটন,সাংস্কৃতিক,অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক,বৈজ্ঞানিক,খেলাধুলা বা ক্রীড়া পর্যটন,দু: সাহসিক এবং ধর্মীয় ভ্রমণ ইত্যাদি। এই শ্রেণিবিন্যাসটি নির্ভর করে যারা ভ্রমণ করবেন তাদের অভিপ্রায় বা উদ্দেশ্যের ওপর। সাম্প্রতিক দশকগুলিতে স্বাস্থ্য পর্যটন ব্যাপকভাবে পর্যটকদের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। রোগ প্রতিরোধ কিংবা চিকিত্সার উদ্দেশে অনেক ভ্রমণকারীই বিভিন্ন দেশ সফরে যান। এরাই হলেন স্বাস্থ্য পর্যটক বা হেল্থ ট্যুরিস্ট। তার মানে স্বাস্থ্য পর্যটন হল এক ধরনের ভ্রমণ যা শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য বজায় রাখার স্বার্থে কিংবা স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটাতে অথবা স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার করতে একজন পর্যটক প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা নিতে অন্য কোনো দেশে যান। সুতরাং,একজন স্বাস্থ্য পর্যটক তার নিজস্ব স্থায়ী আবাস ছেড়ে বিশ্বের অন্য কোনো দেশে ভ্রমণ করতে যান সেদেশের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা কেন্দ্রগুলো থেকে চিকিত্সা পরিষেবা নিয়ে উপকৃত হতে। স্বাস্থ্য পর্যটন এখন বিশ্বের অন্যতম দ্রুত বর্ধনশীল পর্যটন। বিশ্বব্যাপী এখন স্বাস্থ্য পর্যটকদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।

বলা হয়ে থাকে যে,প্রতি বছর সাত মিলিয়ন মানে সত্তর লাখেরও বেশি মানুষ স্বাস্থ্য পর্যটন পরিসেবা পেতে বিশ্বব্যাপী ভ্রমণ করে। স্বাস্থ্য পর্যটন বাজার বিশ্বের অন্যতম প্রতিযোগিতামূলক এবং লাভজনক শিল্প। সে কারণে বিভিন্ন দেশের সরকার এই স্বাস্থ্য পর্যটন শিল্পের অর্থনৈতিক সুবিধাগুলি অর্জন করতে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোসহ বিশ্বের বহু দেশ এই শিল্পে বিনিয়োগ করতে আগ্রহ দেখিয়েছে। পর্যটকদের আকৃষ্ট করার জন্য এখন বিভিন্ন দেশের মধ্যে প্রতিযোগিতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সবাই চাচ্ছে উন্নত ব্যবস্থার মাধ্যমে স্বাস্থ্য পর্যটকদের দৃষ্টি ও মনোযোগ আকৃষ্ট করতে। স্বাস্থ্য পর্যটন আবার চিকিত্সা পর্যটনসহ বিভিন্ন শাখায় বিভক্ত। মেডিকেল ট্যুরিজম হল স্বাস্থ্য পর্যটনের সবচেয়ে প্রচলিত এবং গুরুত্বপূর্ণ উপ-বিভাগ। ভ্রমণ এবং চিকিত্সার মতো অর্থনৈতিকভাবে সুবিধাজনক দুটি শিল্প একত্রিত হবার মাধ্যমে চিকিত্সা পর্যটনের বিষয়টি বিশ্বব্যাপী গড়ে উঠেছে। বিশ্বব্যাপী চিকিত্সা পর্যটন বাজারের আয় বছরে তেতাল্লিশ হাজার নয় শ কোটি ডলার।
চিকিৎসা পর্যটনের জন্য মানুষ কেন নিজ দেশ ছেড়ে অন্য দেশে পাড়ি জমায়-এরকম একটা চিন্তা মাথায় কাজ করতেই পারে।উত্তরটা আসলে খুবই সহজ। তা হলো উচ্চমানের স্বাস্থ্যসেবা এবং সকল সুযোগ সুবিধা থাকা,দক্ষ ও অভিজ্ঞ ডাক্তারের সার্বক্ষণিক উপস্থিতি,চিকিত্সা ব্যয়ের স্বল্পতা এবং চিকিত্সার জন্য ডাক্তারের আসার পথপানে তাকিয়ে থেকে তালিকাভুক্ত হয়ে অপেক্ষমান না থাকা। এসব কারণেই একজন চিকিত্সা পর্যটক নিজ দেশ ছেড়ে স্বাস্থ্য পর্যটন ক্ষেত্রে সক্রিয় দেশগুলোর স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোর শরণাপন্ন হয়। চিকিৎসা পর্যটকদের গন্তব্য সাধারণত উচ্চতর চিকিত্সা সুবিধা সম্পন্ন এবং সস্তা চিকিত্সা ব্যয়যুক্ত দেশগুলির ক্লিনিক কিংবা হাসপাতাল। এ ধরনের চিকিৎসা পরিষেবা কে কত সস্তায় এবং কত তদ্রুত দিতে পারে সেই প্রতিযোগিতায় নামে বিভিন্ন দেশ ও মেডিক্যাল সেন্টারগুলো। আবার চিকিত্সা পর্যটন খাতে দেওয়া পরিষেবাগুলি বিভিন্ন রকমের। আবার পর্যটকদের পছন্দ বা নির্বাচনের ওপর নির্ভর করে সেবায় পরিবর্তনও হয়।
পর্যটকদের পছন্দ বা নির্বাচনের কথা বলছিলাম। পর্যটকদের পছন্দ বা নির্বাচনের মধ্যে প্রাথমিক ও সাধারণ ডেন্টাল সার্ভিস এবং কসমেটিক সার্জারি থেকে শুরু করে অ্যাডভান্সড সার্জারি যেমন হাঁটুর প্রতিস্থাপন,হার্ট সার্জারি,চোখের সার্জারি বা বন্ধ্যাত্ব সবই থাকতে পারে। পর্যটনের জন্য আকর্ষণীয় বিশ্বের বহু দেশই নিজেদের আয়ের জন্য চিকিৎসা পর্যটনমূলক পরিষেবাও দিয়ে থাকে। তবে এটা নিশ্চিত যে একটা দেশের সক্ষমতা ক্রীড়া ও বিনোদনের বিপরীতে চিকিৎসা বিজ্ঞান,স্বাস্থ্য সেবার জন্য ভবন নির্মাণে ব্যয় করার মধ্যেই নিহিত নয়।
দক্ষ ও অভিজ্ঞ চিকিত্সক,যে দেশে চিকিৎসা নিতে যাচ্ছেন সে দেশে চিকিত্সা বিজ্ঞানের ইতিহাস,পর্যাপ্ত চিকিত্সা ও নার্সিংয়ের ব্যবস্থা, স্ট্যান্ডার্ড হাসপাতাল এবং ক্লিনিক,আধুনিক চিকিত্সা সরঞ্জামে পরিপূর্ণতার পাশাপাশি চিকিত্সা বিষয়ক কার্যকর আইন ও বিধিবিধানগুলো একটি দেশের চিকিত্সা পর্যটনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে পরিগণিত। এই বৈশিষ্ট্যগুলো থাকলেই স্বাস্থ্য পর্যটন ক্ষেত্রে একটি দেশ সক্রিয় হয়ে উঠতে পারে। #
পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/ মো:আবু সাঈদ/ ২
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।